৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮
কেরালায় এলডিএফ’র ঐতিহাসিক জয়
কেরালায় দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলো সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ)। ২০১৬ এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরপর জয়ী হয়ে কেরালার নির্বাচনী ইতিহাসে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করল এলডিএফ। ১৯৮০ সালের পরবর্তী ৪০ বছরে কেরালার বিধানসভা নির্বাচনে এই ঘটনা প্রথম। ১৪০ আসন বিশিষ্ট কেরালা বিধানসভায় ৯৯ টি আসন পেয়েছে এলডিএফ। এই আসন সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৮টি বেশি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) পেয়েছে ৪১টি আসন। গতবারের চেয়ে তাদের আাসন সংখ্যা কমেছে ৭টি। নির্বাচনে বিজেপি'র ভরাডুবি ঘটেছে। বিজেপি কোনো আসনে জিততে পারেনি। গতবারের জেতা একমাত্র আসনেও তারা এবার পরাজিত হয়েছে। এই নির্বাচনী ফলের মধ্যদিয়ে কেরালাই দেশের মধ্যে প্রথম বিজেপি শূন্য বিধানসভা হতে চলেছে। প্রসঙ্গত, গত ৬ এপ্রিল একদফায় কেরালার সমস্ত আসনে ভোটগ্রহণ হয়। ভোটের হার ছিল ৭৪.২ শতাংশ। গত ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের থেকে ২.৮ শতাংশ ভোট কম পড়েছে।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে কেরালায় এলডিএফ'র আলোড়নসৃষ্টিকারী জয়কে অভিবাদন জানিয়েছে । কেরালার জনগণের ফের একবার এলডিএফ'র ওপর আস্থা বিশ্বাস স্থাপন এবং পরবর্তী সরকার গড়তে পুনর্নির্বাচিত করার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। একটি বিদায়ী সরকারের ফের নির্বাচিত হবার ঘটনা চার দশক পর কেরালায় ঘটল। গত নির্বাচনের তুলনায় এলডিএফ'র ফল ভালো হয়েছে। এলডিএফ'র বিকল্প নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যেভাবে সরকার মোকাবিলা করেছে, অতিমারী এবং তার পরবর্তী ঘটনাসমূহকে যেভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে, সরকারের কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কেরালা সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমন্বয়সূচক চরিত্রকে রক্ষা করতে সরকারের ভূমিকা এবং সর্বোপরি বিদায়ী সরকারের কাজের ওপর কেরালার জনগণ ভোট দিয়েছে। এলডিএফ'র বিরাট জয়ে কেরালার জনগণকে অভিনন্দন জানিযেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এলডিএফ'র এই জয়কে কেরালার জনগণের জয় বলে বর্ণনা করেছেন। এলডিএফ'র ওপর পুনরায় আস্থাস্থাপন করার জন্য কেরালর জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেছেন, এখন আমাদের প্রয়োজন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অতিমারীকে মোকাবিলা করা এবং উন্নয়ন, কল্যাণ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে কেরালাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এলডিএফ'র ৯৯টি আসনের মধ্যে সিপিআই(এম) একাই পেয়েছে ৬২টি আসন এবং সিপিআই(এম) সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা ৩ টি আসনে জয়ী হয়েছে। সিপিআই(এম) ৪টি বেশি আসন পেয়েছে ২০১৬-র নির্বাচনের তুলনায়। এলডিএফ'র অন্য শরিকদের মধ্যে সিপিআই ১৭টি, কেরালা কংগ্রেস (মানি) ৫টি, কেরালা কংগ্রেস ২টি, এনসিপি ২টি, জনতা দল (ধর্মনিরপেক্ষ) ২টি, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লিগ ১টি, কংগ্রেস (ধর্মনিরপেক্ষ) ১টি, কেরালা কংগ্রেস (বি) ১টি, কেরালা কংগ্রেস (জ্যাকব) ১টি, জে কেরালা কংগ্রেস ১টি, লোকতান্ত্রিক জনতা দল ১টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে ইউডিএফ'র কংগ্রেস ২১টি এবং ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ ১৫টি আসন পেয়েছে।
কান্নুর জেলার ধর্মাদম কেন্দ্র থেকে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন পিনারাই বিজয়ন। তিনি কংগ্রেসের সি রঘুনাথনকে ৫০,১২৩ ভোটে পরাজিত করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা কান্নুর জেলার মাট্টানুর কেন্দ্র থেকে সর্বাধিক ভোটে জয়ী হয়েছেন। তিনি আরএসপি প্রার্থীকে ৬০,৯৬৩ ভোটে পরাজিত করেছেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিরুবনন্তপুরম জেলার নেমোন কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি প্রার্থী। এবারে ওই কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী ভি শিবাকুট্টি বিজেপি বিধায়ক কে রাজাশেখরন-কে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন। তিরুবনন্তপুরম জেলায় ১৪টি আসনের মধ্যে ১৩ টি আসনই জিতেছে এলডিএফ। পাঠানামুথিট্টা জেলায় সবরীমালা মন্দির অবস্থিত। এই জেলার সবকটি আসনেই জয়লাভ করেছে এলডিএফ। এলডিএফ'র জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে ১০ মহিলা আছেন। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৮।
এবারের নির্বাচনে এলডিএফ'র ৯৯টি আসন পাওয়াটাও একটা সর্বকালীন রেকর্ড। এর আগে এলডিএফ সর্বাধিক আসন পেয়েছিল ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, ৯৮টি। এর পরের বিধানসভা নির্বাচন ২০১১ সালে এলডিএফ জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, পেয়েছিল ৬৮টি আসন। আর মাত্র ৩টি আসন পেলে সেবারই ইতিহাস রচনা করতে পারত এলডিএফ। ওই বিদায়ী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভি এস অচ্যুতানন্দন।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর কেরালা রাজ্য গঠন হবার পর প্রথম বিধানসভা নির্বাচন হয় ১৯৫৭ সালে। ২০২১ সালের নির্বাচন পঞ্চদশ বিধানসভা নির্বাচন। ১৯৫৭ সালের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সরকার গড়েছিল। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে এই সরকার শপথ নেয় ১৯৫৭ সালের ৫ এপ্রিল। কিন্তু সেই সরকারকে পুরো মেয়াদ চলতে দেয়নি তৎকালীন কেন্দ্রের জওহরলাল নেহরু সরকার। ১৯৫৯ সালের ৩১ জুলাই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে এই সরকারকে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালের কেরালায় কমিউনিস্টদের সরকারই ছিল দুনিয়ায় প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে তৈরি করা কমিউনিস্টদের সরকার। কেরালায় মোট ৮ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে। এবারে যে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হতে চলেছে সেটি হবে কেরালার তেইশতম মন্ত্রীসভা।