৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮
দেশে অনিয়ন্ত্রিত করোনা মহামারি
রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট
ফাঁকা সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরার জন্য করোনা সংক্রামিতদের পরিজনদের দীর্ঘ লাইন মীরাটে।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কোভিডজনিত পরিস্থিতি সামলাতে দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার জের চলছেই। সংক্রমণ থেকে অক্সিজেনের জোগান, হাসপাতালের বেড সঙ্কট, করোনায় মৃতদের দেহ পোড়ানোর জন্য দাহস্থানের অকুলান, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দাহ করার আগে তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা চলছেই। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করোনা সংক্রান্ত সমস্যাও বেড়েই চলেছে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে প্রায়ই কেন্দ্রীয় সরকারকে তিরস্কারমূলক পর্যবেক্ষণে বিদ্ধ করছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সহ বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমানকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে সঙ্কটের ভয়াবহতা। রাজ্যগুলিতে তীব্র হচ্ছে মানুষের অসহায়তা।
৪ মে পর্যন্ত ৩.৫৭ লক্ষ নতুন কোভিড কেস নথিভূক্ত করা হয়েছে। ওইদিনের হিসেব অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৪৯, নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ২২৯। এই হিসেব অনুযায়ী দেশে কোভিড অ্যাক্টিভ কেসের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৩৩। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, করোনা পরিস্থিতির দ্বিতীয় ঢেউ ভারতের পশ্চিম দিকের রাজ্যগুলিকে প্রবলভাবে সংক্রামিত করার পর তা দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ওডিশা সহ এই এলাকার অন্যান্য রাজ্যগুলিতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারের ঊর্ধ্ব গতির নজির আতঙ্ক বাড়াচ্ছে পূর্বাঞ্চলে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রক সহ অন্যান্য কয়েকটি দপ্তরের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সচিব পর্যায়ে অতিমারীকেন্দ্রীক সমন্বয়মূলক বৈঠক হয়েছে। সেখানে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সংক্রমিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়েছে জেলা পর্যায়ে টেস্ট এবং নিভৃতাবাসের ওপর। এছাড়াও সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে মানুষের যাতায়াত এবং গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। চিকিৎসার পরিকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে ‘মেক শিফট’ হাসপাতাল তৈরিসহ অক্সিজেন অডিট করার বিষয় আলোচিত হয়েছে বৈঠকের থেকে। টিকার জোগানের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয় বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আদালতে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে এখনও পর্যন্ত অক্সিজেন ও অন্য পরিকাঠামো সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনাই নেই। বিক্ষিপ্ত মন্তব্য ছাড়া কোনও নীতি প্রণয়ন এখনও করে উঠে পারেনি কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে দেশের উচ্চ আদালতগুলির সমালোচনা অবশ্য অব্যাহত আছে। যদিও কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফ থেকে বলা হয়েছে, অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। হাসপাতালে ‘বিচার বিবেচনা’ করে অক্সিজেন ব্যবহার করা উচিত। অথচ রাজধানী দিল্লিতেই অক্সিজেন মিলছে না। একের পর এক হাসপাতালে অক্সিজেনের সঙ্কটে চিকিৎসা বিপর্যস্ত। এই অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। এর আগে দিল্লি হাইকোর্ট রাজধানীতে যথেষ্ট অক্সিজেন সরবরাহের জরুরি নির্দেশ দিয়েছিল। আরও নির্দিষ্ট করে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লিতে ৭০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন পাঠানোর নির্দেশ দেয়। ৪ মে হাইকোর্টে দিল্লি সরকারের তরফে অভিযোগ করা হয় শীর্ষ আদালতের নির্দেশ কার্যকর হয়নি। ৪৩৩ মেট্রিক টন পাঠানো হয়েছে। ‘মানুষ মারা যাচ্ছেন’, সওয়ালে বলেন দিল্লি সরকারের আইনজীবী রাহুল মেহরা। এর উত্তরে কেন্দ্রের কৌঁসুলি অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল চেতন শর্মা বলেন, ‘এসব বাগাড়ম্বর’। এতেই বিচারপতি বিপিন সঙ্ঘি, রেখা পল্লীর বেঞ্চ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘এ কি শুধুই বাগাড়ম্বর? এটাই বাস্তব। আপনারা দৃষ্টিহীন হতে পারেন, আমরা নই। আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না। আপনাদের কোনও সংবেদনশীলতা নেই, অত্যন্ত দুঃখজনক। কী করে এমন মন্তব্য করতে পারলেন?’’ বিচারপতিরা বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে ৭০০ মেট্রিক টন সরবরাহ করতে। আপনারা যদি তা না পারেন, তা আদালত অবমাননা বলে গ্রাহ্য হবে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল দিল্লিতে ওই পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই। সে কথাও মেনে নেয়নি আদালত।
এদিকে, জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি লিখেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দার সিং সহ অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছেন। অক্সিজেন নেই বলে লেভেল-২ এবং লেভেল-৩ শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধিও করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি লিখে তিনি আরও বলেছেন, কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে ৫০ মেট্রিক টন লিকুইড অক্সিজেন এখনই পাঠানো দরকার, বোকারো থেকে ২০টি অতিরিক্ত ট্যাঙ্কার দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আবার মহারাষ্ট্র সরকারও রাজ্যের জন্য দৈনিক অতিরিক্ত ২০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে কোভিড অতিমারী সম্পর্কে গবেষণার প্রয়োজনীয় তথ্য পাচ্ছেন না একথা জানিয়ে দু’শোর বেশি বিজ্ঞানী এবং গবেষক চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। মহামারী মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রস্তুতি গড়ার জন্য সরব হয়েছেন এই বিজ্ঞানীরা। এপ্রিলের শেষে তাঁরা চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁরা বলেছেন, জেনোম সিকোয়েন্সিং বা ভাইরাসের প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠার মতো মহামারী সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য তাঁদের নাগালের বাইরে রাখা হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘ভারতের মতো বৃহৎ ভৌগোলিক ভূখণ্ডে সংক্রমণের তীব্রতার কারণে পার্থক্য রয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আইসিএমআর’র বৃহৎ তথ্য ভাণ্ডারের সাহায্য পেলে উপযুক্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।’’ বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, ‘‘রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত করে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যও বিজ্ঞানীদের ব্যবহারের সুযোগ থাকা উচিত। ভাইরাসের প্রকৃতি বিশ্লেষণ এবং অনুমান করার কাজে এই তথ্য জরুরি। তাহলে অনুমান করা সম্ভব কতদিনের মধ্যে মোট কত আইসিইউ বেড দরকার, কোন্ ওষুধ বা সরঞ্জামের সরবরাহ কতটা বাড়িয়ে নিতে হবে, ভেন্টিলেটরস কত দরকার পড়বে।...’’
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, কেন্দ্রের চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিএমআর’র কাছে সংরক্ষণ করা রয়েছে কোভিড মহামারী সংক্রান্ত তথ্যের ভাণ্ডার। সংক্রমণ দ্বিতীয় পর্বে দ্রুত ছড়াচ্ছে, প্রাণহানিও হচ্ছে বহু মানুষের। মহামারী প্রতিরোধ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থেই এই তথ্য ভাণ্ডার ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া উচিত বিজ্ঞানীদের।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, দ্বিতীয় দফায় করোনার দাপটে শুধু এপ্রিল মাসেই কাজ হারিয়েছেন ৭৫ লক্ষ মানুষ। রাজ্যগুলিতে লকডাউন এর ফলে প্রতি মাসেই কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বিপুল হারে বাড়ছে। ৪ মে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে বেকার হয়েছেন আরও ৭৫ লক্ষ মানুষ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেকারির হার চড়া শহরাঞ্চলে।
২০২১-এর প্রথম চার মাসে দেশের কোভিড পরিস্থিতি
মাস | জানুয়ারি | ফেব্রুয়ারি | মার্চ | এপ্রিল |
আক্রান্ত | ৪,৭৯,৫০৯ | ৩,৫০,৫৮৪ | ১০,৫২,৩০৪ | ৩৭,৮১,৬৩০ |
১ মে পর্যন্ত দেশের রাজ্যওয়ারি কোভিড রোগীদের অবস্থা
রাজ্য | আক্রান্ত | সংক্রমিত | সুস্থ | মৃত |
মহারাষ্ট্র | ৪৬,৬৫,৭৫৪ | ৬,৬৩,৭৫৮ | ৩৯,৩০,৩০২ | ৬৯,৬১৫ |
কর্ণাটক | ১৫,৬৪,১৩২ | ৪,০৫,০৩৮ | ১১,৪৩,২৫০ | ১৫,৭৯৪ |
কেরালা | ১৬,০৬,৮২০ | ৩,২৩,৮২৪ | ১২,৭৭,২৯৪ | ৫,৩৫৭ |
উত্তর প্রদেশ | ১২,৮২,৫০৪ | ৩,০১,৮৩৩ | ৯,৬৭,৭৯৭ | ১২,৮৭৪ |
রাজস্থান | ৬,১৫,৬০৩ | ১,৮২,৩০১ | ৪,২৮,৯৫৩ | ৪,৩৯৯ |
পশ্চিমবঙ্গ | ৮,৪৫,৮৭৮ | ১,১৬,৬৫৯ | ৭,১৭,৭৭২ | ১১,৪৪৭ |
দিল্লি | ১১,৭৪,৫৫২ | ৯৬,৭৪৭ | ১০,৬১,২৪৬ | ১৬,৫৫৯ |
আক্রান্তের হিসেবে দেশের প্রথম পাঁচটি রাজ্য পর্যায়ক্রমে এবং পশ্চিমবঙ্গ (দশম) সহ রাজধানী দিল্লির (ত্রয়োদশ) পরিস্থিতি।
সূত্রঃ www.statista.com