৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা সম্মেলনের আহ্বান
সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই আরও জোরালো করতে হবে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই আরও জোরদার করতে হবে। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই বার্তাই উঠে এসেছে সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা ২২তম সম্মেলনে। গত ১-২ জানুয়ারি কমরেড জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র চন্দ নগরে (কোচবিহার) কমরেড তীর্থনাথ রায় মঞ্চে (বেনফিস মহল) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য আহ্বান রেখেছেন, জনস্বার্থে আন্দোলনে একমাত্র বিকল্প বামপন্থীদের লড়াই। এই লড়াই পার্টি বা গণসংগঠনের আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি আন্দোলনের তীব্রতা এমন হবে তা যেন কাঁপন ধরাতে পারে শাসক ও শোষকের বুকে। তিনি বলেছেন, বামপন্থীদের ঐক্যকে আরও জোরদার করার শপথ আমাদের নিতে হবে। তাই সমস্ত অংশের মানুষের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে।
এই সম্মেলন থেকে জেলায় আগামীদিনের লড়াই-আন্দোলনসহ পার্টিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনার জন্য ৫০ জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছে। অনন্ত রায় জেলা সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা কমিটিতে নতুন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৯ জন। স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য হয়েছেন তারিণী রায়, প্রদীপ নাথ এবং অরুণ চৌধুরী।
সম্মেলনে ৩৫০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন পরিচালনা করেন তারিণী রায়, অরুণ চৌধুরী, মধুছন্দা সেনগুপ্ত, সফিজ আহমেদকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।
সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির প্রবীণ নেতা অখিলচন্দ্র প্রামাণিক। শহিদবেদিতে তিনি ছাড়াও মাল্যদান করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, মৃদুল দে, জেলা সম্পাদক অনন্ত রায়, তমসের আলি প্রমুখ।
প্রতিনিধি সম্মেলনের সূচনায় শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন মহানন্দ সাহা।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক অনন্ত রায়। তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম যারা লকডাউনে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন তাদের পার্টিতে যুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, বিরোধীদের কোণঠাসা করে রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা করছে তৃণমূল। সমবায় থেকে পঞ্চায়েত - সমস্ত ভোটে ব্যাপক সন্ত্রাস ও ভোট লুট করেছে। এই ভোট দিতে না পারা মানুষের যন্ত্রণা বাড়ছে ক্রমশ। তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই বুক চিতিয়ে লড়তে হবে।
সম্মেলনে আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন মহানন্দ সাহা।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় মতাদর্শগত চেতনায় পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি লাল ঝান্ডার লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধির কথা উঠে এসেছে। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, কলকাতা পৌর নির্বাচনে বামপন্থীদের ভোট বৃদ্ধি কোচবিহার জেলার মানুষকেও উৎসাহিত করেছে। তাই ২৪ ডিসেম্বর কোচবিহারে অনুষ্ঠিত মহামিছিল সেই প্রমাণ দিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, সামনে জেলার ৬টি পৌরসভার নির্বাচন। সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে সাফল্য অর্জনে মানুষের আরও কাছাকাছি যেতে হবে।
এছাড়াও প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে, সার ও অন্যান্য চাষের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি সহ ফসলের অভাবী বিক্রির কথা। তাঁরা ঋণগ্রস্ত অভাবী কৃষকদের পাশাপাশি কর্মহীন শ্রমিক পরিবারের দুর্দশার কথাও তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শাসকদলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সরকারের ব্যর্থতার কথা। প্রতিনিধিরা তৃণমূলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, রাজ্য সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিভাজনের রাজনীতি রুখতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এছাড়াও প্রতিনিধিরা উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, কোচবিহারে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া, হেরিটেজ শহর ঘোষণা করা, বিমান পরিষেবা চালু করা এবং পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার দাবিতে সরব হয়েছেন।
প্রতিনিধিরা সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির তৎপরতা, বিএসএফ’র অত্যাচার, জেলার বিভিন্ন স্থানে শাসকদলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন তীব্র করার কথা বলেন।
সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের ভাষণে পার্টিকে শক্তিশালী করা, কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপ, জেলার সমস্যা এবং গরিব শ্রমজীবী মানুষের নানা সমস্যা-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করে লড়াইকে তীব্র করার আহ্বান জানিয়েছেন।
উদ্বোধনী ভাষণে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন, গত কয়েক বছরে অগণিত মানুষ নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। সেই সব মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে আছেন। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব, মহিলা, তফশিলি, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ - সবাই অধিকার রক্ষার লড়াই করছেন। এই লড়াইকে আরও সংগঠিত করতে হবে। তিনি বলেন, তৃণমূল-বিজেপি দুই দলই চেষ্টা করছে পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে আন্দোলনকে দমন করতে। মানুষে মানুষে ওরা বিভেদ তৈরি করছে। আমরা আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ না হলে ওরা সফল হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গে পুঁজিপতিদের মদতে তৃণমূল এবং বিজেপি-আরএসএস’র তৎপরতা চলছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে। আজ গরিব কৃষক, খেতমজুর ও কর্মহীন শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এই সমস্ত অংশের মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় করতে হবে। এই মানুষদের স্বার্থে লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে বলেছেন, একটা বিকল্প গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য। তারজন্য বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াই দরকার। তিনি বলেন, পুঁজিবাদ আজ তীব্র সংকটের মুখে। তা থেকে বাঁচতে ওরা বিভাজনের রাজনীতি করছে। এলক্ষ্যে ওরা বিজেপি-কে মদত দিচ্ছে। বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সিবিআই, প্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশন - সব কিছুই কুক্ষিগত করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে, গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে পার্টিকে উদ্যোগ নিতে হবে।
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী সম্মেলনে বলেছেন, মানুষের হতাশাকে ভর করে তৃণমূল এগিয়েছিল। হতাশাকে সবসময় ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট শক্তি। এখানেই আমাদের কাজ। মানুষের সুবিধা, অসুবিধা ও নানা সমস্যা মোকাবিলায় আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তিনি কোচবিহার জেলার নানা ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমাদের পার্টিরও এখানে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। জেলার বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ একটা লড়াই চাইছেন। সেই মানুষকে সংগঠিত করেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
এই সম্মেলনে এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য জীবেশ সরকার।