৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
কোটি দেহের সমষ্টিতে গ্রাম আজ হিমালয়
বনবাণী ভট্টাচার্য
অবারিত মাঠ, গগণ ললাট চুমে তব পদধূলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
এই গ্রামগুলি ছিল উপেনের সময়ে। যদিও উপেনের মাত্র দু’বিঘা জমিও জমিদার কেড়ে নিয়েছিল। বাতাসের ধাক্কায় এক সময়কার তার আমগাছের দুটো পাকা আম মাটিতে পড়লে, জননী জন্মভূমির আশীর্বাদ মনে করে উপেন তুলে নিল; জমিদারের রক্ষী তাকে ধরে নেয় এবং জমিদার তাকে চোর বলে সাব্যস্ত করে। তবু বিনি খাজনায় উপেনরা গাছ-গাছালি ভরা সেদিনের গ্রামে ছায়াটুকু পেত - অভাবের তাড়না থাকলেও তো, নিস্তব্ধ শান্ত রাত্রে নিশ্চিন্তের ঘুমটুকু ওদের আয়ত্তে ছিল। জমিদাররা শোষণ করত, অত্যাচার করত ঠিকই, আবার পুকুর কাটা-টিউবয়েল বসানো, স্কুল প্রতিষ্ঠাও করত, কিছুটা মানবিকতা, কিছুটা আভিজাত্যের অভিমানে।
উপেনদের গ্রাম এখন যেন ঠাটা-পড়া মাঠের মতো দগ্ধ-তপ্ত, ছায়া শূন্য। মরা ডাল কাটা গরিব কাঠুরেরা না, গ্রামগুলোকে বৃক্ষহীন করে পরিবেশের অভিশাপ নামিয়ে আনছে করপোরেটের পেয়াদারা - যারা অনুব্রত, যারা আরাবুল ইসলাম। করপোরেটের লোভের আগুনে পুড়ছে গ্রামবাংলা - ওই একই লোভ জ্বালিয়েছে, জ্বালিয়ে দেয় এক একটা ‘বগটুই’। চুরি করা, লোকঠকানো, জোর ফলানো টাকায়, সাতমহলা বাড়ি, অভাবনীয় দামের কয়েকখানা গাড়ি, অগুন্তি বাইক, রাইস মিল, বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া, সেদিনের ট্রাক ড্রাইভার-ফলওয়ালা-মাছওয়ালারা গ্রামের মাতব্বর হয়ে, গ্রামগুলিকে করেছে ক্ষমতা আর অর্থের দাপটে আতঙ্কপুরী। ছেলে-মেয়ে নিয়ে অভাবে অনটনে, সুখে-দুঃখে, নিজের বাড়িতে, নিজের সংসারের সেই ‘শান্তির নীড়’, কেমন করে জনা ১১’র প্রাণ পুড়িয়ে, জ্বলন্ত নরকে পরিণত হয়, দেখেছে বগটুই। পঞ্চায়েত উপপ্রধান ভাদু শেখ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে - লালন শেখরা সোনা শেখের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়েছে। উপপ্রধান ভাদু শেখ, লালন শেখদের কেন অকালে মরতে হয়? মরতে হয়, টাকার ভাগাভাগি, পঞ্চায়েতের পরিষেবা চুরি থেকে কয়লা খাদান-বালি খাদানের অবৈধ আয়ের লঙ্কাভাগের কারণে। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষে দুর্নীতির দানব, তাই স্বায়ত্বশাসনও দুর্নীতির পাঁকে পূর্ণ। এই পাঁকেই জন্মায় ভাদু শেখেরা - তাদের লালন-পালন করে শাসকদল, আর তাদের রক্ষী বাহিনী রাজ্য পুলিশ থেকে সিভিক ভলান্টিয়ার নামে, হিটলার মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্ট-ব্রাউন শার্ট। নমিনেশন পেপার জমা দেবার সংক্ষিপ্ত সময়টুকুও রক্তস্নাত। পার্টিকর্মী-নেতা-সংগঠকরা আক্রান্ত-আহত। মহিলা নেত্রী সোমা দাশের মাথার আঘাত থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি হাসপাতালে। শুধু মীনাখাঁ বা ভাঙর নয় গ্রামবাংলার সর্বত্র তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটে গণতন্ত্রের উৎসবের জন্য প্রাণঘাতী মহড়া শুরু করেছে - নমিনেশন পেপার তোলা-জমার এই পর্বেই শাসকদল কুৎসিত লোমশ হাতগুলির মৃদু এক্সারসাইজ করে ৮ জুলাইয়ের জন্যে ওয়ার্মআপ করছে। সাজ সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ে আছে দাদার সরকার আর রাজ্য সরকারের নিরীহ পোষ্য নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু কেন পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচন রক্তাক্ত? ভূপৃষ্ঠের মাত্র ০.০৭ শতাংশ আর ভারতের ২.৭ শতাংশ জমিতে অবস্থান তো এই বাংলার। কিন্তু জনঘনত্বে ভারতে তো বটেই বহুদেশেরই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো - প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ১০২৮ জন বাস করেন। আর এই মানুষের আছে বেয়ারা জেদ, আছে সামনে চলার আর এগিয়ে যাবার নেশা। কেউ কেউ হোঁচট খায়, থমকে যায়, চোখের ভ্রান্তিতে পা পিছলে পড়েও যায় - কিন্তু শক্তহাতের টান পড়লেই কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ায় - দু’হাতে চোখ রগড়ে দৃষ্টিটাকে স্বচ্ছ করতে পারে। শাসকেরা যত ক্ষুদ্রই হোক - এই ভুখা-ফুখা মানুষকেই চিরকাল ভয় পায়-আর দেবকীর ছেলেকে হত্যার জন্যে কংসের মতোই মজবুত হাতের অধিকারী এই বামপন্থী থেকে মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের নিঃশেষ করার জন্যে হন্যে হয়। তাই, বামপন্থীদেরই সমস্ত বিজেপি বিরোধী, তৃণমূল বিরোধীকে সাথে নিয়ে কংসবধের জন্য সর্বাঙ্গীন প্রস্তুতি নিয়ে, যেখানে যে অস্ত্র প্রয়োজন সেই অস্ত্রেই কংসের বাহিনীকে মোকাবিলা করতে হবে - জনচেতনায় যুক্তফ্রন্ট থেকে বাম সরকারের শাসনের ফসলের ছবি বারে বারে এঁকে দিতে হবে।
প্রাক্-স্বাধীনতা থেকে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনে ডাঙ্গাছোঁড়া-খাঁপুর-মাশিলা রক্তস্নাত হয়ে, অহল্যামার সন্তানের জন্মের ছাড়পত্র না পাওয়ায় যেদিন তারই দাবিতে কোনো গাছে কোনো কুঁড়িরা ফোটেনি, কোনো অঙ্কুর মাথাও তোলেনি, প্রজাপতি যত আরও একদিন গুটিপোকা হয়েছিল, যেহেতু সেদিন সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল, সেই তেভাগা আন্দোলনের রক্তঋণ শোধে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯-এর স্বল্পস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার নিয়েছিল বলিষ্ঠ পদক্ষেপ - ‘‘কৃষকের তৈরি ধানে তারই অধিকার’’ মনে ও মুখে ঘোষণা করে। এবং তা রূপায়ণ করে যথাসাধ্য পুলিশ প্রধানদের বৈঠক ডেকে সরকার বলে দিয়েছিল - ‘‘সরকারি নির্দেশের মূল কথা হলো চাষ করা কৃষকদের ফসল কাটার অধিকার ও সেই সঙ্গে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।’’ যুক্তফ্রন্ট সরকার দু’বারে ৩ লক্ষ ২ হাজার একর জমি ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বেঁটে দিয়েছিল।
তাই, জরুরি অবস্থা অবসানে, কোটি কোটি পায়ের তলায় পড়ে থাকা মানুষগুলি, যারা জমিদার মহাজনদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারত না, তারা বুঝেছিল, ওই যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার আর তাদের পার্টি সিপিআই(এম)-কেই ক্ষমতায় আনতে হবে, কারণ তারাই প্রথম ভোটে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেছে - কথা দিয়ে কথা রেখেছে। তারা পেয়েছে জমির অধিকার, পেয়েছে রক্তে বোনা ধান ঘরে তুলতে এদেরই শাসনে। তারা পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে, জমিদার-জোতদার-মহাজনকে শত্রু বলে আঙুল তুলে, বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
বামফ্রন্ট সরকার, পাঁজর-ভাঙা বাংলাকে নতুন করে নির্মাণ করল রাজ্যের শোষিত-বঞ্চিত-প্রতারিত মানুষকে সাথে নিয়ে, আর সেই মানুষের জন্যেই। যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি নিয়ে এই সরকার বাংলাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে, সরকারি-বেসরকারি নানা বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে, কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল ভেঙে ভেঙে চলতে চলতে ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একর জমি ৩০ লক্ষ ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করল। এই ভূমি সংস্কারের ফলে, কৃষি জমির মালিক হলো রাজ্যের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। ধামাধরা কোনো মিডিয়ার নয়, ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের সপ্রশংস-উচ্ছ্বসিত তথ্য। জাতপাত-জাতি উপজাতি সংখ্যালঘু সব প্রশ্ন ঝেড়ে ফেলে সরকার যাদের হাতে জমির পাট্টা তুলে দেয় তাদের ৩৭ শতাংশ তপশিলি, ১৮ শতাংশ আদিবাসী এবং ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু। বর্তমান রাজ্য সরকার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ৫০০ টাকা দিয়ে যখন হাতেই মহিলাদের মাথা কাটতে চায়, তখন মানুষের সরকার, ৬ লক্ষ ১৮ হাজারের বেশি নারী-পুরুষের যৌথ পাট্টা এবং শুধু একক মহিলার নামে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মহিলাকে জমির পাট্টা দিয়ে মালিকের অধিকার দিয়েছিল - অনুগ্রহ কি অনুকম্পা নয়। গ্রামে তো শুধু কৃষকের বাস নয়। তাই, খেতমজুর, গ্রামীণ কারিগর ও মৎস্যজীবীদেরও ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান’ প্রকল্পে ৫ কাঠা পর্যন্ত জমি সরকার দিয়ে ২ লক্ষ পরিবারকে স্থায়ী আশ্রয় ও জীবিকার উপায়ে সহায়তা করেছে। এই সমস্ত কর্মসূচি ও প্রকল্প ‘শ্রী’হীন - কিন্তু এগুলির মধ্য দিয়ে সরকার গ্রামীণ গরিবদের জীবন শ্রীমন্ত করার আন্তরিক চেষ্টা করেছে।
গ্রাম মানে তো মূলত কৃষি! সেই কৃষিজ উৎপাদনে, ১৯৭৬-৭৭ সালে রাজ্যে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছিল ৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন, ২০১০-১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে উৎপাদন হয়েছিল ১৭০ লক্ষ মেট্রিক টন। কৃষি আর সেচ অঙ্গাঙ্গী জড়িত দুটো শব্দ। কৃষিকাজের ৩২ শতাংশ জমি ১৯৭৭ সালে সেচসেবিত ছিল, বামফ্রন্টের আমলে তার পরিমাণ দাঁড়াল ৭৩ শতাংশ।
বামফ্রন্ট সরকার, সুপার স্পেশালিটি-ফিটি হাসপাতাল বলে রাজ্যের অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপনের দিকে যায়নি, ১৯৭৭ সালে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ১৩২৬ সংখ্যাটাকে ১২০০০-এ এবং সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ৭৩ শতাংশ মানুষকে পরিষেবা দিয়েছে। যদিও গ্রাম শহর মিলিয়েই।
সত্যি সত্যিই কোনো ‘শ্রী’-এর বালাই ছিল না। কিন্তু বাম সরকার ১৯৭৯-৮০ সাল থেকেই প্রতিবন্ধী ভাতা, বার্ধক্য ভাতা (আদিবাসী সহ), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষাকে প্রাণপণে অটুট রেখে বৃদ্ধিও করেছে - কেন্দ্রীয় সরকার আজকের মতো সহযোগিতা করলে এই প্রকল্পগুলির বিকাশ আরও বেশি হতো। ভূমিহীন কৃষকের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্যও তা সম্প্রসারিত ছিল।
নিজের পায়ে দাঁড়াতে গরিব মানুষ বন্ধন ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য ব্যাংক ও ঋণদানকারী সংস্থা থেকে লোন নিয়ে পুলিশ ও অন্য মাস্লম্যানদের গলা ধাক্কা খেয়ে হজম করার পরও তারা গলায় গামছা দিয়ে টানায় সুদ-সহ লোন শোধ করতে বাধ্য হয়। বাম আমলে স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলি সরকারের সক্রিয় সহায়তা পেয়েছিল - ঋণ শোধের জন্য কারোর ঘটি বাটি বিক্রি করতে হয়নি - তাই ২০১১ সালে গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ এবং সদস্য সংখ্যা ছিল ১ কোটির বেশি যার ৯০ শতাংশই ছিল মেয়েরা।
মেয়েরা সেদিন আত্মমর্যাদা আর অধিকারে গৌরী শৃঙ্গের উচ্চতা ছুঁয়েছিল। ৩৩ শতাংশ আসনে ঠিকভাবে নির্বাচিত হতে দিয়ে বাম সরকার সমাজের এক প্রকাণ্ড অপ্রচলিত শক্তিকে অবারিত করেছে। মেয়েরা সাক্ষর ও শিক্ষিত হয়ে নিজেদের সমাজ চেতনায় বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মাঠের কাজ আর ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারে আর্থিক স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরতা আর শিক্ষার রসায়নে বাংলায় জন্ম নিয়েছিল এক নতুন নারী সমাজ।
বাম আমলে বাংলার এই সাফল্যের সিংহভাগের দাবিদার গ্রামের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গান্ধীজি পঞ্চায়েতরাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিশ্বকবি গ্রামোন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এক সময়ের চণ্ডীমণ্ডপের গ্রাম সমস্যা সমাধানের দুর্বল প্রচেষ্টার স্রোতকে পল্লী উন্নয়নের খাতে বইয়ে ছিলেন, কিন্তু তা ব্যপ্ত হয়নি। বামফ্রন্ট তাঁদের সেই ভাবনা ও প্রয়াসকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করে, গ্রামের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষের নিজের সরকার গঠন ও শাসনের অধিকার দিল, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর দৃঢ় ও উদাত্ত ঘোষণায় - ‘‘সরকার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নয়, পরিচালিত হবে গ্রাম থেকে।’’
বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অবিস্বরণীয় ঐতিহাসিক রূপ দিয়েছিল। ভূমিসংস্কার যেমন গ্রামীণ মানুষের সম্মানজনক আয়-উপার্জনের রাস্তা তৈরি করেছে, তেমনি ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায় সমৃদ্ধ করেছে। নিজেদের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা-ভালবাসা-নিষ্ঠা আর সততা দিয়ে গ্রামের ভিতর ও বাইরের রূপ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। তাই গ্রামে ফিরে এসেছিল ছায়াসুনিবিড়তা। গ্রাম হয়ে উঠেছিল সুখ ও শান্তির নীড় - সম্প্রীতির নিশ্চিন্ত নিবাস আর ঐক্য ও সংহতির অস্ত্রে, শত্রুর দুর্ভেদ্য দুর্গ। গ্রাম সেদিন দেঁতো হাসি নয় উচ্ছল হাসি হেসেছে, আনন্দে চাষ করেছে, হাঁপর টেনেছে, মাছ ধরেছে, আনন্দে গান গেয়েছে নগর কীর্তন করেছে, আজানের সুরে গলা মিলিয়েছে - ভেঙে দিয়েছে সম্মিলিত ক্রোধে দুর্নীতি আর প্রতিক্রিয়াশীলের কর্কশ হাত - ভেঙেছে তাদের দুষ্ট চক্র।
আজ মমতা সরকার নিজে দুর্নীতির বিষে আপাদমস্তক বিষাক্ত হয়ে বিষিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি, করপোরেশন এবং সরকারের থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের সমস্ত অঙ্গ। মানুষের কোটি কোটি টাকা লুট করে এই সব সরকারের চ্যালা-চামুণ্ডারা টাকার দৈত্য দানব হয়েছে! এই লুটেরাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে - পঞ্চায়েতে হবে যার শুরু।
দুর্নীতি শুধু নৈতিকতার প্রশ্নই নয় - দুর্নীতি মানে যোগ্যপ্রার্থীকে বঞ্চিত করে চাকরি বিক্রি, দুর্নীতি মানে মিড ডে মিলে নির্দিষ্ট ব্যয় বরাদ্দে শিশুর খাদ্য কম কিনে শিশু পুষ্টি চুরি করা - দুর্নীতি মানে একই বরাদ্দ অর্থে সরকারি ভবন, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরির জন্যে নিম্নমানের জিনিস কিনে, জনগণের সম্পত্তির বিনাশ নিশ্চিত করা - দুর্নীতি মানে আবাস যোজনার টাকা আবাসহীনকে না দিয়ে ঘনিষ্ঠজনকে দেওয়া এবং নিজের পকেট ভারী করা। অর্থাৎ শেষ ব্যাখ্যায় দুর্নীতি মানে জনগণকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা - হকের পাওনা লুট করা - তার অর্জিত অধিকার লুট করা।
মানুষ লুটেরাদের চিনতে পারেনি গোড়া থেকেই। তাই, ১৯৭৮-এ গড়া ‘মানুষের পঞ্চায়েত’, এখন লোভী শকুনিদের পঞ্চায়েত হয়ে উঠেছে - চোরেদের-খুনীদের আস্তাবলে পরিণত হয়েছে আজ। তা ভাঙতে হবে ৮ জুলাই। গ্রামের গরিবের জীবন-যন্ত্রণার শরিক, তাদের দিনযাপনের দাবিগুলিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, অগ্রাধিকার দিয়ে লড়াইয়ে, গ্রামের নব্যধনীচক্রের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে আপসহীন যুদ্ধে বামেদের যে ঘাটতিতে, গ্রাম-জনতার মুখরিত সখ্য বামেরা হয়তো হারিয়েছে কিছুটা, তা পুনরুদ্ধারে বামসেনাদের ঠিকানা হোক গ্রাম। আবার মানুষের সরকার গড়তে গ্রামীণ জনতা, যারা বাংলার ৭২ শতাংশ, তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৮ জুলাই, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের স্থপতি জননেতা জ্যোতি বসুর জন্মদিনে, বুকভরা সাহসে চোর-ডাকাত-খুনী-লুটেরাদের হাত থেকে পঞ্চায়েত উদ্ধার করে নিজেদের হারানো অধিকার ও গৌরব প্রতিষ্ঠা করে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে।
অধিকার কেড়েই নিতে হয়। বিনা বাধায় তা পাওয়া যায় না। ৮ জুলাইও নয়। কারণ মনোনয়ন পর্ব আগাগোড়া রক্তে ভেসেছে। এই রক্তনদী পেরিয়েই অধিকারের মঞ্জিলে মানুষকে পৌঁছতে হয় এবং হয়েছে। দুর্বৃত্তরা ভীরু কাপুরুষ, ওরা প্রাণ কাড়ে। বাম ও মানুষের মিলিত শক্তি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। আগামী পঞ্চায়েতে প্রাণের জোয়ার আনতে, বামপন্থীরা গ্রামে গ্রামে প্রাণ জাগাতে আজ প্রস্তুত হচ্ছে। হুঁশিয়ার রক্তপায়ী লুটেরারা আজ কিন্তু - কোটি মনের ঘৃণার জ্বালা অগ্নিগিরির বুকে।