৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
এ বড়ো আনন্দের সময় নয়
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
কচ্ছপ এক জায়গায় শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে দেয় মাসের পর মাস। সময়ে সময়ে মানুষদের মধ্যেও অনেককেই দেখা যায় এরকমভাবে জীবন কাটাতে। সর্বশক্তিমান রাজার দাপটে বুদ্ধিমান মানুষকে নির্বোধ বা বোবা-কালা সেজে ঘুরে বেড়াতে হতে পারে। শত ধাক্কাতেও মানুষদের কাউকে কাউকে বিপন্নতাবোধ আক্রমণ নাও করতে পারে। নিজেদের গায়ে আগুন না লাগলে চারদিকের আগুনের ছোঁয়াও এদের অনেকের গায়ে নাও লাগতে পারে। আবার একই সাথে কেউ কেউ শাসককে খুশি করতে হাসি না পেলেও মাটি কাঁপিয়ে হাসতে পারে, আনুগত্যের ভান করতে পারে। এমন সময় যে দেশের বুকেই নেমে আসুক, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা ধার করে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যেতে পারে 'এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়'। সময় মানে তো পৃথিবীর সবথেকে দুরন্ত শিশুর মতো গতিময়। সেই সময়টাকে কি ফ্রেমে বাধা যায়? অতীতকে হয়ত বাধা যায়, কিন্তু বর্তমানকে বাধা যাবে কীভাবে? সময় যদি সামগ্রিকভাবে অবসন্নতায় আক্রান্ত হয়, আমরা কীভাবে গা বাঁচাব! শব্দের পর শব্দ উড়ে বেড়ায় চারপাশে। সব সময় সব শব্দ কি আমরা ধরতে পারি? শব্দের কারিগররা দিকে দিকে আক্রান্ত। তাহলে অক্ষর জুড়ে শব্দ, শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন হবে কী করে! ভালোবাসার কথা, আশার কথা, স্বপ্নের কথা, ভবিষ্যতের কথা শেখাবে কে, চেনাবে কে - যদি সমাজ শব্দের কারিগরদের যত্ন করতে না পারে!
হায়নাদের জান্তব উল্লাসে কান পাতা দায়। শাসকের ধামাধরা মুদ্রণ মাধ্যম ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সরকারকে সমর্থনের মাত্রা আকাশছোঁয়া। দিকে দিকে গণতন্ত্র লাঞ্ছিত, তবুও মোড়ে মোড়ে থেকে যায় গণতন্ত্রের ফ্লেক্স। অথচ অধিকাংশ মানুষ সামান্য আয়ে সংসার চালানোর যুদ্ধে ক্লান্ত, অবসন্ন। মাসের-পর-মাস নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। বিশ্বের প্রথম ১০০ ধনীর তালিকায় এদেশের মানুষ বাড়ছে, দেশের নেতাদের একাংশের সেই আনন্দে রাতে ঘুম নেই। ‘রাজা যে উলঙ্গ’ সেকথা চিৎকার করে প্রকাশ্যে বলার লোক বাড়ছে। ধনীদের জন্যেই সরকার - এ বোধ মানুষে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের সব সরকারি সম্পত্তি ধনীদের হাতে তুলে দিয়েও সরকার থেমে নেই। তাই মানুষের শেষ আশা-ভরসার জায়গা ব্যাংকটাও বেঁচে দিতে চাইছে তাদের হাতে, যারা ব্যাংকের টাকা ধার নিয়ে শোধ না করার জন্যে ব্যাংকগুলোতে অনাদায়ী/কু ঋণ বেড়েই চলেছে। মানুষ এটাও উপলব্ধি করতে পারছেন যে, বাঘ যখন অথর্ব হয় তখনই সে দিনে দিনে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। ছোটো ছেলেমেয়েরা ‘অ’ তে অজগর না শিখে, শিখছে ‘অ’ তে ‘অগণতন্ত্র’ , ‘আ’ তে ‘আম’ যেমন শিখছে, একইসাথে শিখছে ‘ব’ তে বেচা, ‘র’ তে রক্ত।
একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ বাদ দিয়ে অধিকাংশ মানুষই কমবেশি ধর্মে বিশ্বাসী। সাধারণ গৃহস্থ মানুষের অধিকাংশের কাছেই ধর্ম হলো একটা বিষয় যা তাদের বাঁচতে সাহায্য করে। ধর্মের প্রতি মানুষের এই আস্থা সত্ত্বেও সমাজে সংকট সৃষ্টি হয় নি ততক্ষণ, যতক্ষণ না ধর্মের রূপ বিকৃত হয়ে সংকীর্ণ হয়েছে, ধর্ম মানবতার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে, সাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মীয় চেতনাকে গ্রাস করেছে অর্থাৎ সংক্ষেপে বলা যায় মানুষ ধর্মমোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধর্মমোহগ্রস্ত মানুষ অন্যকে মারে, নিজেও মরে। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসীরা মানুষকে কষ্ট দেয় না, মারে না, অশ্রদ্ধা করেনা। মানুষকে ধর্মমোহগ্রস্ত বানাতে পারলেই মানুষে মানুষে হানাহানির প্রবণতা বেড়ে যায়। ইতিহাস এই শিক্ষা বারেবারে দিয়েছে যে, ধর্মের সঙ্গে যখন হাত মেলায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন, তখনই ধর্মীয় বিপদ সাম্প্রদায়িক বিভেদে পরিণত হয। আমরা জানি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের মিশ্রণ হল ধর্মমোহ। ধর্মমোহগ্রস্ত মানুষ যুক্তি, তথ্য, সত্যের ধার ধারে না। তার কাছে বিশ্বাস আনুগত্যবোধই মুখ্য। তাই ধর্মান্ধ মানুষের কারখানা তৈরি করার নিরন্তর চেষ্টা চলছে অনেক বছর ধরেই।
আমরা যেন ভুলে না যাই, কোনো সৎ হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী সৎ মানুষ কখনোই তার ধর্মের অসৎ মানুষকে নিজের বন্ধু বা ভালোবাসার মানুষ বলে মনে করে না। কোনো মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাসী হলেই সে মানুষটি সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। তাই ধর্মবিশ্বাসকে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়াটাও ঠিক হবে না। ধর্মপ্রাণ মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের বিপদে নিজের প্রাণ দিয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আমরা জানি। ধর্মান্ধের বেঁচে থাকা শুধু তার ক্ষুদ্র ‘আমি’টার জন্য। ধর্মান্ধকে কোনো ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা উচিত নয়। ধর্মস্থানে যারা তাণ্ডব করে তাদের নিয়ে যত না দুশ্চিন্তা, বেশি দুশ্চিন্তা যদি প্রতিবাদ করা মানুষের সংখ্যা কমে যায়। তাই গণতান্ত্রিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সেই লড়াইটা যেন ধর্মের বিরুদ্ধে না হয়ে ওঠে। কারণ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসটা যারা পড়েছেন তারা জানেন যে, সমাজে শোষণ, বঞ্চনার মূল কারণগুলি যতদিন থাকবে, ততদিন ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই উলটো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে মানুষের মধ্যে। বিবেকানন্দ তাঁর বিখ্যাত শিকাগো বক্তৃতাতে ১৮৯৩ সালে বলেছিলেন, "সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলোর ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করে রেখেছে। ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করেছে বারবার। ইহাকে নর শোণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতা ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। এইসব পিশাচ যদি না থাকত তাহলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হত”। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, "এই মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার থেকে নাস্তিকতা অনেক ভাল"।
সমাজ বদলের মিছিলটা একটু হালকা লাগছে লাগুক। খেয়াল করলে দেখা যায় এখন এই মিছিলের অধিকাংশই শুধু মানুষের মাথা। মিছিল থেকে প্রায় সব ভূতগুলো অন্ধকারে পালিয়েছে। আলোর পথযাত্রীরাই শুধু এখন হেঁটে চলেছেন নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে। সমাজ বদলের মিছিলে যাদের হাঁটার যোগ্যতা আছে, এখন শুধু তারাই হাঁটছে। অবহেলিত, অভিমানীর দল যে যার নিজের মতো করে আবার পথে নামছে। চশমার পাওয়ারটা অ্যাডজাস্ট করারও বোধহয় প্রয়োজন ছিল, কারণ দেখার গোলমালে সাথিকে চিনতে ভুল তো হচ্ছিলই। সময় চোখ খুলে দিয়েছে, পুরোটা না হলেও অনেকটাই। ধাক্কাটা বোধহয় দরকার ছিল। ধাক্কার মুখেই জেগে উঠছে আবার নতুন প্রজন্ম। স্পিনোজার কথায় বলতে হয় - ইতিহাস আর জীবন যখন একটা প্রবল ধাক্কা আনে, তখন তা নিয়ে হাসি বা কান্না সমীচীন নয়। দরকার হলো পরিস্থিতিকে বোঝার গভীর প্রয়াস।