৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
হিন্দুত্ববাদী ও গান্ধীবিরোধী গীতাপ্রেসকে 'গান্ধী শান্তি পুরস্কার'
সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
গান্ধীজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে 'গান্ধী শান্তি পুরস্কার' দেওয়া হয় সমাজে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর আনার ক্ষেত্রে অহিংস ও অন্য গান্ধীবাদী পদ্ধতি প্রয়োগে সাফল্য দেখাবার জন্য। অতীতে এই পুরস্কার পেয়েছেন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়রেরি, রামকৃষ্ণ মিশন, বাবা আমতে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটু, চিপকো পরিবেশ আন্দোলনের নেতা চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ২০২৩-এ এই পুরস্কার পেয়েছে গীতা প্রেস। গীতা প্রেস ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা ও তার ফ্ল্যাগশিপ পত্রিকা হলো ‘কল্যাণ’। জয়দয়াল গোয়েন্দকা ও হনুমান প্রসাদ পোদ্দার ১৯২৩-এ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে প্রকাশনা সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। মতাদর্শগতভাবে এই প্রকাশনাসংস্থা ও পত্রিকাটি হিন্দুত্ববাদের পক্ষে ও চূড়ান্ত রকমের রক্ষণশীল। বিভিন্ন সময়ে মহাত্মা গান্ধীর অবস্থানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে এই দুটি প্রকাশনা সংস্থা ও পত্রিকাটি এবং সেইসঙ্গে অবশ্যই হনুমান প্রসাদ পোদ্দার।
১৯৩২-এ রামজে ম্যাকডোনাল্ড যখন দলিত বা অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচনকেন্দ্রের ঘোষণা করলেন তখন গান্ধীজি অনশন শুরু করলেন। তারফলে একদিকে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশের নেতাদের মধ্যে মদন মোহন মালব্য, রাজাগোপালাচারিয়া ও হিন্দু মহাসভার বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে, দলিত সমাজের প্রতিনিধি ভিমরাও রামজি আম্বেদকর, মেল্লাই সিন্নে তামবি পিল্লাই রজত ও পান্ডুরং নাথুজি রাজভোজ-এর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। যার ফলশ্রুতি ১৯৩২-এর পুনা প্যাক্ট। সেই একই সময়ে অন্যদিকে গান্ধীজির অনশনের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে এক ব্যাপক নৈতিক অভ্যুত্থান ঘটে। একের পর এক মন্দিরের দরজা দলিতদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বোম্বাইয়ের ছয়টি মন্দিরের প্রবেশদ্বারে একটি বাক্সে কারা দলিত-প্রবেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে সে বিষয়ে মতামত নেওয়া হলো। ২৪,৯৭৯ জন প্রবেশের পক্ষে ও ৪৪৫ জন বিপক্ষে মত দিলেন।
অক্ষয় মুকুল তার ‘গীতা প্রেস অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ হিন্দু ইন্ডিয়া’ বইতে হনুমান প্রসাদ পোদ্দার পেপার থেকে দেখিয়েছেন, পোদ্দার সেই সময়ে গান্ধীজিকে অভিযুক্ত করে তাকেই একটি চিঠিতে লিখেছিলেনঃ আপনার অনশনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বড়ো মাপের দলিত অ্যাজিটেশন দেখা দিচ্ছে। বহু জায়গায় দলিতদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলছে ও মন্দিরে তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। দলিতদের কখনই পিওর বা বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যায়না, যতক্ষণ না তারা স্নান করে শুদ্ধ হচ্ছে, নতুন কাপড় পড়ছে, মদ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে, মাংস খাওয়া ত্যাগ করছে, মৃত গবাদি পশুর মাংস খেয়ে উৎসব করা বন্ধ করছে। চিঠিটিতে পোদ্দার গান্ধীজিকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ যারা এসব মন্দির পরিচালনা করেন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব ধরনের মানুষকে উপাসনালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া ধর্মের স্বাধীনতার চেতনায় হস্তক্ষেপ নয় কি? এটা আমাদের মন্দির ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে। আমরা কি জিজ্ঞাসা করেছি যে, যাদের (দলিতদের) মন্দিরের ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে, তারা সেখানে যেতে চায় কী না? তারা চাইলে তাদের জন্য আলাদা মন্দির তৈরি করবে না কেন? স্পষ্ট বোঝা যায় গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘদিনের পরিচালক হনুমান প্রসাদ পোদ্দার, দলিতদের বিষয়ে মহাত্মার চিন্তাধারার বিরোধী ছিলেন, উচ্চবর্ণের মন্দিরে দলিতদের অনুপ্রবেশের বিরোধী ছিলেন, দলিতদের যাপিত জীবনকে তিনি পিওর বা বিশুদ্ধ মনে করতেন না।
গোরক্ষপুর-এ স্থিত 'গীতা প্রেস' অফিসের মূল প্রবেশদ্বার।
গান্ধীহত্যার পরে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সর্দার প্যাটেল তখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেইসময়ে জয়দয়াল গোয়েন্দকা ও হনুমান প্রসাদ পোদ্দার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন ঘনশ্যামদাস বিড়লা তাদের সহায়তা দিতে সম্মত হননি। স্যার বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা যখন তাদের বিষয়ে দায়িত্ব নেন তখন বিড়লা তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ঘনশ্যামদাস বিড়লা বলেছিলেন, তারা দুজন সনাতন ধর্মের নয়, শয়তান ধর্মের বিস্তার ঘটাচ্ছেন। নাথুরাম গডসে গান্ধীহত্যার বিচারের সময়ে কোর্টে স্বীকার করেছিলেন, তিনি আগে আরএসএস করতেন ও পরে হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। এই দুটি সংগঠনই হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুধর্ম বিপরীতধর্মী। হিন্দুত্ববাদ হলো ঔপনিবেশিক যুগে নির্মিত একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম হলো একটি প্রাচীন ধর্ম। হিন্দুত্ববাদের সূচনা ১৯২৩-এ সাভারকরের লেখা ‘হিন্দুত্ব’ বইটির সূত্রে। সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো হিন্দুত্ববাদ। যারা ভারতে হিন্দুরাষ্ট্রের নামে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতে সবথেকে বড়ো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হলো আরএসএস এবং তার নেতৃত্বাধীন সংঘ পরিবার। মতাদর্শগতভাবে সংঘ পরিবারের লোকজনরা হলেন নাথুরাম গডসের মতাদর্শগত উত্তরসূরি। অক্ষয় মুকুল সিআইডি রিপোর্ট থেকে দেখিয়েছেনঃ ১৯৪৯-এর ১৫ জুলাই আরএসএস’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবার পরে গোরখপুরে একটি জনসভায় আরএসএস’র হিন্দি মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-র তৎকালীন সম্পাদক অটলবিহারী বাজপেয়ী (পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী) নেহরু সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করাকে, গুরুতর (‘ব্লান্ডার’) ভুল বলেছিলেন। কারণ আরএসএস-ই একমাত্র সংগঠন যারা বাস্তবে হিন্দুদের জন্য কিছু করতে পারে। সিআইডি রিপোর্টে বলা হয়েছিলঃ পোদ্দার উক্ত সভায় ‘ডেলিভার্ড এ শর্ট স্পিচ অন সিমিলার লাইনস’। আরএসএস’র সঙ্গে পোদ্দারের যোগাযোগের আরও একটি তথ্য দিয়েছেন অক্ষয় মুকুলঃ ১৯৪৯-এ জেল থেকে ছাড়া পাবার পরে আরএসএস’র পরিচালক ও তাত্ত্বিক গোলওয়ালকরকে স্বাগত জানাবার জন্য বারাণসীতে যে সভা হয়েছিল তার সভাপতি ছিলেন হনুমান প্রসাদ পোদ্দার।
আরএসএস’র ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছেঃ একমাত্র হিন্দু ও পুরুষরা আরএসএস’র সদস্য হতে পারেন। অহিন্দু ও নারীরা নন। গীতা প্রেসও নারীদের পাবলিক ও প্রাইভেট পরিসর পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষে। ১৯২৯-এ ‘চাইল্ড ম্যারেজ রিসট্রেন্ট অ্যাক্ট’-এ বিবাহের বয়স বৃদ্ধি করে নারীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন চোদ্দ ও পুরুষদের ক্ষেত্রে আঠারো করা হয়েছিল। পোদ্দার তার তীব্র বিরোধিতা করে লিখেছিলেনঃ ‘take away a major right of the Hindus and would cause a big blow to believers in the dharmashastras’। তিনি হিন্দু নারী ও মুসলিম পুরুষদের বাক্যালাপের বিরোধী ছিলেন। হিন্দু নারীদের প্রিয় লাক্ষা দিয়ে তৈরি চুড়ি পড়ার তিনি বিরোধী ছিলেন। কারণ তা মুসলিম কারিগররা তৈরি করে। তিনি মুসলিম চালকদের দ্বারা চালিত এক্কা গাড়িতে হিন্দু নারীদের চড়ার, বাড়িতে মুসলিম ভৃত্য রাখার, বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী মুসলিমদের কাছ থেকে কেনার বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে ‘কল্যাণ’ পত্রিকার কালামে পোদ্দার লিখেছিলেনঃ একজন বছর কুড়ির বিধবা নারী, যার একটি সন্তান আছে, তাকে চিঠিতে জানিয়েছেন, মেয়েটির পরিবার তার পুনর্বিবাহ চায়। তার কি করা উচিত? পোদ্দার তাকে জানান, পরিবারের চাপের কাছে তার নতিস্বীকার করা উচিত নয়। তার বর্তমান বৈধব্যের কারণ তার পূর্বজন্মের পাপ।
আমরা যদি গীতা প্রেস প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের দিকে নজর দিই তাহলে দেখতে পাই নারীদের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। ‘গর্ভপাত করানো কি উচিত?’ বইটিতে নারীদের গর্ভপাত করানোর অধিকার কেড়ে নেবার উদ্দেশ্যে, গর্ভপাতকে ‘নৃশংস, অমানবিক ও হিংস্রকার্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে, ‘তা পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করা আমাদের সকলেরই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য’ হিসেবে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১-এ গর্ভপাত আইন সংশোধন করে অবিবাহিত নারীদের গর্ভপাতের অধিকার দিয়েছে। ২০২২-এর ৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয়ের ক্ষত্রেই ২৪ সপ্তাহের কথা বলেছে। সংঘ পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে মনুসংহিতা ও অন্যান্য সংহিতার ভিত্তিতে ভারতের সংবিধান রচনার দাবি তুলেছেন। এই বইটিতেও মনুস্মৃতিকে উদ্ধৃত করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছেঃ ‘ব্রহ্মহত্যায় যে পাপ হয়, গর্ভপাতকারীর তার দ্বিগুণ পাপ হয়। গর্ভপাতরূপী মহাপাপের কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই। এক্ষেত্রে সেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার বিধান আছে।’
‘মাতৃশক্তির ঘোর অপমান’ বইতেও গর্ভপাতের বিরোধিতার পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণেরও বিরোধিতা করা হয়েছে। ‘গর্ভস্থাপন করতে পারা ছাড়া মানুষের কোনও পুরুষত্ব নেই, আর গর্ভধারণ করতে পারা ছাড়া নারীর কোনও স্ত্রীত্ব নেই। যদি পুরুষের মধ্যে পুরুষত্ব না থাকে ও স্ত্রীদের মধ্যে স্ত্রীত্ব না থাকে তাহলে তারা কেবল ভোগী হয়েই থাকবে।’ ‘পরিবার নিয়ন্ত্রণের দ্বারা নারীর মাতৃরূপকে নষ্ট করে তাকে কেবল ভোগ্যা তৈরি করা হচ্ছে।’ আবার হিন্দুভোটের কথা মনে রেখে বলা হচ্ছে ‘বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির সঙ্গে জনসংখ্যার সরাসরি সম্বন্ধ রয়েছে। অতএব যে জাতির জনসংখ্যা বেশি হয় সেই জাতি শক্তিশালী (ভোট-এর শক্তিতে) হয়ে দেশে রাজত্ব করে। ...বর্তমানে পরিবার-নিয়ন্ত্রণ ও ধর্মান্তকরণের ফলে হিন্দুদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। তাহলে রাজ্য কার হবে ও দশা কেমন হবে?’
ভারতের সংবিধানের ৫১ এ এইচ ধারায় বলা আছে, প্রত্যেক নাগরিকের অনেক কর্তব্যের মধ্যে একটি হলোঃ to develop the scientific temper, humanism and the spirit of inquiry and reform। গীতা প্রেস প্রকাশিত বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে বোঝা যায়ঃ বিজ্ঞানশীলিত বীক্ষা, মানবতাবাদ এবং অন্বেষণ ও পুনর্নির্মাণের উদ্দীপনাকে বিকশিত করার চেষ্টার বদলে, তারা ইতিহাসের চাকাকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে, মনুসংহিতার মডেলে নারী ও দলিতদের অবদমিত রাখার পক্ষে মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ একশো বছর ধরে করে চলেছে – যা হিন্দুত্ববাদীদের সামাজিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে চলেছে ও ভারতকে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টিক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে দিতে সহায়তা দিচ্ছে। গান্ধীহত্যার পঁচাত্তরতম বর্ষে নাথুরাম গডসের মতাদর্শ, হিন্দুত্ববাদকে, ব্যাপ্ত করে তোলার কাজ করে চলেছে যে প্রকাশনাসংস্থা, তাকেই 'গান্ধী শান্তি পুরস্কার' দিয়ে, হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার গান্ধীজিকে ও তাঁর নামাঙ্কিত এই পুরস্কারটিকে অসম্মানিত করল।