৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
এবারের নির্বাচনী লড়াই আগামী বড়ো লড়াইয়ে মানুষের আস্থা গড়ে তুলবে
গৌতম ঘোষ
২০১১-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর পরিস্থিতি তৈরি করাটা লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নির্বাচনের ফলাফলের সঠিক প্রতিফলনের যে লড়াই তাকে সামনে রেখে অনেকগুলি লড়াই থাকে, সে লড়াইগুলিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বীরভূম জেলা আমাদের রাজ্যে গরিব জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম। বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। তৃণমূলের আমলে লুটের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বীরভূম। পাথর, বালি, গোরু প্রভৃতি বেনিয়মের পাচার হওয়ার কারণে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব থেকে রাজ্য নেতৃত্ব সবার রোজগারের উৎস। তৃণমূলের অনৈতিক রোজগারের বিষয়ে এই জেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই লুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন-সন্ত্রাসের কেন্দ্র হচ্ছে বীরভূম।
২০১৯সালে লোকসভা ও ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের ফলাফলকে সামনে রেখে সংবাদ মাধ্যমের বড়ো অংশ যেভাবে বিজেপি-তৃণমূল বিরোধী শক্তি, বিশেষত বামেদের অপ্রাসঙ্গিক করার প্রচার শুরু করে এবং আদিবাসী-তপশিলি জাতির মানুষকে যেভাবে বিজেপি এবং সংখ্যালঘু মানুষকে তৃণমূলের স্থায়ী সমর্থক হিসাবে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, সেখানে বীরভূম জেলায় লড়াই-আন্দোলন (পঞ্চায়েত নির্বাচন সহ) কিছুটা হলেও উদ্যেশ্যমূলক প্রচারকে দুর্বল করেছে।
গত বেশ কয়েক মাস যাবত আমাদের জেলায় তৃণমূল এবং বিজেপি-র বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেসের লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার কারণে মানুষের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করার পরিবেশ তৈরি করেছিল। সেই কারণে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের বাইরে বামেদের নিয়ে আমাদের একসাথে লড়াইয়ের কাজটি কিছু সমস্যা থাকলেও সহজ করে দিয়েছে। কয়েকটি ব্লকের লড়াই বিশেষভাবে উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।
মহম্মদবাজার ব্লকজেলাসহ সারা রাজ্যে খোলামুখ কয়লাখনি ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এস সি ২৬.৬২ শতাংশ,এস টি ১৮.৯ শতাংশ, সংখ্যালঘু ৩১.২৯ শতাংশ সহ এখানে বামফ্রন্ট গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলাপরিষদে শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি জায়গায় প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যেকটি জিপি-তে লড়াইয়ের পরিস্থিতি আছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি এই ব্লকে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। তৃণমূল সেখানে ভোট লুট করার মতো অবস্থায় নেই। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা মামলা ও অন্যান্যভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে পাথর খাদানের কয়েকজন মালিককে বুথ ভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেকোনোভাবে বুথে জেতার জন্য। তারাই তৃণমূলের পতাকা লাগাচ্ছে। গ্রামের লোক তাদের সাথে নেই। তৃণমূলের নেতাদের সেখানে দেখা যাচ্ছে না।
একইভাবে রাজনগর ব্লকে এস সি ৩৪.৯ শতাংশ, এস টি ১৬ শতাংশ,সংখ্যালঘু ১৪.২৭ শতাংশ। সেখানে লড়াইয়ের মানসিকতা আছে এবং গরিব এসসি, এসটি অংশের মানুষের আমাদের পক্ষে ঢল আছে। সেখানেও তৃণমূলীরা ভোট লুটের পরিকল্পনা করতে বেগ পাচ্ছে।
আবার খয়রাশোল ব্লকের দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, যেখানে মিথ্যা মামলা ও সন্ত্রাসের ফলে ২০২০ সাল অবধি প্রকাশ্য কাজ করার পরিস্থিতি ছিল না। সেখানে লড়াইয়ের পরিস্থিতি গড়ে উঠেছে। এখানে এস সি ৩৫.৫ শতাংশ, এস টি ১.৮ শতাংশ, সংখ্যালঘু ২৪.৩ শতাংশ।
নলহাটি-১ ব্লকে এস সি ৩৬.০২ শতাংশ, এস টি ৪.৯৯ শতাংশ, সংখ্যালঘু ৪৬.৬৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে সেখানে তৃণমূলের বাধা ও সংঘর্ষ প্রতিরোধ করে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। হীরু লেট যিনি বোমের আঘাতে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তিনি এবার স্বতঃস্ফূর্তঃভাবে পার্টির প্রার্থী হয়েছেন। এবারে ওই ব্লকে লড়াই আরও জোড়দার।
নলহাটি-২ ব্লকে এস সি ২১.৩০ শতাংশ, এস টি ০৪ শতাংশ, সংখ্যালঘু ৭০.১ শতাংশ। ২০১৩সালে এই ব্লকে জেতার পরেও তৃণমূলের বাধায় ২০১৮ সালে নমিনেশন ফাইল জমা করা যায়নি। এবছরে ওখানে জেতার জন্য লড়াই হবে। এছাড়া যে বিষয়টি বীরভূম জেলায় লড়াইয়ের আশা জাগাচ্ছে তা হলো, ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতৃত্বের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাচনে প্রার্থী এবং কোথাও কোথাও প্রচারে তারাই সব থেকে অগ্রণী বাহিনী হিসাবে কাজ করছে। কয়েকটি ঘটনা বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার কারণ আছে। বোলপুর শ্রীনিকেতন ব্লকে ধান্যসাড়া গ্রামে সিপিআই(এম)’র প্রার্থীদের তৃণমূলের গুন্ডা বাহিনী ভয় দেখায় এবং প্রার্থীপদ তুলে নেওয়ার সময় বেধে দেয়। ওখানকার সিপিআই(এম)-র কর্মীরা গোটা গ্রামের সভা ডেকে ঘটনাটি বলে, জানতে চায় তারা প্রার্থীপদ তুলে নেবে? নাকি নির্বাচনে লড়বে? গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেয় প্রার্থীপদ তোলা হবে না। প্রার্থীদের পাহারা দেবে গ্রামবাসীরা। লাভপুর ব্লকের খাগরাডাঙায় সোমা হাঁসদা ও মনসা হাঁসদা তাদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করবে না এবং গুন্ডা বাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করবে না বলে জিদ ধরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের লড়াকু কর্মীদের চিনিয়ে দিয়েছে।
তাই এই লড়াই এবং ৮ ও ১১ই জুলাইয়ের লড়াই আগামীদিনের বড়ো লড়াইয়ে গরিব মানুষের আস্থা গড়ে তুলবে - এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে।