E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৭ মে, ২০২১ / ২৩ বৈশাখ, ১৪২৮

আমেরিকার ভ্যাকসিন কুটুম্বিতা ও টিকার বিজনেস মডেল

তপন মিশ্র


করোনায় প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু। শেষকৃত্যের জায়গা হচ্ছে না শ্মশানে, সমাধিক্ষেত্রে। গণচিতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে দেশের বহু প্রান্তে।

আপনার সেলফোনে আঙুল দিলেই শুনবেন দেশেই তৈরি হচ্ছে টিকা। অন্তত ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে হবে ভারত এখন আত্মনির্ভর। কিন্তু হঠাৎ এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে খবর ছড়ালো আমেরিকা থেকে টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল না আসার কারণে কোভিসিল্ড তৈরি ব্যাহত হচ্ছে। খবর একটু ভাল করে উলটে-পালটে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, কেবল সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (SII)–র কোভিসিল্ড নয় ভারত বায়োটেক (Bharat Biotech)-এর কো-ভ্যাকসিন উৎপাদনও ব্যাহত হবে।

প্রথমেই বলে রাখি আমরা কেউ বিশ্বাস করি না যে, আত্মনির্ভর বা স্বনির্ভর ভারত মানে এই নয় যে, আমাদের দেশ ছুঁচ থেকে পরমাণু চুল্লি বা লবণ থেকে ভ্যাকসিন সব তৈরি করতে সক্ষম হবে। আমরা মনে করি যে, অন্তত এমন কিছু তৈরি করতে পারব যা দিয়ে অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে দরা-দরি করা যেতে পারে। এক দশকের আগের তুলনায় ভারতের সেই ক্ষমতা কমেছে বৈ বাড়েনি।

ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারটা ধরা যাক। আমরা প্রায়ই শুনি যে, আমাদের দেশ টিকা এবং ওষুধ উৎপাদনে পৃথিবীতে অনেকটা এগিয়ে। আমরা আসলে এগিয়ে এই শিল্পের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যা কম গুরুত্বপুর্ণ নয়। যে ওষুধ অন্য কোথাও গবেষণার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে এবং উৎপাদিত হয়েছে তার পেটেন্টের সময় শেষ হলে তাকে কপি অর্থাৎ নকল করে পৃথিবীর এক বড়ো অংশে বিক্রি করা যায়। ওষুধ (Pharmaceutical) শিল্পে এই ওষুধকে জেনেরিক (Generic) বলা হয়। এই জেনেরিক ঔষুধ ভারতীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলি এতোটাই এবং এমন পদ্ধতিতে তৈরি করতে পারে যে, কমদামে অনেক বেশি পরিমাণে তৈরি হয়, যা ভারত-সহ বিদেশের এক বড়ো বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখে। এই আত্মনির্ভরতার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ল কয়েকদিন আগে। ফরাসি সান্ধ্য দৈনিক ‘ল্য মঁদ’ (Le Monde) গত ২৯ এপ্রিল তাদের সান্ধ্য সংস্করণে লিখেছেঃ “এই পরিস্থিতির জন্য করোনা ভাইরাসের অপ্রত্যাশিত ভোলবদলের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঔদ্ধত্য, অপরিণামদর্শিতা, এবং জনপ্রিয়তা আদায়ের চেষ্টাই দায়ী”। অস্ট্রেলিয়ার দৈনিক “দ্য অস্ট্রেলিয়ান” লিখছেঃ “করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতকে চরম সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী”। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন একটি প্রবন্ধে (How Modi Failed Us) লিখছেঃ “ভারতের শক্তিশালী মানুষ নরেন্দ্র মোদী সমস্ত সাবধানতাকে ভুলে দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।” গত সপ্তাহে দি নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছেঃ “ভারতে মৃত্যুর হারকে কম করে দেখানো হচ্ছে’’ (“As Covid-19 Devastates India, Deaths Go Undercounted”)। তবুও নগ্ন রাজার কোনো হুঁশ নেই।

এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালের সামনে রাত দুটো থেকে লাইন দিয়েও ভ্যাকসিন না পেয়ে পথ অবরোধ বিক্ষুব্ধ মানুষের।

আমেরিকার হুমকি

আমেরিকার ১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময় Defence Production Act (DPA) নামে একটি আইন তৈরি হয়েছিল। আইনটি ছিল পুরোটাই প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন সম্পর্কিত। এই আইনটিকে ঘষা-মাজা করে জাতীয় জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই আইনের দু’টি গুরুত্বপুর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমটি হলো রাষ্ট্রপতি আমেরিকার কোম্পানিগুলিকে নির্দেশ দিয়ে বলতে পারেন যে, আগে দেশের চাহিদা মিটিয়ে তারপর রপ্তানি। কয়েক সপ্তাহ আগে এই আইন ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় এবং ভ্যাকসিন তৈরির উপকরণ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথম ধাপে উৎপাদিত টিকা রপ্তানি করার সময় আমাদের দেশ এমন আচরণ দেখাতে পারেনি এবং তা সমীচিনও নয়। আমেরিকার মতো দেশের ক্ষেত্রেও পিডিএ একটি অমানবিক আইন। দ্বিতীয়ত, এই আইনের আর একটি ব্যবস্থা হলো রাষ্ট্রপতি চাইলে এই সমস্ত বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সরকার আর্থিক অনুদানের মধ্য দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে নির্দেশ দিতে পারে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন দ্বিতীয় পথটিতে হাঁটলেন না। তিনি কেবল আমেরিকার বেসরকারি সংস্থা ফাইজার Pfizer, বিয়োন্টেক BioNTech এবং পরে জনসন এবং জনসন (Johnson & Johnson)-কে ২৪ ঘণ্টা ৭ দিন টিকা তৈরির সমস্ত উপাদান সরবরাহ করতে আমেরিকার সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দেন।

মনে আছে নিশ্চয়ই ট্রাম্পের এক ধমকে আমেরিকাকে ক্লোরোকুইন সরবরাহ নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় মোদী সরকার। আমেরিকায় ট্রাম্প অবশ্য এই একই আইনের দু’টি ধারাই ভেন্টিলেটর তৈরির জন্য ব্যবহার করেছিলেন। ট্রাম্প, বাইডেন এবং মোদীর এই কুটুম্বিতার কথা এখন একটু অন্যরকম মনে হলেও ইতিহাস বলবে যে, একই হারমোনিয়ামের রিড।

ভ্যাকসিন তৈরি একটি আমদানি নির্ভর শিল্প

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)’র তথ্য অনুযায়ী সাধারণভাবে বললে দাঁড়ায় যে, ভ্যাকসিন তৈরি করতে কয়েক হাজার ধরনের উপাদান লাগে। এগুলি বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের ৩০০টি সংস্থা তৈরি করে। এর মধ্যে ৬৬টি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান আমেরিকার সংস্থাগুলি তৈরি করে। এগুলির মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি হলো (১) বিয়োরিয়াক্টর ব্যাগ - সাধারণভাবে বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ একবার ব্যবহারের পরে ফেলে দিতে হয়। এগুলিতে প্রাণী কোষের মধ্যে ভাইরাসের কালচার বা চাষ করতে ব্যবহার করা হয়। (২) এক বিশেষ ধরনের ফিল্টার যা বিশুদ্ধিকরণ (purification), নির্বিজকরণ (sterilisation) করার কাজে লাগে। (৩) কোষ কালচারের মিডিয়া অর্থাৎ যে মাধ্যম থেকে কোষ খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। এছাড়াও আরও অনেক জৈব উপাদান, রাসায়নিক এবং অন্যান্য উপাদান লাগে যেগুলি আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়না। অবশ্য এখন আমাদের দেশে যে দুই ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের উপাদান লাগে। কিন্তু কিছু সাধারণ উপাদান আছে যা আমেরিকার সংস্থাগুলির উপর নির্ভরশীল। যেহেতু আমেরিকা যুক্ত তাই এগুলির রপ্তানির ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের কোনো ভূমিকা নেই বললে চলে। অন্য দেশের বিষয় হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ফতোয়া জারি করতে পিছিয়ে যেত না। তবে এব্যাপারে হু (WHO) হস্তক্ষেপ করতে চাইলে ভারতের পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করা হয়নি।

টিকার বিজনেস মডেল

এই মডেলে আছে আমেরিকার দরাদরি, টিকার বাজারিকরণ, কেন্দ্রীয় ও অধিকাংশ রাজ্য সরকারের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত প্রস্তুতির অভাব, প্রতারিত মানুষের উপর অত্যাচার নামিয়ে আনা ইত্যাদি। ইতিমধ্যে সরকারি অনুপ্রেরণায় সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক টিকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনি ভাবছেন তো টিকা বিনা পয়সায় দেওয়া হতো, তাহলে দাম বাড়ল কী করে? নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন যে, আমাদের ট্যাক্সের টাকা থেকে ৯০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার এদেশের দু’টি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থাকে দিয়েছে। টিকার আবার তিন রকমের দামের অর্থ কি? কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এক দাম আর রাজ্য সরকারের জন্য এক দাম, এমনটা কেন? এছাড়া আছে উৎপাদনের ৫০ শতাংশ ভ্যাকসিন খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার দাম যে কি হবে তার কোনো হিসাব নেই। অক্সিজেনের মতো মজুতদার এবং কালোবাজারিদের হাতে চলে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকার টিকা দেবে কোথায়? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। ওখানে কি শাসকদলের লোক বেছে বেছে দেবে নাকি? কারণ ওই রাজ্য তো টিকা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। একবার ভাবুন তো অতীতে কোনোদিন কোনো টিকা যা সবাইকে দিতে হয় তার জন্য নাগরিকদের কোনো অর্থ দিতে হয়েছে? যেমন ধরুন গুটি বসন্ত, পোলিও, বিসিজি ইত্যাদি। আত্মনির্ভর বা স্বনির্ভর ভারতের প্রধান লক্ষ্য তো রোগমুক্ত ভারতবাসী।

কেবল টিকা নয়, করোনা চিকিৎসায় অন্য যে ওষুধ লাগে তার উপর জিএসটি এখন অব্যাহত। অনেক সমালোচনার পর জীবনদায়ী অক্সিজেনের উপরে চাপানো জিএসটি এই সেদিন তুলেছে সরকার। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের পূর্বে বিনা পয়সায় টিকার আশ্বাস দিয়ে ঠিক নির্বাচনের পর টিকার দাম বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা - তা যে পুর্বপরিকল্পিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এদেশে ১৮ বছর থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে টিকার অনুমতি প্রদান করে বাহবা নেওয়া, অন্যদিকে টিকার জোগানে রাস টানার ব্যবস্থা - সবই এই বিজনেস মডেলের অংশ। এই ঘোষণার আগে টিকা তৈরির কোনো প্রস্তুতি সরকার নেয়নি বরং টিকা তৈরির উপকরণ প্রাপ্তির কোনো ব্যবস্থা করেনি। পুরোপুরি কর্পোরেট নির্ভর এই সরকার ভারতের জনগণের উপর সর্বনাশ চাপিয়ে দিয়েছে।