৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮
মুখ্যমন্ত্রী নতুন করে দায়িত্বভার নেবার পরেও রাজ্যে শাসকদলের হিংসা সন্ত্রাস অব্যাহত
দত্তপুকুরে নিহত আইএসএফ কর্মী হাসানুর জামান।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা সত্ত্বেও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যজুড়ে হিংস্র সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি দায়িত্বভার নেবার পরেও পুলিশ প্রশাসন এবং তাঁর দলের পক্ষ থেকে এই হিংসা হানাহানি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই। তৃণমূলের পাশাপাশি অনেক জায়গায় বিজেপি’ও এই হিংসা ও তাণ্ডবে সক্রিয় থেকে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে। একদিকে করোনার মাত্রাছাড়া সংক্রমণ, রাজ্যজুড়ে মৃত্যুর বিভীষিকা - অন্যদিকে ধ্বংস-সন্ত্রাসের অভিঘাতে বিপর্যস্ত রাজ্য। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভোট পরবর্তী হিংসা ও সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন ১২জন। আহতের সংখ্যা অজস্র।
২ মে রাজ্যে নির্বাচনের ফল প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাসকদলের দুর্বৃত্তরা জয়ের উল্লাসে এলাকায় এলাকায় উন্মত্ত তাণ্ডব শুরু করে। এবারে নির্বাচনের প্রচার পর্বে তৃণমূলের একমাত্র স্লোগান ছিল - ‘খেলা হবে’। এখন রাজ্যবাসী গভীর আতঙ্ক আর প্রাণসংশয় নিয়ে সেই ‘খেলাই’ প্রত্যক্ষ করছেন। জয়ের উল্লাসে শাসকদল তৃণমূল বিরোধীদল বিশেষ করে সিপিআই (এম)’র কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে ঘরছাড়া করছে, ঘর ও দোকানপাট লুট করছে, বেপরোয়া তাণ্ডবের পাশাপাশি মহিলাদের উপরও আক্রমণ ও শ্লীলতাহানি করছে। চলছে জরিমানা আদায়। সংযুক্ত মোর্চার হয়ে নির্বাচনী কাজে অংশ নেওয়া কর্মীদের চিহ্নিত করে নির্বিচারে এই আক্রমণ চলছে। বিভিন্ন এলাকায় দখল করে নেওয়া হচ্ছে সিপিআই(এম)’র পার্টি অফিস। অনেক জায়গায় আবার সিপিআই(এম)’র পার্টি অফিস আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে লক্ষণীয় ঘটনা হলো, অনেক জায়গাতেই আক্রমণ করতে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে পড়ে হিংস্র দুর্বৃত্তরা পালাতে বাধ্য হয়েছে।
বিভিন্ন জায়গাতে বিজেপি’র ওপরও হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। আবার অনেক জায়গায় এর উলটো ঘটনাও ঘটছে, বিজেপি’ও হামলা চালিয়েছে তৃণমূলের ওপর। এই হিংস্রতায় যখন রাজ্যের সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের গৃহহীন হতে হচ্ছে, তখন বিজেপি এই ঘটনাগুলোর ওপর সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াতে উদ্যত হয়েছে। এরা দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম ও উত্তরবঙ্গের কোচবিহার প্রভৃতি জায়গায় তৃণমূলের হামলাকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে উসকানি দিচ্ছে।
এই সমস্ত হামলার ঘটনা কেবল জেলা, মফস্সলেই ঘটছে না, কলকাতার বুকেও চলছে। ভোটের ফলপ্রকাশের পর যাদবপুরে বেশ কয়েকটি জায়গায় সিপিআই(এম) কর্মীদের ওপর হামলা, পার্টি অফিস দখলের ঘটনা ঘটেছে। এখানে পার্টির ৫টি শাখা অফিস দখল করা হয়েছে। সিপিআই(এম) নেত্রী চন্দনা ঘোষদস্তিদার সহ চারজন পার্টি কর্মীর বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটেছে কসবা এলাকায়। এখানে ৬৭নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) কর্মী, অধ্যাপক ও লেখক অর্ণব ভট্টচার্যের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। হামলার ঘটনা ঘটেছে দমদম, বেলেঘাটা প্রভৃতি বিভিন্ন এলাকায়।
এভাবেই হামলার ঘটনা ঘটেছে বর্ধমান, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ভোটের ফল প্রকাশের পরই তৃণমূলের হিংস্র বাহিনীর হাতে খুন হন জামালপুরের নবগ্রামের সিপিআই(এম) কর্মী কাকলি ক্ষেত্রপাল। তাঁকে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। তিনি যখন রান্না করছিলেন তখন বাড়ি আক্রমণ হওয়ায় বাধা দিতে যান। তখনই তাঁকে নৃশংসভাবে আঘাত করে এই ঘাতকেরা। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ভোটের দিন নবগ্রাম বুথে সিপিআই(এম)’র হয়ে কাজ করেছিলেন। সেই আক্রোশেই শাসকদলের ঘাতকদের হাতে তাঁকে খুন হতে হলো। এই ঘটনার পরই গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃণমূলের খুনে বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। দু’জন খুনিকে ধরে ফেলেন। গ্রামবাসীদের রোষে এই দুই দুর্বৃত্তেরও মৃত্যু হয়। বর্ধমানের আউশগ্রাম, মন্তেশ্বর থেকে শহরাঞ্চল - সর্বত্রই এই হামলা চলেছে।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় জ্বলছে সিপিআই(এম) কর্মীর বাড়ি।
ভোটের ফল ঘোষণার পরই রক্তাক্ত হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। দেগঙ্গা বিধানসভার দত্তপুকুর থানার কদম্বগাছি গ্রামে আইএসএফ কর্মী হাসানুরজামানকে বোমা মেরে খুন করে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে এবং খুনীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মৃতদেহ প্রায় ৫ ঘণ্টা টানা ফেলে রেখে বিক্ষোভ দেখান সংযুক্ত মোর্চার সমর্থক সহ পরিবারের লোকজনেরা। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া অঞ্চলে ইটভাটা ও মেছো ঘেরিতে আক্রমণ ও লুঠপাট চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেছে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা।
ভোট পরবর্তী হিংসায় নতুন করে উত্তপ্ত হয়েছে কোচবিহার জেলার শীতলকুচি। এখানে সংঘর্ষে নিহত হয়েচে মানিক মৈত্র নামে ২০ বছরের এক যুবক। তৃণমূল-বিজেপি উভয় দলই এই মৃত যুবককে তাদের কর্মী বলে দাবি করেছে। ২ মে ফল প্রকাশের দিন দুপুরেই শীলতকুচির বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর চালাতে শুরু করে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের মোটিয়ারি এলাকায় হারান অধিকারী নামে এক বিজেপি কর্মীকে বাড়ি থেকে টেনে এনে খুন করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এছাড়া এই জেলার উস্তি থানার লক্ষ্মীকান্তপুর অঞ্চলে বলরামপুর গ্রামে সৌরভ বর নামে এক ১৪ বছরের কিশোরকেও প্রাণ দিতে হয়েছে শাসকদলের ঘাতক বাহিনীর হাতে। সে তার বাবাকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে খুন হয়।
ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে বীরভূম জেলার নানুর, ইলামবাজার, লাভপুর, দুবরাজপুর, সিউড়ি-২, রামপুরহাট, বোলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। সিউড়ি-২ ব্লকের ভগবানবাটি ও পুরন্দরপুরে সিপিআই(এম) কর্মীদের ঘরবাড়ি, দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে।
হুগলির গোঘাট, খানাকুল সহ বিভিন্ন অঞ্চলে সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে।
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়েও ব্যাপক হামলা ভাঙচুর, জরিমানা আদায়ের ঘটনা ঘটে চলেছে।
অন্যদিকে বাঁকুড়ার জয়পুর ও বিষ্ণুপুরের গ্রামে হামলা, চালাতে গিয়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে তৃণমূলের বাহিনী।
রাজ্যবাসীর স্মরণে আছে ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনের পরও এভাবেই রাজ্যজুড়ে হিংস্র সন্ত্রাস ও খুনের অভিযান চালিয়েছে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। আশ্চর্যের ঘটনা হলো, রাজ্যের প্রায় সর্বত্র এভাবে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলা সত্ত্বেও তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নির্বাচন কমিশনের ওপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে এই হিংসাকে পরোক্ষে মদত দিয়েছেন। এরপর ৫ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে তাঁর দলের এই ধরনের হিংস্র তাণ্ডবকে ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’ বলে মন্তব্য করে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। মমতা ব্যানার্জির শপথ গ্রহণের পরেও রাজ্যে হিংসা থামেনি। বরং আরও বাড়তি উৎসাহে দলের কর্মীরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসাত্মক অভিযানে মত্ত হয়েছে। এছাড়া নানা জায়গায় বিজেপি’ও সুযোগ বুঝে এই ধরনের হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ চালিয়েছে। ফলে গোটা রাজ্যের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এই ধারাবাহিক হিংসা ও সন্ত্রাসের ঘটনায় উত্তরবঙ্গে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ ভয়ে সীমান্তবর্তী আসামে কিছু এলাকায় আত্মীয় পরিজন ও পরিচিতদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার আশ্রয়হীনভাবেই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
আরও মারাত্মক ঘটনা হলো, করোনা সংক্রমণের মোকাবিলায় রাজ্যের নানা জায়গায় কর্মরত রেড ভলান্টিয়াররা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শাসকদলের হিংস্র আক্রমণের মুখে পড়ছেন। রাজ্যে তৃণমূলের শাসন ক্ষমতা দখলে রাজ্যে এমন হিংসা-সন্ত্রাসের পরিস্থিতিই যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
তৃণমূলের এই হিংসা সন্ত্রাস অবিলম্বে বন্ধ করা এবং শাসকদলের পাশাপাশি বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তার তীব্র নিন্দা করে প্রশাসনের জরুরি তৎপরতার দাবি জানিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা।
৫ মে রাজভবনে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
করোনাজনিত পরিস্থিতির জন্য সংক্ষিপ্তভাবেই এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে মমতা ব্যানার্জিই প্রথম, যিনি নির্বাচনে পরাজিত হয়েও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন।