E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০

পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ দক্ষিণ ২৪ পরগনা

মানুষ পঞ্চায়েত ভোটে জবাব দিতে চান তৃণমূলকে

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়


‘বাড়িতে বাড়িতে তোমরা এলেই দুটো কথা প্রাণ খুলে বলতে পারি’। পঞ্চায়েত ভোটে লালঝান্ডা নিয়ে প্রচারে আসা বামফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক প্রার্থী ও কর্মীদের, প্রকাশ্যেই একথা বলছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মানুষ। দুই ফুলের ঢলাঢলি দেখে তাঁরা বিভ্রান্তি কাটিয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছেন ওঁদের থেকে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তাই মনোনয়ন পর্বে সন্ত্রাস নামিয়ে এনেও গণপ্রতিরোধের ভয়ে চাপা অস্থিরতা কাজ করছে তৃণমূলের নিচুতলায়। বামফ্রন্ট প্রার্থীরা সকাল থেকেই যেমন বাড়ি বাড়ি প্রচারে বেরিয়ে ভোটারদের প্রশ্রয় পাচ্ছেন তেমনই বিকেলে এবং সন্ধ্যাবেলায় একদিকে ছোটো-বড়ো পথসভা-জনসভা চলছে, অন্যদিকে পাড়ার মিছিলে, বুথসভায় বাড়ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এখন পুলিশ থাকা সত্ত্বেও ভাঙড়-১ ব্লকে আইএসএফ কর্মীর মৃত্যু ক্ষোভের আগুনে ঘি‍‌ ঢেলেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে।

পরিস্থিতির কীসের পরিবর্তন আর কেনই বা পরিবর্তন? বেলাগাম চুরি আর সীমাহীন লুঠ ঠেকাতে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার আহ্বান কার্যকর করতে চাওয়ার ডাক মানুষের মনে ধরেছে। তাই ভোট গ্রহণের দিন যত এগিয়ে আসছে তৃণমূল বুঝতে পারছে পায়ের তলার মাটি সরে গিয়ে খাদ তৈরি হয়েছে।

মগরাহাটে নির্বাচনী সভায় বলছেন সুজন চক্রবর্তী।

জেলার গ্রাম-শহর কোথাও কোনও কাজ নেই মানুষের। রেগায় গত দেড় বছর কোনো টাকা পাওয়া যায় নি। ২০২১ সালেও যারা কাজ করেছে তারা শেষ চার মাসের টাকা পায়নি এখনো পর্যন্ত। একটাও নতুন কারখানা হয়নি। ডায়মন্ডহারবারে ‘ফ্রি-ট্রেড জোনে’ বাম আমলে ২০১০ সালেও ১৪ হাজার লোক কাজ করত, এখন মাত্র আড়াই হাজার। সেঞ্চুরি আর গ্রিনপ্লাই বাদ দিয়ে একটা কারখানা খোলা নেই। জেলার, বিশেষ করে মহেশতলা এলাকার দরজি শিল্প মন্দার সম্মুখীন। লেদার কমপ্লেক্স, আইটি সহ অন্যান্য সার্ভিস সেক্টরে এক সময় প্রায় এক লক্ষ লোক কাজ করত, সেখানে এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র কুড়ি হাজারে। কর্মচ্যুতদের অনেকেই বেকার। বড়ো অংশ, প্রায় ১২ লক্ষেরও বেশি, এই জেলার মূলত গ্রামীণ এলাকা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক। কারণ পঞ্চায়েত কোনো কাজ দিতে পারেনি। ভাইপো সাংসদের ভেঁপু যাত্রায় মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। এদিকে ফলতা আর বজবজ-১ ব্লকে শাসকদলের সন্ত্রাসে বহু আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের দখলে।

এই জেলায় কৃষিজীবী মানুষ মূলত ধান আর সবজি চাষ করেন। অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত ধানের দর কুইন্টাল প্রতি ১৯৩০ টাকা হলেও কোথাও সরকার ক্যাম্প করে চাষিদের থেকে কেনেনি। কিনেছে সব ফড়ে-দালালদের থেকে। সরকারের উদাসীনতায় তাই চলেছে ১১০০-১২০০ টাকা দরে অভাবি বিক্রি। সবজির বাজার আগুন। কিন্তু সবজি চাষিদেরও হাতে পয়সা নেই একই কারণে। ভোটের প্রচারে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের কাছে মানুষ এসবেরই প্রতিকার চাইছেন।

স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে এই জেলার মানুষের। জেলার মাত্র ৪ লক্ষ ৫১ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড-এর আওতায়। তিরিশের কম ছাত্র সংখ্যার সরকারি স্কুল যা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার- এই জেলায় তেমন স্কুল প্রায় দেড় হাজার।

এই জেলায় তৃণমূলী পঞ্চায়েতের অসংখ্য চুরির কিছু নমুনা তুলে ধরা যাক। মুড়িগঙ্গা নদীতীরের বাসিন্দাদের হাজারো অভিযোগ। একদিকে নদীর পাড়ের বালি তুলে পাচার হয়ে যাচ্ছে, আর পকেট উপচে পড়ছে শাসকদলের পাণ্ডাদের। আর এক দিকে মাটির বাড়ি আঁকড়ে ধরে কোনোমতে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আর এক দল গরিব, নিরন্ন মানুষ। বান এলেই ভেসে যাবে শত শত পরিবার। সিপিআই(এম) প্রার্থীদের প্রচারে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এসব কথাই উগড়ে দিয়েছেন তেভাগা আন্দোলনের উত্তরসূরিরা।

বুধাখালি, ঈশ্বরীপুর, নাদাভাঙ্গা - প্রভৃতি অঞ্চলে ভাঙন গ্রাস করেছে বাড়িঘর। খরচ দেখানো হয়েছে কিন্তু ব্রিজ কংক্রিট হয়নি। কাকদ্বীপ এলাকার প্রায় ৫০ কিমি নদীবাঁধে কোনও মাটি পড়েনি। উপরন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে মাটি কাটার কাজ। পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে ধ্বংস করা হচ্ছে সুন্দরবনসহ এলাকার ম্যানগ্রোভ, বলছেন গ্রামবাসীরা। নড়বড়ে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে নদীগর্ভে ভিটেমাটি হারানোরা বলছিলেন, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নয়, নদী বাঁধ দাও- আমাদের বাঁচাও।’ একথা শাসক দলকে বা প্রশাসনকে বলাতে তাঁরা কর্ণপাত করেনি।’

ধান কেনা বেচা আয়ের প্রধান পথ কাকদ্বীপের মানুষের। সেখানে ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জলসেচ প্রায় নেই। এলাকায় অন্যতম প্রধান জীবিকা মাছ ধরা। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান কার্যকর না হওয়ায় জলের স্রোত কমে গেছে। ওদিকে তাজপুরে আদানি বন্দরের জন্য জমি নেওয়ায় পোর্ট ট্রাস্ট যে ড্রেজিং করতো-তা হচ্ছে না। ফলে মৎস্যজীবীদের মাছের সন্ধানে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। সেখানে বিপদে পড়ছেন তাঁরা, মিলছে না ভালো মাছও। শুধু তাই নয়, লাভ তেমন না হওয়ায় ট্রলার মালিক কম মজুরি দিচ্ছেন মৎসজীবীদের। এভাবেই রুজি রোজগারের তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পড়ছেন অসংখ্য মৎস্যজীবীও। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রচুর।

একদিকে যখন এই অবস্থা, তখন অন্যদিকে আবাস যোজনার কাটমানি থেকে নির্মল গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম করে শৌচালয় বানানোর জন্য কাগজে সই করিয়ে নেওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভ জেলা জুড়ে। কমিউনিটি টয়লেটের নামে তৃণমূল টাকা তুললেও কোস্টাল এরিয়াতে তার একটিও দিনের আলো দেখেনি বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। অথচ সম্পত্তি বেড়েছে তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধান থেকে সদস্যদের। ভোট যত এগিয়ে আসছে, গ্রামে গ্রামে বাড়ছে এসবেরই আলোচনা। প্রমাদ গুনছে শাসকদল।

ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য নির্বাচন আধিকারিকের কাছে ১১ দফা দাবি কার্যকর করতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে। বামফ্রন্ট নেতা শমীক লাহিড়ী বলেছেন, ভোটের দিন ভোট লুঠের চেষ্টা হলে মানুষ পথে নেমে তার মোকাবিলা করবেন। জেলার মানুষও পাশে থাকবার আশ্বাস দিয়ে প্রতিশ্রুতি চাইছেন বামফ্রন্টের নেতা কর্মীদের কাছে ভোট দেবার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য। কারণ এই ভোট তাঁদের কাছে জবাব নেবার, জবাব দেবার ভোট। মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার ভোট। ‘পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে’।