৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস - বিপন্ন জাতি বিপন্ন দেশ
নিলয়কুমার সাহা
শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং গৈরিকীকরণের অভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড অতিমারীর ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সংসদে বিরোধী রাজনৈতিক দলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সারা দেশে কার্যকর করেছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’। কোভিডের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় - সমস্ত স্তরেই দীর্ঘসময় ব্যাহত হয়েছে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং গবেষণার কাজ। এই বিপর্যয়ে সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যেও উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই কার্যকর হয়েছে ‘অনলাইন শিক্ষাক্রম’। শিক্ষাব্যবস্থার গতি অব্যাহত রাখতে ‘অনলাইন ওপেন বুক’ পরীক্ষা নামক প্রহসনে জন্ম নিয়েছে ডিগ্রিধারীজ্ঞান-বধির এক প্রজন্ম। এই অভাবনীয় ‘জ্ঞান-শূন্যতা’ পূরণের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে, কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা এবং এই নীতি কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সরকারের বেপরোয়া আগ্রাসন দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। নয়া এই শিক্ষানীতির অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার সর্বভারতীয় নীতি নির্ধারক দুটি স্বশাসিত সংস্থা ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ (এনসিইআরটি) এবং ‘দ্যা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ডস কমিশন’ (ইউজিসি)। বিগত ছ’মাস এই দুই নিয়ামক সংস্থা বিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা বিষয়ক যে সব ‘ফরমান’ জারি করে চলেছে তা কল্পনাতীত। ভারতের অস্মিতা ‘বহুত্ববাদ’-এর উপর এমন সুপরিকল্পিত আক্রমণে দিশাহারা জনজীবন।
স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য, সমন্বয়, পঠন-পাঠন, পরীক্ষা এবং গবেষণার গুণগত মানোন্নয়নের উদ্দেশে ১৯৫৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ‘ইউজিসি’। ১৯৫৬ সালে সংসদে গৃহীত আইনানুসারে এটি ভারত সরকারের একটি স্বশাসিত সংস্থার মর্যাদা লাভ করে। ভারতের ‘গবেষণাগারের জনক’ সম্মানে স্বীকৃত স্যার শান্তিস্বরূপ ভাটনগর ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি বিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ক গবেষণা, শিক্ষায় উদ্ভাবনী ভাবনার বিকাশ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ভারত সরকার ১৯৬১ সালে গঠন করে আর একটি স্বশাসিত সংস্থা ‘এনসিইআরটি’। স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে উন্নততর দেশ গড়ার লক্ষ্যে ভারতে ১৯৬৮ এবং ১৯৮৬ সালে প্রণীত দুটি শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে এই দুটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত কোনোপ্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই নয়া এই শিক্ষানীতি পরীক্ষিত ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে বিদ্যালয় স্তরে ৫+৩+৩+৪ ব্যবস্থার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় ৪+১ ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে। উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার এই কাঠামোগত পরিবর্তন ‘পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন’-কে ‘পাবলিক ফিলানটপিক পার্টনারশিপ’ নামক এক কাল্পনিক মোড়কে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এর ফলে ‘শিক্ষার অধিকার’ কেবলমাত্র বিত্তবানের অধিকারে পর্যবসিত হবে। ‘সারভাইবেল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ প্রবচনটি এই শিক্ষানীতির কল্যাণে চরিত্র বদলে হয়ে উঠবে ‘সারভাইবেল অফ দ্যা রিচেস্ট’। নয়া এই শিক্ষানীতির হাত ধরেই পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর উন্মুক্ত শিক্ষার বাজার ভারতে পা ফেলতে চলেছে ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমন্ট’ (এফডিআই), যা এতদিন রুদ্ধ ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই শিক্ষানীতি কার্যকর করার প্রথম শর্ত অর্থাৎ উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণে এফডিআই যে ফাঁকা মাঠে গোল করে সিংহভাগ ভারতীয় শিক্ষার বাজারের দখল নেবে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
নয়া এই শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে সাথে গুণগত পরিবর্তনের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে চলেছে এনসিইআরটি এবং ইউজিসি। ইতিমধ্যে এনসিইআরটি বিদ্যালয় স্তরে পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছে মোঘল সম্রাজ্যের গৌরবগাথা, পর্যায়সারণি, বিবর্তনবাদের মতো গবেষণালব্ধ প্রতিষ্ঠিত সত্য। কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনে এনসিইআরটি কর্তৃক এই পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম সারির গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-র সম্পাদকীয় কলামে এনসিইআরটি অনুসৃত শিক্ষাক্রম সম্পর্কে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তা হলো, ‘ভারত কেন বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলিকে বিদ্যালয় পাঠ্যবই থেকে বাদ দিচ্ছে?’ এই প্রসঙ্গে ওই পত্রিকা দাবি করেছে, ‘ভারতীয় বিদ্যালয় পাঠ্যক্রম নির্ণায়ক সংস্থাকে ব্যাখ্যা করতে হবে কেন তারা মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম থেকে বিবর্তনবাদ এবং পর্যায় সারণি বাদ দিলেন।’
এনসিইআরটি-র এই উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিদ্যালয় পাঠসূচি নির্ণায়ক সংস্থা রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দেশের পঞ্চাশ জন বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবন দর্শন সম্পর্কে পাঠদানের উদ্দেশে যে তালিকা প্রস্তুত করেছে সেই তালিকায় স্থান হয়নি স্বাধীন দেশের প্রথম সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক দুই প্রধানের। এই তালিকায় দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর স্থান না পাওয়া প্রসঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সদর্পে বলেন, ‘নেহরু তো আর দেশের জন্য প্রাণ দেননি।’ দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনও আলোচ্য তালিকায় বিবেচিত হননি। প্রসঙ্গত, ভারতীয় উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ১৯৪৮ সালে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের সভাপতিত্বে গঠিত হয়েছিল ‘রাধাকৃষ্ণন কমিশন’। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পথনির্দেশে এই কমিশনের সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সদ্য প্রকাশিত এই তালিকায় বহু প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের সাথে জায়গা করে নিয়েছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, দীনদয়াল উপাধ্যায়। হিন্দু মহাসভার বিশিষ্ঠ নেতা সাভারকরের এই তালিকাভুক্তির কারণ বর্ণনায় পুনরায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা মহাব্যক্তিত্বের কথা পড়বে না তো কি জঙ্গিদের কথা পড়বে?’
কেবল উত্তরপ্রদেশ নয়, কেবল বিদ্যালয় শিক্ষা নয়, এই আগুনের আঁচ থেকে রক্ষা পায়নি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পাঠক্রমের ‘মর্ডান ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল থট’ শীর্ষক বিষয় থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা’-র স্রষ্টা কবি মুহাম্মদ ইকবালকে। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের সমর্থনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং তিনি নিজেই তাঁর সৃষ্টির কথা বিশ্বাস করতেন না।’ ১৯০৬ সালের ১৬ অাগস্ট ‘সাপ্তাহিক ইত্তোহাদ পত্রিকা’য় প্রকাশিত কালজয়ী এই কবিতাটিতে কবি যে গভীর দেশপ্রেম এবং জীবনবোধের ছবি এঁকেছিলেন তা কি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোদুল্যমানতায় সৃষ্টি করা সম্ভব? একথা সত্য মুহাম্মদ ইকবাল মুসলিম লিগের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবির স্বীকৃতি লাভ করেন। তথাপি স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ উদযাপনের আবহে আসমুদ্র হিমাচল সর্বাধিক-শ্রুত গানের স্রষ্টাকে কি এক লহমায় ভারতবাসীর হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব কেবলমাত্র পাঠক্রম থেকে উৎপাটন করে?
কেন্দ্রীয় সরকার সুপরিকল্পিতভাবে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-কে কাজে লাগিয়ে উচ্চশিক্ষায় দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অছিলায় দীর্ঘসময় সযত্নে লালিত ভারতীয় বহুত্ববাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক জাতি, এক ভাষা, এক দেশ অর্থাৎ ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থান’-এর পটভূমি রচনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অশুভ প্রয়াস বাস্তবায়নে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে চলেছে ইউজিসি। স্বশাসিত এই নিয়ামক সংস্থা ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের অধীন ‘অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশনস্-এর একটি উদ্ভাবনী শাখা হিসাবে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ অর্থাৎ ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের সংবাদ পরিবেশন করে এই জ্ঞানভাণ্ডারের উদ্দেশ্য বর্ণনায় বলে, দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী সাহিত্য এবং কলা, কৃষি, মৌলিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, স্থাপত্য, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি ইত্যদি বিষয়কে ভবিষ্যৎ গবেষণা এবং সামাজিক প্রয়োগের উদ্দেশে সংরক্ষণ এবং প্রচার করতে হবে।
এই শিক্ষানীতির অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ইউজিসি গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে মহাকাব্যের জারণে নিমজ্জিত করে ইতিহাস বিকৃতির পটভূমিতে নিত্যনতুন চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পরিবেশন করে চলেছে। দেশজ ঐতিহ্যশালী সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্য সহ নানাধারার শিল্পকলায় বিদেশি পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করার অছিলায় একবিংশ শতাব্দীতে ইউজিসি-র গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সুপারিশ কি পশ্চাৎপদতা নয়? শিক্ষায় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রদর্শনের নগ্ন রূপ এই প্রথম প্রত্যক্ষ করছেন দেশবাসী। শিক্ষার গৈরিকীকরণের মধ্য দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের যে ‘ব্লু প্রিন্ট’ কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তুত করছে তা বানচাল করতেই হবে, অন্যথায় বিশ্ববন্দিত ভারতীয় ধর্মনিরেপক্ষতার অকাল বিসর্জনে বিপন্ন হবে সমগ্র দেশ ও জাতি।