৬০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৭ জুলাই, ২০২৩ / ২১ আষাঢ়, ১৪৩০
ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুচর বানাতে উদগ্রীব মোদি সরকার
অর্ণব ভট্টাচার্য
মোদির মার্কিন সফরের সময়ে বিক্ষোভ।
নরেন্দ্র মোদির আমেরিকা সফর নিয়ে উচ্ছ্বসিত করপোরেট মিডিয়া মার্কিন প্রশাসনের সাথে ভারতের সম্পর্ক আরও নিবিড় হওয়াকে এক বিরাট সাফল্য হিসেবে তুলে ধরছে। জোট নিরপেক্ষ নীতি থেকে অনেককাল আগেই সরে এসেছে আমাদের দেশ। তা সত্ত্বেও বিদেশ নীতিতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার যে ধারা চলছিল তাকে বিসর্জন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হওয়ার জন্য মোদী প্রশাসনের এই তৎপরতা আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যে ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা তাকেই পুষ্ট করছে। এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রধান বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং এই দেশের ঈর্ষণীয় সামরিক সক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের প্রবল উপস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে একমেরুকরণের যে মার্কিনি প্রয়াস তাকে নানাভাবে প্রতিহত করার ফলে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ভারতকে এই কাজে ব্যবহার করতে তাই তারা উদগ্রীব। আন্তর্জাতিক সীমানা নিয়ে চীনের সাথে ভারতের যে বোঝাপড়ার অভাব মাঝেমধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে তাকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত একত্রে কোয়াড (QUAD) নামক একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে, যা ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নানারকম সামরিক মহড়ায় শামিল হয়েছে। ভারত-মার্কিন যৌথ ঘোষণাপত্রে মার্কিন সেনার সাথে ভারতীয় সেনার যৌথ মহড়া, ভারতের বন্দরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মেরামতির বন্দোবস্ত, উভয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী অফিসার নিয়োগের মতো বিভিন্ন বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই মার্কিন নৈকট্য ভারতের আখেরে কোন উপকারে আসবে? সাম্প্রতিককালে চলমান রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল না কেনার জন্য চাপ দিয়েছিল। তবে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল কেনা ছাড়া ভারতের কাছে কোনো বিকল্প না থাকায় ভারত সরকার মার্কিনিদের এই প্রত্যাশা পূরণ করেনি। তবে এও ভুললে চলবে না যে, অতীতে ইরান থেকে সস্তায় গ্যাস আনবার জন্য পাইপলাইন বসানোর পরিকল্পনা মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই পরিত্যাগ করেছিল ভারত। এই জুলাই মাসে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের শীর্ষ বৈঠক দিল্লিতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই বৈঠককে যেভাবে ভারচুয়াল সভায় পর্যবসিত করল মোদি সরকার তা সঠিক বার্তা দিল না।
বিগত সাত দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নানাভাবে বঞ্চনা করেছে। অতীতে মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ভারতকে সরবরাহ করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি বাধা দিয়েছে। নয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার করে রাশিয়া ক্রায়োজেনিক প্রযুক্তি ভারতকে সরবরাহ করতে পারেনি, ফলে এদেশে মহাকাশ গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার বাইডেন ও মোদীর যৌথ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, মহাকাশ গবেষণায় প্রযুক্তি স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু আদৌ কী হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে ইতিহাস বলছে যে, রাশিয়া চিরকাল মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণায় ভারতকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। ভারতের মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও করেছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র রাশিয়া। সেক্ষেত্রে মহাকাশে মার্কিনিদের স্বার্থসিদ্ধি করায় ভারতের এই আগ্রহ রাশিয়া নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। তবে কেবল মহাকাশ গবেষণা নয় কোয়ান্টাম রিসার্চ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নানা বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণা ও পারস্পরিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে ভারত মার্কিন যৌথ বিবৃতিতে। কিন্তু এই বিবৃতি খুব খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যাবে যে, প্রযুক্তিগত স্থানান্তরের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা এখানে দেওয়া হয়নি। জেনারেল ইলেকট্রিক এবং হিন্দুস্থান এয়ারোনটিক্স লিমিটেডের মধ্যে এফ-৪১৪ জেট ইঞ্জিন মিলিতভাবে তৈরি করার জন্য চুক্তি হয়েছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঢক্কানিনাদ করলেও আসলে জেট ইঞ্জিন ভারতে অ্যাসেম্বলের মাধ্যমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির স্থানান্তর ঘটবে না। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রাশিয়ার জায়গা নেওয়া। তাই ইতিমধ্যেই তিন বিলিয়ন অর্থ মূল্যে মার্কিনি ড্রোন কিনতে ভারতকে বাধ্য করা হয়েছে।সম্প্রতি গুজরাটে মাইক্রন টেকনোলজি নামে একটি মার্কিন বেসরকারি কোম্পানির সেমিকন্ডাকটার কারখানা গড়ে তোলাকে ভারত- মার্কিন নৈকট্যের অর্থনৈতিক সুফল হিসেবে দেখানো হলেও আসলে এই প্রকল্পে ভারত সরকার ও গুজরাট সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন করপোরেট পুঁজিকে বিপুল আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে যার পরিমাণ পনেরো হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া এই কারখানায় সেমিকন্ডাক্টার তৈরি হবে না, অ্যাসেম্বল হবে। অর্থাৎ উন্নত প্রযুক্তির স্থানান্তরের যে কথা বলা হচ্ছে তার সম্ভাবনা খুব কম। সব মিলিয়ে ভারত-মার্কিন বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের অধস্তন অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একে দেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যতই অগ্রগতি বলে দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে তা মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করা ছাড়া আর কিছুই করবে না।
অন্যদিকে দেশে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে আমেরিকার সংসদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ভারত ও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বিরাট ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ভারতকে ‘‘গণতন্ত্রের মা’’ হিসেবে উল্লেখ করে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় আমেরিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি এবং ব্যাপক হাততালি কুড়িয়েছেন। এদিকে মোদি যখন গণতন্ত্র নিয়ে বাগাড়ম্বরে ব্যস্ত, তখন হোয়াইট হাউসের বাইরে ওয়াশিংটনের রাস্তায় মোদি সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে মুখ খোলার জন্য জেলবন্দি পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাটের মেয়ে আকাশী ভাট, জাস্টিস লোয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত করে চরম দুর্গতির শিকার সাংবাদিক নিরঞ্জন টাকলের মতো কয়েকশ’ প্রতিবাদী। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার পঁচাত্তর জন সংসদ সদস্য, এমনকী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাও সরব হয়েছেন। মোদীর কাছে এইসব সমালোচনার কোনো উত্তর নেই। তাই অতিকষ্টে এবং প্রথমবার সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হতে মোদিকে রাজি করানোর পর যখন আমেরিকাবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি তাঁকে ভারতে বাক্-স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করেন তখন মোদী এই বলে পাস কাটান যে, ‘‘গণতন্ত্র আমাদের ডিএনএ তে আছে’’। এদিকে মোদির দল ও ভক্তকুল গণতন্ত্র ও বাক্ স্বাধীনতাকে কি চোখে দেখে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আন্তর্জাতিক মহল পেয়ে গেল যখন সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকিকে ‘‘পাকিস্তানি ইসলামি’’, ‘‘উদ্দেশ্যমূলক চর’’ ইত্যাদি বলে সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক হেনস্তা করা হলো। তাকে এতটাই নিকৃষ্ট আক্রমণ করা হয়েছে যে, হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি দিয়ে এই হেনস্তার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তবে একথা প্রত্যাশা করা অর্থহীন যে, ভারত সরকারের স্বৈরাচারী অবস্থানের কোনো বলিষ্ঠ বিরোধিতা করবে মার্কিন প্রশাসন। কেন না এটা বরাবর দেখা গিয়েছে যে, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও কমিউনিস্ট বিরোধী রাষ্ট্রগুলির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা হয় না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থপূরণই এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য।
তবে মোদির আমেরিকা সফর তো কেবল মার্কিনিদের জুনিয়র পার্টনার হওয়ার জন্য নয়। তিনি এই সফরগুলিকে ভারতে জনপ্রিয়তা অর্জনের কাজে লাগান। তাঁর ভক্তকুল তারস্বরে প্রচার করতে থাকে যে, বিদেশে মোদি নাকি ভারতের স্থান ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন! আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুচর হওয়াকেই এরা সাফল্য বলে তুলে ধরতে চায়।
সবমিলিয়ে মোদির আমেরিকা সফরে বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় চীনকে নিয়ে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ভারতকে কাছে টানার চেষ্টার মধ্য দিয়ে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনই ভারতের শাসকশ্রেণির মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনার অংশীদার হওয়ার জন্য ব্যাপক আগ্রহ নজরে এসেছে। সাধারণ মানুষের এহেন বিদেশ নীতির ফলে উপকৃত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং দেশীয় স্বৈরাচারী শক্তির সাথে সাম্রাজ্যবাদের গাঁটছড়া গণতন্ত্রের সংকটকে গভীরতর করবে,করপোরেট পুঁজির আধিপত্য আরও বাড়িয়ে তুলবে ও শাসকশ্রেণির জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও কঠিন বাধার সামনে ফেলবে।