৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করাই হলো এই মুহূর্তের প্রধান কাজ
২৩তম পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব উত্থাপন করলেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্টির সামনে প্রধান কাজ হলো বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন করা এবং পরাস্ত করা - সিপিআই(এম)’র ২৩ তম কংগ্রেসে পেশ করা খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে সমগ্র পার্টির কাছে এই দায়িত্বই হাজির করা হয়েছে। পার্টির এই রাজনৈতিক লাইন কার্যকর করতে হলে আরএসএস-বিজেপি’র কাজকর্ম ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এর জন্য জরুরি হলোঃ পার্টি ও বামেদের স্বাধীন শক্তির বিকাশ। বামঐক্য গড়ে তোলা এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহৎ সমাবেশ ঘটাতে পার্টির ধারাবাহিক কাজ । গত ৬ এপ্রিল কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেন, এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে বহুমাত্রিক স্তরে। মতাদর্শগতভাবে, সামাজিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহই শুধু নয়, এই রাজনীতির বিরুদ্ধে থাকা সংগঠন, সামাজিক আন্দোলন এবং নাগরিকরাও যাঁরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁদেরও নিয়ে এসে গড়ে তুলতে হবে যতদূর সম্ভব বৃহৎ ঐক্য। হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির কাজকর্মের মোকাবিলায় এটাই সবচেয়ে বেশি দরকার। প্রসঙ্গত, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্টির সর্বস্তরে আলোচনা এবং এর ওপর মতামত দেওয়ার জন্য কংগ্রেসের দুমাস আগে রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথেই আগ্রাসী নয়াউদারনীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। এই প্রসঙ্গে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, এই দুই লড়াইকে আলাদাভাবে দেখা যাবে না। বেপরোয়া জাতীয় সম্পদের লুঠ, বৃহৎ আকারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, জনপরিষেবা এবং খনিজ সম্পদের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিস্তৃত অংশের জনগণকে সমবেত করার কাজে সম্মুখসারিতে থাকবে পার্টি। কৃষক আন্দোলনের মতো গণ ও শ্রেণি আন্দোলনকে তীব্র করেই উদারনীতির বিরুদ্ধে জনগণের সমাবেশ এবং করপোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে এক জায়গায় নিয়ে আসা যাবে। এই সমাবেশে গণসংগঠন ও সামাজিক আন্দোলনগুলিকেও শামিল করার প্রয়াস নিতে হবে পার্টিকে। বামেদের ঐক্যবদ্ধ প্রচার আন্দোলনে এবং লড়াই-সংগ্রামে বুর্জোয়া-ভূস্বামী শাসকশ্রেণির নীতির বিরুদ্ধে বাম এবং গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে তুলে ধরতে হবে।
এই বাম এবং গণতান্ত্রিক কর্মসূচি রাজনৈতিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্মসূচি হলোঃ অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে রক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধিকারকে বজায় রাখা, অদক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মাসে ২১ হাজার টাকা, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ, সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা, রেগায় শ্রমদিন ও মজুরি বৃদ্ধি, সর্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নয়া শিক্ষা নীতি বাতিল,পরিবেশ নিয়ে সুসংহত নীতি প্রণয়ন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ, স্বাধীন বিদেশ নীতি, মহিলা সংরক্ষণ বিল সংসদে পাশ, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, মহিলাদের ওপর সমস্ত ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করা প্রভৃতি।
মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত সাধারণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। সীতারাম ইয়েচুরি এ প্রসঙ্গে বলেন, বিজেপি সরকার সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধিকারের ওপর আঘাত নামিয়ে এনেছে। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপসাধন করা হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন লাগু করেছে সরকার। এনআরসি প্রণয়ন করার চেষ্টা চলছে। ইউএপিএ,এনএসএ’র মতো দানবীয় আইনগুলিকে যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে শাসকদলের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তের সংখ্যা ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শাস্তি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশের। আঘাত এসেছে সামাজিক ন্যায়ের ওপর। দলিত, আদিবাসী মানুষদের ওপর আরও বেশি সামাজিক নিপীড়ন সংঘটিত হচ্ছে। জনগণের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নজরদারি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন তদন্ত সংস্থাগুলির মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলির কাজকর্মে হস্তক্ষেপ বাড়ছে। শাসকদল এই সংস্থাগুলিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে খর্ব করা হচ্ছে। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ভারত রাষ্ট্রের এই স্তম্ভগুলিকে ধ্বংস না করে আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে কোভিড মহামারী জনগণের রুজি রোজগারের ওপর যে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রস্তাবে। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে মহামারীজনিত মন্দায় মাত্র এক বছরে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি থেকে বেড়ে ১৩ কোটি ৪০ লক্ষ হয়েছে। ২০২১ সালের শেষে আরও ১৫ থেকে ২০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হতে পারে বলে অনুমান। এরফলে ভারত আবার ৪৫ বছর পর গণ দারিদ্র্যের দেশে পরিণত হতে চলেছে। ভারতের শহরাঞ্চলে এখন ৯ কোটি বেকার। শহরাঞ্চলের ২৩ শতাংশ যুবকের কোনো কাজ নেই। ২০২১ সালে কর্ম সংকোচন ঘটেছে ৩৮ কোটি। মহামারী অনাহার ভীষণভাবে বাড়িয়েছে। ২০২১ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান ১০১ থেকে অবনমন ঘটে ১১৬ হয়েছে । পেট্রোপণ্য সহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছ । শুধু পেট্রোপণ্য থেকেই ২০১৮-২০২১ সালের মধ্যে জনগণের কাছ থেকে ৮ লক্ষ ২ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক ও করপোরেটের মধ্যে আঁতাতের বিষয়টি বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচিত হয়েছে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে। বলা হয়েছেঃ বিলগ্নিকরণের মধ্যদিয়ে জাতীয় সম্পদের লুট চলছে। গত ৭ বছরে ১০ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা করপোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্কঋণ মকুব করেছে সরকার, স্টিমুলাস প্যাকেজের নামে করপোরেট সংস্থাগুলিকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা করছাড় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৮-১৯ এবং ১৯-২০ বর্ষে এই করছাড়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ লক্ষ কোটি টাকা।এর পরিণতিতে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়ঙ্করভাবে। ভারতে ১০ জনের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের নিচের দিকের ৫০ শতাংশ জনগণের হাতে রয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ সম্পদ। বিজেপি সরকার নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দুর্নীতিকে আইনি করেছে। বিদেশ নীতি প্রসঙ্গে রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিজেপি সরকার স্বাধীন বিদেশ নীতির সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ভারতকে ক্রমশ আমেরিকার সামরিক পার্টনারে পরিণত করছে।
দেশের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপি বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চহারে এক জায়গায় সমবেত করতে পার্টিকে যথাযোগ্য নির্বাচনী কৌশল গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, শুধু নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে নয়, সর্বক্ষেত্রে আরএসএস-বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে এই দক্ষিণপন্থী শক্তিকে পরাস্ত করতে।