৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
তৃণমূল শাসন থেকে পরিত্রাণ চাইছেন মানুষ
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ৮ জুলাই অবাধ নিরপেক্ষ ভোট হলে উত্তর ২৪ পরগনায় পঞ্চায়েতে পালাবদল ঘটতে পারে এবার। বামফ্রন্টের বুথস্তরের সভা, মিছিলকে কেন্দ্র করে খেটে খাওয়া মানুষের অনুভবে তেমনই ইঙ্গিত মিলছে। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি আর অপদার্থতায় ক্ষোভে ফুটছেন জেলার মানুষ। পরিত্রাণ চাইছেন তাঁরা। আমফানের বরাদ্দ চুরি এবং রেগার কাজের টাকা না পেয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ ফিরছেন লালঝান্ডায়। জেলায় সিপিআই(এম)’র ডাকে একাধিক সুবিশাল জনসভা প্রমাণ করেছে মানুষ জাগছেন। তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে বামফ্রন্ট কর্মীরা এখানে লড়াই করছেন মাটি কামড়ে। প্রতিদিন লালঝান্ডার প্রার্থীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। লিফলেট পৌঁছে দিয়ে বলেছেন লুটেরাদের পঞ্চায়েত থেকে সরিয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার দায়বদ্ধতার কথা। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের ৫৭টি আসনের মধ্যে কুড়িটি আসনে বামফ্রন্ট জয়ী হয় এবং ৬টা পঞ্চায়েত সমিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। চল্লিশ শতাংশ পঞ্চায়েতে জয়ী হয়েছিল বামফ্রন্ট। এই পরিস্থিতি দেখে ২০১৮ সালে তৃণমূল পুলিশ প্রশাসন এবং সমাজবিরোধীদের নিয়ে ভোট লুটের মধ্য দিয়ে সব দখল করার পথ নেয়।এই জেলায় এবার তৃণমূলের কাঁটা নির্দল প্রার্থীরা। তিনটি স্তরেই বহু নির্দল প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশ দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে চুরি, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ আনছে। তাই অধিকাংশ আসনেই তৃণমূল নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। মনোনয়ন জমার পরেও চলছে ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া এবং তা প্রতিরোধের নানা ঘটনা। যেমন সন্ত্রাস কবলিত হিঙ্গলগঞ্জের যোগেশগঞ্জে ২১৮ নম্বর বুথের সিপিআই(এম) প্রার্থী পূর্ণিমা মণ্ডলের বাড়িতে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে চড়াও হয় মদ্যপ তৃণমূলীরা। পূর্ণিমা মণ্ডল, তাঁর স্বামী এবং ভাসুর নিমেষে রুখে দাঁড়াতেই দৌড়ে পালায় ‘সততার প্রতীকে’র ভাইয়েরা। এই ঘটনা সাড়া ফেলে দেয় অঞ্চলে। আবার গোবিন্দকটি গ্রামের বামফ্রন্ট প্রার্থী চন্দনা মণ্ডলকে খুন করতে চেয়েছিল তৃণমূলীরা। মাথায় আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হন চন্দনা। ঠিকমতো সুস্থ না হয়েই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গ্রামে ফিরে হাট সভার প্রচার শুরু করেন এই লড়াকু নেত্রী।অভিযোগ, হিঙ্গলগঞ্জের দু'নম্বর ব্লকের কালিতলায় প্রকৃত প্রাপক গরিব মানুষদের এড়িয়ে তাঁর আইডি কার্ড টাকা নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে দোতলা, তিনতলা বাড়ি আছে এমন মানুষদের হাতে। এমনকী টাকা না দিয়ে জব কার্ডে জবরদস্তি করে বকেয়া টাকা শোধ বলে লিখে দেওয়া হচ্ছে এখানে। সন্দেশখালি ১ এবং ২ ব্লকে হাড়োয়া এবং মিনাখা, বারাসাত দুই ব্লকের সব আসনে না হলেও জেলায় অন্য সব জায়গায় মনোনয়ন জমা করেছেন বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ প্রার্থীরা। ব্যাঘ্র প্রকল্পের লাগোয়া শামসের নগরে পরিবেশ আইন এবং হেরিটেজ আইন লঙ্ঘন করে মমতা ব্যানার্জি বনবিবির যে মন্দির করছেন তা নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ রয়েছে। সেখানে বাইক বাহিনীর তাণ্ডব সত্ত্বেও প্রচার চলেছে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের। রয়েছে প্রতিরোধের অন্য কাহিনিও। বসিরহাট পুরসভার লাগোয়া গোটরা পঞ্চায়েত এলাকায় এতদিন লাল পতাকা টাঙানো যেত না, সেখানে এখন উলট পুরান। বসিরহাট থেকে তালপুকুর যাওয়ার রাস্তার দু’ধারে লালঝান্ডা আর ফ্লেক্স নিঃশব্দে ঘোষণা করছে বদলে গিয়েছে সমীকরণ। কারণ তৃণমূলের কোনও পতাকাই নেই সেখানে। সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা গাছা আকাড়পুর, পানিতর যেখানে তৃণমূলের ভোট ম্যানেজার হিসেবে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত সোনা পাচার-গোরু পাচারের কুখ্যাত বারিক বিশ্বাস ও তার দলবল। সেখানে সিপিআই(এম)’র মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ ছিল এতদিন, এখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথসভা থেকে বাড়ি বাড়ি ভোটপ্রচার করছেন পার্টি কর্মীরা।
স্বরূপনগর মালঙ্গাপাড়ায় নির্বাচনী মিছিল।
ছবিঃ প্রবীর দাস
জেলার বনগাঁ মহকুমায় সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট প্রার্থীরা প্রচারে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন মানুষের কাছে। তৃণমূলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে মানুষ বিজেপি প্রার্থীদের বিকল্প মনে করেছিলেন, তাদের দ্রুত মোহভঙ্গ হয়েছে। জীবন জীবিকা, নাগরিকত্ব সহ কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকায় বহু প্রশ্ন তাদের মনে। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ বিজেপি-কে সরিয়ে লালঝান্ডাকেই নিরাপদ মনে করছেন তারা। অন্যদিকে প্রশাসন চাইছে তৃণমূলকে সাহায্য করতে, কিন্তু বামপন্থীদের কার্যকর প্রতিরোধ প্রশাসনকে বেগ দিতে পেরেছে অনেকটাই। ভূমিস্তরে সক্রিয় সিপিআই(এম) কর্মীদের অনেকেকেই হুমকি-ধমক দিয়ে কাজ না হওয়ায় তাঁদের কয়েকজনকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করে তৃণমূল এবং প্রশাসন। কিন্তু মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে বানচাল করে দিয়েছে এই পদক্ষেপ। হাসনাবাদে জেলা পরিষদের বামফ্রন্ট প্রার্থী জিতবে বলে আশাবাদী এলাকার মানুষ। চক পাটলি খানপুর, বরুণহাট, লঞ্চঘাট এসব এলাকায় ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে বামফ্রন্ট কর্মীরা পথে নামার পর থেকেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে তৃণমূলীরা। দিনকয়েক আগে সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী, পার্টি নেতা পারভেজুর রহমান, ময়ূখ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সুবিশাল মিছিলের দৈর্ঘ্য মানুষকে সাহস যুগিয়েছে। জেলায় পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের তিনটি জনসভা এবং মিছিলে প্রান্তিক এলাকা থেকেও মানুষ এসেছেন শুনতে, বুঝতে, জানতে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার লড়াইয়ের দিশা কী। বসিরহাট-২ ব্লকের ন’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের জমিতে জল আটকে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও যার সমাধান করতে পারেনি তৃণমূল। মেছোঘেরির নোনা জল চাষের জমিতে ঢোকা, সংস্কারহীন খাল সব মিলিয়ে এখানকার কৃষিজীবী মানুষ জীবিকার অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। চাষের জমি দিনে দিনে অকেজো হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁরাই নেমেছেন পথে। এর পাশাপাশি তিতুমীরের বাদুড়িয়া, খাদ্য আন্দোলনের শহিদ নুরুল ইসলামের স্বরূপনগর সর্বত্রই লালঝান্ডার চাহিদা বাড়ছে। জেলার প্রায় সর্বত্র চাহিদা বাড়ছে লালঝান্ডা এবং লালঝান্ডাওয়ালাদের। তাঁদের নেতৃত্বে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার ভার দিতে এবার এককাট্টা জেলার মানুষ।