৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮
কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার নজির গড়ে চলেছে তৃণমূল সরকার
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও এরাজ্যের কোভিড পরিস্থিতির বেহাল দশার কোনো হেরফের হলো না। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কোভিড মোকাবিলায় যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সরকারিস্তরে পরিসংখ্যান চেপে রাখার অপচেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণের হার। তৃণমূল কংগ্রেসের জয়োল্লাসের ভিড়কে কেন্দ্র করে সংক্রমণ আরও ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে রাজ্যজুড়ে বেড়েই চলেছে অসুস্থ আর্ত মানুষের হাহাকার। আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না। মিলছে না কোভিডের প্রয়োজনীয় ওষুধ। পুরোদমে চলছে কালোবাজারি, মজুতদারি।
রাজ্যের কোভিড আক্রান্তদের কাছে এখন সবচেয়ে বড়ো ভয় অক্সিজেন না পাওয়া। আর এর মধ্যেই আবার করোনা ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে শুরু হয়েছে সঙ্কট। হাসপাতালগুলিতে হন্যে হয়ে মানুষ ঘুরছেন ভ্যাকসিনের জন্য। প্রতিদিন বাড়ছে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। খুলছে সেফ হোম। ভ্যাকসিনের হাহাকারের মধ্যেই জীবনদায়ী ওষুধের মজুত দ্রুত কমছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি সহ দক্ষিণবঙ্গে। করোনা মোকাবিলায় অন্যতম জীবনদায়ী ওষুধ রেমডেসিভির। এই ওষুধ সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, চাহিদার তুলনায় মিলছে মাত্র ২৫ শতাংশ ইঞ্জেকশন।
দেহ বাড়িতে থেকে পচন ধরলেও দেখা মিলছে না কারো। বিভিন্ন হেল্পলাইনে ফোন করেও সুরাহা নেই। মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই প্রশাসনের তরফে। মৃতদেহ আগলে প্রিয়জনেরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা বসে আছেন এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে এ রাজ্যে।এর ফলে এলাকায় আতঙ্ক তীব্র হচ্ছে। স্থানীয় পৌরসভাগুলিও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না এক্ষেত্রে। শুধুমাত্র চুপিসাড়ে ভুয়ো সংখ্যা দেখিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কোভিড আক্রান্তের লাশ।
সম্প্রতি ১৮ হাজারের গণ্ডি পার করেছে রাজ্যে করোনার দৈনিক সংক্রমণ। স্বাস্থ্য দপ্তরের ৪ মে’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ১০২ জন এবং করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০৩ জন। এদিন রাজ্যে করোনা মুক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ০৭৩ জন, রাজ্যে দৈনিক সুস্থতার হার ৮৫.৪১ শতাংশ। গোটা রাজ্যের মধ্যে সংক্রমণের দিক থেকে শীর্ষে কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনা। এদিন কলকাতায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৭৩ জন। উত্তর ২৪ পরগনায় বুধবার নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৮৫ জন। বর্তমানে রাজ্যে করোনায় সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৮৭২ জন।
এদিকে টেস্ট আরও বেশি পরিমাণে হলে কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যা যথেষ্ট বাড়বে বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আশঙ্কা বাড়ছে, পজিটিভ হয়ে পরীক্ষা না করিয়ে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের নিয়ে। তারা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পরোক্ষে সাহায্য করছেন বলে চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ফোরাম অফ সাইন্টিস্টস ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজিস্ট এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ দেশজুড়ে শুরু কোভিডের সুনামি রুখতে রাজ্যের কি করা উচিত তার একটি দীর্ঘ সুপারিশ পেশ করেছে। তার মধ্যে জোর দেওয়া হয়েছে অক্সিজেনের ব্যবহার এবং জোগান সহ পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে সম্ভাব্য বিকল্পের ক্ষেত্রে।
তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের কোভিড হাসপাতালগুলিতে সিসিইউ এবং এইচডিইউ শয্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এমনকি রাজ্যে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ও সেফ হোমে মোট কত অক্সিজেন বেড আছে তার কোনো প্রকাশিত তথ্য না থাকায় মতভেদ রয়েছে। তার ৫০ শতাংশ বেডে অক্সিজেন দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে ধরে নিয়ে একটা হিসেব পেশ করা হয়েছে সুপারিশে। রাজ্যের সব হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহযুক্ত শয্যা সংখ্যা থেকে কোন্ হাসপাতালে কত অক্সিজেন প্রয়োজন এমনকি যদি বাড়িতে থেকেও গভীর আক্রান্তের চিকিৎসা চলে তাহলে কতটা প্রয়োজন তার একটা আনুমানিক হিসেব দেওয়া হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে রাজ্যের সিংহভাগ ছোটো হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে অক্সিজেন সরবরাহ এ টাইপ (১০০০ লিটার) এবং বি টাইপ (৬০০ লিটার) অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপর নির্ভরশীল। অথচ বহু ক্ষেত্রেই এ টাইপ অনাবশ্যকভাবে মজুত করে রাখা হচ্ছে। সেগুলিকে বারবার রিফিল করে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত অক্সিজেনের বিষয়ে চিকিৎসক প্রযুক্তিবিদ এবং জনবিজ্ঞান সংগঠনের বক্তব্য, এর একাংশ অনায়াসেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
রোগী ফেরানোর অভ্যাসে কোনো ছেদ পড়েনি রাজ্যে। রাজ্য সরকার এবং আদালতগুলির নির্দেশ উপেক্ষা করে একের পর এক আক্রান্তকে ফেরাচ্ছে হাসপাতাল। হাসপাতালের বাইরে পড়ে থাকা রোগীর প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতাল থেকে অক্সিজেনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নদীয়া জেলা জুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে আসছে এমনই সব মর্মান্তিক চিত্র। আবার রাজ্য সরকার যে গত বছরের বিপর্যয় থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি তার প্রমাণ পাচ্ছেন সিউড়িবাসীরা। সেখানে এখন সিউড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালকেই রূপান্তরিত করা হচ্ছে কোভিড হাসপাতালে।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট লকডাউনের পরিস্থিতির কথা বলেছে। করোনা মোকাবিলার জন্য এর আগে আংশিক লকডাউন আগেই ঘোষণা করেছে এই রাজ্যের সরকার। ৬ মে থেকে লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ হলো রাজ্যে। ৫০শতাংশ চলবে মেট্রো ও সরকারি বাস।
৪ মে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী জানান এখনি সম্পূর্ণ লকডাউন নয়। তবে ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত। সোনার দোকান খোলা থাকবে ১২টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত। এবং আগের নির্দেশ মতো বাজার খোলা থাকবে সকাল ৭টা থেকে ১০টা ও দুপুর ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত।
এদিকে রাজ্যের অনুরোধ মেনে লোকাল ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল রেল। সিপিটিএম (চিফ প্যাসেঞ্জার অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট মানেজার) এই সিদ্ধান্ত নিলেন। রেলকর্মীদের জন্য ‘স্টাফ স্পেশাল’ চালাবে রেল।