E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০

পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ মুর্শিদাবাদ

সন্ত্রাসের আগল ভেঙে জবাব দিতে প্রস্তুত গ্রাম

অনির্বাণ দে


সন্ত্রাসের আগল ভেঙে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য প্রস্তুত গ্রাম। তৈরি মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা থেকে জলঙ্গি, পলাশী থেকে লালগোলা। তৃণমূলের ভরসা শুধুই পুলিশে। মনোনয়নপর্ব থেকেই এবারও পঞ্চায়েত দখলের পরিকল্পনা ছিল তৃণমূলের। কিন্তু মানুষের মেজাজ দেখে সাহস পায় নি তৃণমূল।

মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রথম দিনই রানিনগর ১ ব্লকের মানুষ তৃণমূলের বাহিনীকে দৌড় করিয়েছে। মনোনয়ন প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতে এসেছিল তৃণমূল। নেতাদের ফিরতে হয়েছে গাড়ি, বাইক ফেলে রেখে।

ডোমকলের বাগডাঙায় নির্বাচনী প্রচার চলছে।

পরেরদিন একই ঘটনা ঘটে ডোমকল ব্লকে। সেখানেও মনোনয়নে বাধা দিয়েছিল তৃণমূল। মারধর করা হয় দুই সিপিআই(এম) কর্মীকে। ব্লক অফিসের বাইরে ছিল তৃণমূলের সমাজবিরোধীদের জমায়েত। বারবার পুলিশকে বলাতেও কাজ হয় নি। তারপর নিজেদের পার্টি অফিস থেকে বেড়িয়ে আসেন সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের কর্মীরা। রাস্তায় নেমে ডোমকলের মানুষ সরিয়ে দেয় তৃণমূলের জমায়েত। সেদিন পালানোর পথ পায়নি তৃণমূল। ডোমকল হাসপাতাল চত্বরে এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকে বন্দুক সহ গ্রেফতারও করে পুলিশ। এরপর তৃণমূল আর কোথাও মনোনয়ন রোখার সাহস পায়নি।

চেষ্টা হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর। কিন্তু তাতে হালে পানি পায় নি তৃণমূল। গ্রামের মানুষ ঠিক করেই নিয়েছেন তৃণমূল, বিজেপি-কে হারাতে হবে। তাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে এসে একাধিকবার প্রতিরোধের মুখে পড়েছে তৃণমূলের সমাজবিরোধীরা, নেতা-কর্মীরা।

নির্বাচনী প্রার্থী, সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় হুমকি দিয়েছে পুলিশ। কাজ হয়নি তাতেও।

নির্বাচন আসতেই তৃণমূলের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে সশস্ত্র হামলা, বোমাবাজি। মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রথম দিনেই তৃণমূলের হাতে খুন হয়েছেন কংগ্রেস কর্মী, পরিযায়ী শ্রমিক ফুলচাঁদ শেখ। মনোনয়নের শেষ দিন পাঁচ গ্রামে বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়েছিল তৃণমূল নেতারা। সেখানে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে মৃত্যু হয় তৃণমূল কর্মী মেহেরুল্লা শেখ-এর। বেলডাঙায় বোমা বাঁধতে গিয়ে খুন হয়েছে এক তৃণমূল কর্মী, দুষ্কৃতী।

হিংসার উদাহরণ থেকেই পরিষ্কার গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল রাখতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস।

কোন পঞ্চায়েত? গ্রামের মানুষের কথায় ‘লাঠির পঞ্চায়েত’।

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল প্রহসন। সেই সময় মুর্শিদাবাদ জেলার দায়িত্বে ছিলেন অধুনা বিজেপি, সেই সময়ের তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা শুভেন্দু অধিকারী।

২০১৩ সালেও মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফল করে বামফ্রন্ট। জেলা পরিষদ দখল করেছিল কংগ্রেস।

কিন্তু ২০১৬ সালে জেলায় তৃণমূলের পঞ্চায়েত তৈরির দায়িত্ব নেন শুভেন্দু অধিকারী। শুরু করেন সন্ত্রাস, কেনা বেচার রাজনীতি। ২০১৬ সালে জেলা পরিষদ সহ বেশিরভাগ পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি অনৈতিকভাবে দখল করে তৃণমূল। ২০১৮ সালে শুভেন্দু অধিকারীর তদারকিতে নির্বাচন হয় মুর্শিদাবাদে। সেই পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল তৃণমূলের অবাধ লুটের ভিত্তিস্থাপন। সেই শুভেন্দু অধিকারী বর্তমানে বিজেপি দলের নেতা। কাজেই পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই বিজেপি’রও।

জেলায় কী উন্নয়ন হয়েছে? ৫ বছরে জেলা পরিষদ কী কাজ করেছে? পঞ্চায়েত কত কাজ করেছে - এই সব প্রশ্নের উত্তর নেই তৃণমূলের কাছে।

তৃণমূল কংগ্রেস সাধারণ মানুষকে বলছে, তৃণমূলের সরকার চলে গেলে সমস্ত ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও বামফ্রন্ট প্রার্থীরা সাফ জানিয়েছে, ভাতা বন্ধের কোনো প্রশ্নই নেই। বরং পঞ্চায়েত থেকে কাটমানির পান্ডাদের সরিয়ে দিলে দালাল মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত হবে গ্রাম পঞ্চায়েত।

সেই লক্ষ্যেই গ্রামে গ্রামে চলছে প্রচার। জেলার বড়ো অংশে নিজেদের মধ্যে আসন সমঝোতা করে লড়ছে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস।

বিপদ বুঝে সুর বদলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের। এখন পুলিশের উপরেই নির্ভর করছে তৃণমূল কংগ্রেস। জেলাজুড়েই রাতের অন্ধকারে সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের বাড়ি যাচ্ছে পুলিশ। জলঙ্গিতে এই কাজ করতে গিয়ে গণরোষের আঁচ পেয়েছে পুলিশ।

আসলে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়, পুলিশ ও প্রশাসনের অপদার্থতার বিরুদ্ধেও এই লড়াই।

বামফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থীদের প্রচারে উঠে আসছে গ্রাম পঞ্চায়েত দুর্নীতিমুক্ত করার আহ্বান। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি করছেন গ্রামের মানুষই। সেই দাবিই জুড়ে যাচ্ছে জনগণের স্লোগানে।

মুর্শিদাবাদে প্রায় ১৫ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক আছেন। তার মধ্যে অধিকাংশই জঙ্গিপুর মহকুমায়।

১৯ ফেব্রুয়ারি খোদ সাগরদিঘিতে দাঁড়িয়েই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন অভিষেক। তখন ছিল সাগরদিঘির উপনির্বাচন। বিড়ি মালিক, জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান, শিব বিড়ির মালিক, জঙ্গিপুরের বিধায়ক জাকির হোসেন সেই সময় বসেছিলেন মঞ্চেই। মঞ্চ থেকে নিজেকে এক কথার ছেলে বলে দাবি করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘৯০০ বিড়ি বাঁধলে ১৬৫ টাকা আর হাজার বিড়ি বাঁধলে দেওয়া হয় ১৭৮ টাকা। নির্বাচনের পর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে যাতে ১৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩০-২৪০ টাকা করা যায়, সেটা দেখব’’। তবে অভিষেকের সভার পর পাঁচ মাসেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এক টাকাও মজুরি বাড়েনি বিড়ি শ্রমিকদের। সম্পদ বেড়েছে বিড়ি মালিকদের। এর জবাব দিতেই মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে কাবিপুর থেকে পঞ্চায়েত ভোটে লড়ছেন বিড়ি শ্রমিক টুম্পা মণ্ডল, পুজা মণ্ডল, রাকিয়া খাতুন, জাবেদা বিবিরা। বিড়ি শ্রমিক রাকিয়া খাতুনের কথায়, ওদের না হয় মন্ত্রী, বিধায়ক আছে, আমাদের কথা বলার জন্য তাই পঞ্চায়েতেই লড়ছি। কথা বলছেন বিড়ি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে। বামফ্রন্ট প্রার্থীদের প্রচারে উঠে আসছে ফসলের লাভজনক দামের দাবি, গ্রামের উন্নয়নের জন্য নিয়মিত গ্রাম সংসদের দাবি, ধর্মনিরপেক্ষ পঞ্চায়েতের দাবি। তবে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হলো, তৃণমূলের দুর্নীতি আর দুর্নীতির পঞ্চায়েত আগলে রাখতে তৃণমূল ও পুলিশের সীমাহীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই। ভোট যতো এগিয়ে আসছে বাড়ছে পুলিশের সন্ত্রাসের মাত্রা। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস প্রার্থীদের বাড়িবাড়ি হামলা করছে পুলিশ। তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়। তবে, গণপ্রতিরোধের মেজাজ টের পেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটছে পুলিশ। যেমন ঘটেছে জলঙ্গিতে। এবার লড়াই ঠান্ডা মাথায় বুথ রক্ষার, বলছেন গ্রামের মানুষই। তারাই পথ দেখাচ্ছেন পঞ্চায়েতের লড়াইয়ে।