৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮
বিজেপি-কে হারানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জয় তৃণমূলের
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এবারের নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো। সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তৃণমূলকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই দল জয়ী হয়েছে ২১৩টি আসনে। বিজেপি পেয়েছে ৭৭টি আসন। অন্যদিকে সিপিআই(এম), কংগ্রেস এবং আইএসএফ-কে নিয়ে গড়ে ওঠা সংযুক্ত মোর্চা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে। লক্ষণীয় বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা হলো, এবারের নির্বাচনে বামপন্থীরা একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি, আসন পায়নি কংগ্রেসও। সংযুক্ত মোর্চার শরিক আইএসএফ একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছে। এই দলের প্রার্থী নৌসাদ সিদ্দিকি ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে চমকপ্রদ ঘটনা হলো মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছেন। ২ মে ভোটগণনা হয়েছে। ভোটের ফলাফল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং বিজেপি ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং সংযুক্ত মোর্চা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমে মূলত তৃণমূল এবং বিজেপি - এই দু’পক্ষের প্রচারই তুলে ধরা হয়েছিল। যেখানে সংযুক্ত মোর্চাকে প্রায় আড়ালেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূল এবং বিজেপি দু’দলই কোটি কোটি টাকা খরচ করে যথেচ্ছ্ব হেলিকপ্টার বিহার করে সাড়ম্বর যেন প্রচারে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এছাড়া এবারের নির্বাচনের প্রাক্পর্বে শাসকদল তৃণমূল ছেড়ে বিভিন্ন স্তরের নেতা-নেত্রীদের বিজেপি’তে যোগদান এবং তাদের অধিকাংশকেই প্রার্থীপদে মনোনয়ন দেওয়া; দু’দলের পক্ষ থেকেই রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরের টিভি ও পর্দায় মুখ দেখানো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ধরে এনে মনোনয়ন দেবার ঘটনা লক্ষ করা গেছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল আসনে জয়ী হলেও এই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী থেকে নীচু তলার কর্মী - সবার মধ্যেই নির্বাচনী সাফল্য নিয়ে তীব্র সংশয় ও অনিশ্চয়তা ছিল। তাই দলে দলে শাসক শিবির ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল বিজেপি’র দিকে।
এছাড়া আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রী অনেকেই এরাজ্যে এসে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচার, সোনার বাংলা গড়া সহ হাজারো প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে বাংলার মসনদ দখলে মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এই নির্বাচনী পর্বেই ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হামলায় ২২ জন সেনাজওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা, দেশজুড়ে করোনা মহামারীর ভয়ঙ্কর প্রকোপ ইত্যাদি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা যেন ডেইলি প্যাসেঞ্জারির মতো বাংলায় উড়ে এসে জেলায় জেলায় ভোট প্রচারে মত্ত থেকেছেন। বিজেপি’র প্রচারের মূল অভিমুখই ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে কয়েক দফায় এরাজ্যে এনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালানো হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ সহ গেরুয়া বাহিনী যে ভাষা ও ভঙ্গিতে ভোটপ্রচার করেছে তা বাংলার অতীত ইতিহাসে তো বিরল বটেই, বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতিরও বিরোধী।
এদের এই উসকানিমূলক সাম্প্রদায়িক প্রচারের সাথে পাল্লা দিয়ে স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি-সহ তৃণমূলের প্রার্থী থেকে নেতা-নেত্রীরা সমানতালে রাজনীতি বর্হিভূত বিষয় ও ভাষা নির্বাচনী প্রচারে আমদানি করেছেন।
স্বাভাবিক কারণেই এদের দুই দলের প্রচারে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণা, রুটি-রুজি, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়গুলি আড়ালে চলে গিয়ে কুৎসা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপপ্রচার, হিংসা ইত্যাদিই প্রকট হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এই সমস্ত কিছুকেই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে নির্বাচনী লড়াই কেবল বিজেপি-তৃণমূলের অস্তিত্বকেই জনমানসে তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছে।
এই অবস্থায় সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে তৃণমূলের দশ বছরের অপশাসন, অগণতান্ত্রিক ও হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ, বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক জনাবীরোধী নীতি সহ গরিব সাধারণ মানুষের জীবন সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে মানুষের জীবন-জীবিকা, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের বিষয়, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, শ্রমিকের দাবি ও অধিকার রক্ষা, বন্ধ কলকারখানা খোলা ও নতুনশিল্প স্থাপনের বিষয়গুলি তুলে ধরা হলেও রাজ্যের মানুষ হয়তো তীব্র মেরুকরণের আবহে বিজেপি’কে রুখতে সংযুক্ত মোর্চার চেয়ে নানাদিক থেকে ব্যর্থ ও কলঙ্কিত তৃণমূলকেই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ভেবে সমর্থন করেছে।
তবে লক্ষণীয় দিক হলো, এমন একটি কঠিন সময়ে তীব্র মেরুকরণের আবহে সংযুক্ত মোর্চা তথা বামপন্থীদের চরম বিপর্যয় সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফলের একটি বিশেষ দিক কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। ফলাঘলের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রাজ্যের যে সমস্ত কেন্দ্রে তরুণ-মেধাবী ছাত্র-যুব সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, প্রায় সমস্ত কেন্দ্রেই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে এবারে অনেক বেশি ভোট বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন তারা। যেমন, বালি বিধানসভায় এবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় নেত্রী, জেএন ইউ’র ডিগ্রিধারী দীপ্সিতা ধর। এই কেন্দ্রে গত লোকসভায় সিপিআই (এম)’র ভোট ছিল ১৩,১২৫ (১০.৭২ শতাংশ)। সেখানে এবারে ভোটপ্রাপ্তি ২২,০৪০ (১৭.৫৭ শতাংশ)। সিঙ্গুর বিধানসভার ক্ষেত্রে গত লোকসভায় সিপিআই (এম) প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৭,৬৩২ (৮.৭৯ শতাংশ) ভোট। এবারে এই কেন্দ্রে এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য পেয়েছেন ৩০,০১৬ (১৪.৩ শতাংশ) ভোট। জামুড়িয়া বিধানসভা ক্ষেত্রে বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৫,৫৪৯ (৯.৫৯ শতাংশ) ভোট। এবারে এই কেন্দ্রে জেএনইউ’র সাধারণ সম্পাদিকা ঐশী ঘোষ পেয়েছেন ২৪,৮১৮ (১৪.৮৯ শতাংশ) ভোট। ডায়মন্ডহারবার বিধানসভার ক্ষেত্রে গত লোকসভায় বামফ্রন্ট প্রার্থীর ভোট ছিল ১৬,৯০৪ (৮.১৮ শতাংশ) ভোট। এবারে বিধানসভায় এসএফআই’র রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমান পেয়েছেন ৩৮,৭১৯ (১৭.১৮ শতাংশ) ভোট। কসবা বিধানসভা ক্ষেত্রে ২০১৯-এর লোকসভায় বামফ্রন্ট প্রার্থী পেয়েছিলেন ২৯,৫৮২ (১৪.৫৫ শতাংশ) ভোট। এবারে এই কেন্দ্রে তরুণ যুব নেতা শতরূপ ঘোষ পেয়েছেন ৩৯,১৮০ (১৭.৫৬ শতাংশ) ভোট। একইভাবে বর্ধমান উত্তর বিধানসভা ক্ষেত্রে গত লোকসভায় বামফ্রন্টের ভোট ছিল ২৫,৩৭৩ (১১.১৯ শতাংশ) ভোট। এবারে তরুণ সিপিআই (এম) প্রার্থী চণ্ডীচরণ লেট পেয়েছেন ৩১,০২৮ (১২.৮৩ শতাংশ) ভোট। বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভা ক্ষেত্রে গত লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ভোট পেয়েছিল ১৮,৮৪৮ (৯.৫১ শতাংশ) ভোট। এবারে এই কেন্দ্রের ছাত্র নেত্রী পৃথা তা পেয়েছেন ২৩,৩৪৬ (১১.৩৭ শতাংশ) ভোট। এছাড়া রাজারহাট-নিউটাউন বিধানসভা ক্ষেত্রে গত লোকসভায় বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৪,৯৮২ (৭.১৮ শতাংশ) ভোট। এবারের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে সিপিআই (এম)’র তরুণ প্রার্থী সপ্তর্ষি দেব পেয়েছেন ৩১,৫৪৩ (১৩.৪৩ শতাংশ) ভোট।
এবারের নির্বাচনে বামপন্থীদের চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও এই একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ প্রার্থীর প্রতি মানুষের সমর্থন ও ভোটের বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অনেক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা আগামীদিনে লড়াই-আন্দোলনেও প্রেরণা জোগাবে।
বিগত সময়ে সরকার পরিচালনায় সাধারণ মানুষের স্বার্থে এবং রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নে গঠনমূলক পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং নানা কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতিতে ডুবে থাকা তৃণমূলকে কেন মানুষের এত সমর্থন-তা পরবর্তীতে পর্যালোচনায় নিশ্চয়ই প্রকাশিত হবে। তবে প্রাথমিকভাবে এই নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট রাজ্যের মানুষ সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসতে দিতে রাজি নয়।