৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
কান্নুরে বর্ণময় আয়োজনের সমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পার্টি কংগ্রেস
বিশেষ সংবাদদাতাঃ কৃষক বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিপ্লবী ভূমি কেরালার কান্নুর সিপিআই(এম)’র ত্রয়োবিংশতিতম কংগ্রেসের জন্য নানাভাবে সাজানো হয়েছে। ৬ থেকে ১০ এপ্রিল কান্নুরের ই কে নায়নার একাডেমিতে এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উপলক্ষে কান্নুরের এ কে জি নগরের জওহর স্টেডিয়ামে প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ই কে নায়নার নগরের ই কে নায়নার একাডেমিতে বিশেষভাবে নির্মিত প্রেক্ষাগৃহে এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে ‘ইতিহাস এক অস্ত্র’ শিরোনামে কে বরদারাজন নগরে ৩০ মার্চ থেকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের একটি ঐতিহাসিক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। ছবি এবং ভাস্কর্যের মাধ্যমে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার গ্রাফিক বিবরণ এতে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন ঘটনাও প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়াও এই প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থান সম্পর্কিত বিষয়ও চিত্রিত হয়েছে। মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিনের ভাষ্কর্যও স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে।
এই প্রদর্শনীর আরেকটি দিক হলো এতে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস সহ বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতির ঘটনাবলিও তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শনীতে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি তামিলনাডুর কিলভেনমণির শ্রমিকদের হত্যার হৃদয় বিদারক দৃশ্যও চিত্রিত হয়েছে। এছাড়াও প্রদর্শনীতে মহান পুন্নাপ্রা, ভায়লার এবং কারিভেল্লুর সংগ্রাম, সমাজ সংস্কার বিষয়ক ভাস্কর্য এবং শহিদদের প্রতিকৃতিও স্থান পেয়েছে।
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে সজ্জিত ই কে নায়নার একাডেমির প্রবেশদ্বার।
এই কংগ্রেস উপলক্ষে ১ এপ্রিল থেকে নিরুপম সেন নগরে আন্তর্জাতিক পুস্তক উৎসবের সূচনা হয়েছে। এই পুস্তক উৎসবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ৮০টির বেশি প্রকাশক অংশ নিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জনগণের মাধ্যমে গ্রন্থাগার প্রসারের নজিরবিহীন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের মধ্যদিয়ে জেলায় প্রায় ১১৪টি নতুন গ্রন্থাগারের সূচনা হয়েছে। এই বই উৎসবের সাহায্যে নতুন গ্রন্থাগারগুলিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুস্তক প্রদানের সুযোগ তৈরি সহ এই আন্দোলনের অংশীদার হতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
সিপিআই(এম)’র ত্রয়োবিংশতিতম কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এগুলিতে অংশ নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষরাও। মোট নির্ধারিত ২৭টি সেমিনারের মধ্যে ইতিমধ্যেই ২০টি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন একটি অধিবেশনে অংশ নিয়েছেন।
১ এপ্রিল জনজীবনের বিভিন্ন অংশের মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিকেল ৫টা থেকে ৫.১৫ পর্যন্ত থালাসেরির জওহরঘাট থেকে কমরেড এ কে গোপালনের মূর্তি পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ কিলোমিটার বিস্তৃত পার্টির একটি পতাকা তুলে ধরেন। প্রসঙ্গত, এই থালাসেরিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড আবু এবং কমরেড চাথুকুট্টিকে গুলি করে মারা হয়েছিল। এর পাশাপাশি কমরেড এ কে জি’র মূর্তির সামনে থেকে কারিভেল্লুর পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পার্টির রক্ত পতাকা তুলে ধরেন। যা কান্নুরের উত্তর সীমান্ত এবং থালাসেরি থেকে মাহে-পুজ্ঝিথালা জাতীয় সড়ক পর্যন্ত কান্নুর জেলার দক্ষিণ সীমান্ত অবধি বিস্তৃত। এই দিনটিকে রক্তপতাকা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, সারস্বত ব্যক্তিত্ব, পণ্ডিত, পরিবেশবিদ এবং সমাজকর্মী সহ সমাজের সমস্ত অংশের মানুষ এই ঐতিহাসিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে মশালবাহী মিছিল।
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে স্থানীয়স্তরে ভলিবল ও ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কান্নুরের বিশিষ্ট ভলিবল খেলোয়াড় জিমি জর্জের স্মৃতিতে সহস্রাধিক খেলোয়াড় ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।
কায়ুর বিপ্লবীদের শহিদি বরণের বার্ষিকী কান্নুর জেলায় পতাকা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। এই উপলক্ষে কান্নুরে পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক দপ্তর সহ পার্টির কান্নুর জেলা কমিটির দপ্তর, পার্টির ১৮টি এরিয়া কমিটির দপ্তর, ২৪৩টি আঞ্চলিক কমিটি দপ্তর, ৪২৪৭টি শাখায় এবং ৬১,৬৮৮ জন পার্টি সদস্য ও সমর্থকদের বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কান্নুরে পার্টি কংগ্রেসের বার্তা নিয়ে ১ এপ্রিল থেকে জেলাব্যাপী মিছিল সংগঠিত হয়েছে। জেলার বিভিন্নপ্রান্তে মহিলা কমরেডদের সাইকেল মিছিল ও বাইক মিছিল হয়েছে। এছাড়া পার্টি কংগ্রেসের বার্তা নিয়ে যুবদের মিছিলও সংগঠিত হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কমিউনিস্টদের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়। এই সমস্ত আন্দোলনে জড়িত কমরেডদের সংক্ষিপ্ত জীবনীচিত্রের সাহায্যে অভিনব কর্মসূচি চালানো হয়েছে। ‘কান্নুর ম্যানিফেস্টো’ শীর্ষক এই অনলাইন ভিডিয়ো সিরিজে কমরেডদের জীবনের বিভিন্ন স্তরে পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত তাঁদের জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই ভিডিয়ো সিরিজটি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
চিত্রশিল্পীদের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে জেলার শতাধিক স্থানে দেওয়াল চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। স্থানীয় চিত্রশিল্পীরা গ্রাফিতি ও চিত্রাঙ্কনের সাহায্যে শিল্পের বিভিন্ন অংশ সৃষ্টি করেছেন। এই দেওয়াল চিত্রের সাহায্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অপরূপভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।
পার্টি কংগ্রেসে গ্রিন প্রোটোকল মেনে একক ব্যবহার যুক্ত প্লাস্টিককে এড়ানো হয়েছে। সমস্ত পরিবেশ বান্ধব উপকরণ ও সম্পদ ব্যবহার করা হয়েছে।
পার্টির বিভিন্ন শাখার উদ্যোগে অভ্যর্থনা কমিটির অফিস তৈরি হয় এবং সেখানে আকর্ষণীয় ও শৈল্পিক সজ্জার মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা দেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পার্টির প্রতিটি আঞ্চলিক কমিটি কেরালার উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনার সংগঠিত করে। এই সেমিনারগুলো সংগঠিত করার উদ্দেশ্য ছিল বিকল্প উন্নয়ন কৌশল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের খোলামেলা আলোচনাকে উৎসাহ দেওয়া। বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ এই সেমিনারগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
পার্টির প্রতিটি শাখা তাদের এলাকায় পারিবারিক জমায়েতের উদ্যোগ নেয়। এই জমায়েতগুলোর মধ্যদিয়ে পার্টি কংগ্রেসের বার্তা নিচুতলা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের সমাবেশের সাহায্যে পার্টি কংগ্রেসের তাৎপর্য এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
পার্টি কংগ্রেসের জন্য তহবিলের বড়ো অংশই সংগৃহীত হয়েছে নিচুতলার পার্টি সদস্য এবং শুভানুধ্যায়ীদের বাড়ি বাড়ি থেকে। সাধারণ মানুষও তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আন্তরিক সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।
টি পদ্মনাভন, কে সচ্চিদানন্দন, এম মুকুন্দন সহ বিশিষ্ট সাহিত্যিক আরও অনেকেই বিভিন্ন উদ্যোগে প্রত্যক্ষভাবে শামিল হয়েছেন।
পার্টির ২৩তম কংগ্রেস উপলক্ষে লোগো প্রকাশিত হয়েছে এবং অভ্যর্থনা কমিটি গোটা সপ্তাহ ধরে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে চলেছে পার্টি কংগ্রেসকে সফল করার লক্ষ্যে।
এই কংগ্রেসের সমাপ্তি হবে ২০০০ রেড ভলান্টিয়ারের মিছিল এবং প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে।
সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে স্পন্দিত কান্নুরে এই ঐতিহাসিক সম্মেলন সফল করার জন্য আন্তরিক সমর্থন উজাড় করে দিয়েছেন।