৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
সাবিত্রীবাই ফুলে
তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক শিক্ষিকাকে স্মরণ
সর্বাণী সরকার
সাবিত্রীবাই ফুলে
এবছরের তেসরা জানুয়ারি সাবিত্রীবাই ফুলে’র ১৯১ তম জন্মদিন। পরাধীন ভারতে নারীশিক্ষার প্রচলনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায় ১৮৩১ সালের ওইদিনে সাবিত্রীবাই ফুলে জন্মগ্রহণ করেন। তখন দেশে ব্রিটিশদের শাসন, যেখানে মহিলাদের কোনো অধিকারই ছিল না। তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনে ভারতে মহিলাদের অধিকার অর্জনে স্বামী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে’র সাথে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জ্যোতিবা ফুলেও ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক।
ভারতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষিকা হলেন সাবিত্রীবাই ফুলে। তাঁকে আধুনিক মারাঠি কবিতার প্রবর্ত্তিকাও বলা হয়। দেশে মহিলাদের অবস্থার পরিবর্তনের সংকল্প নিয়ে স্বামী জ্যোতিবা ফুলের সাথে ১৮৪৮ সালে অস্পৃশ্য বালিকাদের জন্য একটি স্কুল খোলেন। সেই স্কুলেই তিনি দেশের প্রথম শিক্ষিকা হলেন। এটা তৎকালীন সমাজে আতঙ্কের ঢেউ তৈরি করল।
ওই ১৮৪৮ সালেই সাবিত্রীবাই এবং জ্যোতিবা আরও পাঁচটি স্কুল খুললেন। শেষপর্যন্ত মহিলাদের শিক্ষাপ্রসারে এই কাজের জন্য তাঁদের সম্মানিত করল ব্রিটিশ সরকার। ১৮৫২ সালে জ্যোতিবা এবং সাবিত্রীবাইকে সরকার শাল দিয়ে সংবর্ধনা জানায়।
জ্যোতিবা ফুলে
মহাত্মা জ্যোতিবা’কে মহারাষ্ট্র এবং ভারতের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিচুবর্ণের মহিলাদের শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগের জন্যই তিনি বেশি পরিচিত। জ্যোতিরাও’কেই সেসময়ে জ্যোতিবা নামে ডাকা হতো। তিনি সাবিত্রীবাইয়ের শুধু স্বামীই ছিলেন না, তাঁর পরামর্শদাতা এবং কাজের বড়ো সমর্থক ছিলেন।
সমস্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও সাবিত্রীবাই মেয়েদের শিক্ষার কাজ চালিয়ে যান। যখন সাবিত্রীবাই বাড়ি থেকে বেরোতেন, একদল গোঁড়া মানুষ তাঁর পিছন পিছন গিয়ে অশ্লীল ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করত। তারা সাবিত্রীবাইয়ের দিকে পচা ডিম, গোবর, টোমাটো এমনকী পাথরও ছুঁড়ত। তবুও তিনি নম্রভাবে হেঁটেই স্কুলে পৌঁছতেন। তাঁর প্রতি এধরনের আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একসময়ে ঠিকই করে ফেলেছিলেন এসব ছেড়ে দেবেন। কিন্তু স্বামী সবসময়ে পাশে থেকে তাঁকে সাহস জুগিয়ে গেছেন, মূলত সেই কারণেই সাবিত্রীবাই এসব কাজ থেকে সরে আসতে পারেননি।
জ্যোতিবা ফুলে নারীশিক্ষা নিয়ে কাজ করতেন এবং তিনিই দেশে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাবিত্রীবাইকে বলেন, স্কুলে তাকে সাহায্য করার জন্য শিক্ষিকা দরকার। জ্যোতিবা সাবিত্রীকে শিক্ষিত করেন এবং তাঁর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষিকার কাজে জ্যোতিবা’র কাছে প্রথম এবং আদর্শ প্রার্থী ছিলেন সাবিত্রীবাই। এই জন্য সমাজের গোঁড়াব্যক্তিদের কাছ থেকে হিংস্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। সাবিত্রীকে প্রশিক্ষণ স্কুলে পাঠান জ্যোতিবা। আরেক মুসলিম মহিলা ফতিমা সেখে’র সাথে তিনি ওই স্কুল থেকে পাশ করেন। সাবিত্রীবাইয়ের পড়াশুনো শেষ হওয়ার পর জ্যোতিবা ফুলে’র সাথে ১৮৪৮ সালে পুনেতে মেয়েদের স্কুল শুরু করেন। বিভিন্ন জাতের নয় জন ছাত্রী হিসেবে সেই স্কুলে নাম লেখায়।
পরের পদক্ষেপ ছিল একেবারেই বৈপ্লবিক। সেইসময়ে কম বয়সের মেয়েদের সাথে বয়স্ক লোকেদের বিয়ে হতো। বিভিন্ন অসুস্থতায় বৃদ্ধ বয়সে ওই লোকগুলো মারা যেত, আর বালিকারা যাঁদের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা বিধবা হতেন। ওই বিধবারা কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করতে পারতেন না, কিংবা সুন্দর লাগবে এমন কিছুই তাঁরা করতে পারতেন না। তাঁদের মস্তক মুণ্ডন করা থাকত এবং তৎকালীন সমাজ তাঁদের কঠোর তপস্বিনীর ন্যায় জীবনযাপন করতে বাধ্য করতেন।
বিধবাদের এই দুর্দশার বিরুদ্ধে সাবিত্রীবাই এবং জ্যোতিবা অবতীর্ণ হলেন এবং নাপিতদের ভর্ৎসনা করেন।তাঁরা নাপিতদের ধর্মঘট সংগঠিত করেন এবং বিধবাদের আর মস্তক মুণ্ডন করাবে না বলে সম্মত করান। এটা ছিল এধরনের প্রথম ধর্মঘট। সব ধরনের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই চালাতেন।
উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্য নির্ধারিত পানীয় জলের ব্যবস্থায় সেসময়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না।এর বিরুদ্ধে তাঁরা অগ্রসর হলেন।জ্যোতিবা এবং সাবিত্রীবাই উভয়ই তাঁদের বাড়ির চারদিকে ঘেরা জমির মধ্যে থাকা জলের ট্যাঙ্ক অস্পৃশ্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
জ্যোতিবা’র শিক্ষামূলক কার্যক্রমের সঙ্গেই শুধু সাবিত্রীবাই যুক্ত ছিলেন না, তাঁর শুরু করা প্রতিটি সামাজিক সংগ্রামে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। একবার জ্যোতিবা এক গর্ভবতী মহিলাকে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত করেছিলেন এবং ওই মহিলার কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, বাচ্চা জন্মানোর পর তাকে তিনি গ্রহণ করবেন। সাবিত্রীবাই ওই মহিলাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসতে রাজি হন এবং ওই মহিলার বাচ্চা প্রসবে সাহায্য করার ব্যাপারে স্বেচ্ছায় আশ্বাস দেন। পরে সাবিত্রীবাই এবং জ্যোতিবা ওই শিশুকে দত্তক নেন। ওই শিশু বড়ো হয়ে জ্যোতিবা’র মৃত্যুর পর ডাক্তার হন। ওই দত্তক ছেলেও জ্যোতিবা’র চিতায় আগুন দেয় এবং এক ন্যায়সম্মত সন্তানের ন্যায় সমস্ত দায়িত্ব পালন করেন।
২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি সাবিত্রীবাই ফুলে’র জন্মদিনে সিপিআই(এম) কর্ণাটক রাজ্য সম্মেলন মঞ্চে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রকাশ কারাত সহ পার্টি নেতৃবৃন্দের।
এই ঘটনা ফুলে দম্পতির কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তাঁরা হিন্দু সমাজে বিধবাদের দুর্দশার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন। বহু পুরুষ তাদের কামলালসা চরিতার্থ করতে মহিলাদের ওপর যৌন অত্যাচার চালাত। তারপর তাঁদের আর গ্রহণ করত না। সেই মহিলারা গর্ভবতী হয়ে পড়লে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হতেন। যে মহিলারা এভাবে অত্যাচারিত হয়ে গর্ভবতী হয়ে পরতেন তাঁদের জন্য সাবিত্রীবাই এবং জ্যোতিবা ‘প্রসূতিসদন’ খোলেন। তাঁরা এই প্রসূতিসদনের নাম দেন ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’।
জ্যোতিবা এবং সাবিত্রীবাই প্রতিমা উপাসনার বিরোধিতা করতেন। কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থের তাঁরা রক্ষক ছিলেন। তাঁরা যাদের এসব নিেয় প্রশ্ন করতেন, তাদের দ্বারা ফুলে দম্পতি সামাজিকভাবে একঘরে হয়েছিলেন এবং তাদের কদর্য আক্রমণের মুখোমুখি হন। জ্যোতিবা’র মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সত্য শোধক সমাজ’-এর দায়িত্ব নেন সাবিত্রীবাই। তিনি সমাজের সভাগুলিতে সভাপতিত্ব করতেন এবং কর্মীদের পরিচালনা করতেন।
প্লেগ আক্রান্তদের জন্য সাবিত্রীবাই অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। গরিব শিশুদের জন্য তিনি ক্যাম্প সংগঠিত করতেন। বলা হতো, মহামারীর সময়ে তিনি প্রতিদিন দুহাজার শিশুকে খাওয়াতেন। ১৮৯৭ সালে মহারাষ্ট্র জুড়ে বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারীতে সাবিত্রীবাই একজন শুধু দর্শক হয়ে থাকেননি, আক্রান্ত এলাকায় সাহায্যের জন্য তিনি দ্রুত পৌঁছে যান। পুনের হাডাপসারে প্লেগ আক্রান্তদের জন্য একটা ক্লিনিক খোলেন। দশ বছরের এক প্লেগ আক্রান্ত শিশুকে নিজে কোলে করে নিয়ে আসার সময় তিনি নিজে প্লেগ সংক্রমিত হয়ে পড়েন। ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ সাবিত্রীবাই ফুলে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাবিত্রীবাইয়ের জীবন এবং কাজ ভারতীয় সমাজে সমাজ সংস্কার ও মহিলাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সংগ্রামের এক উজ্জল অধ্যায়। বর্তমান সময়েও বহু নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীর অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন তিনি। তাঁর সাফল্য ছিল বৈচিত্র্যময় এবং বহুমুখী; কিন্তু তার প্রভাবের অভিমুখ ছিল একমুখী - যা তাঁর মনুবাদী সংস্কৃতি বিরুদ্ধে সাহস এবং অগ্রগামী প্রতিস্পর্ধাকেই তুলে ধরে।
(লেখিকা সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় নেত্রী)