E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮

সিপিআই(এম)-র ত্রয়োবিংশতিতম কংগ্রেস


গত কংগ্রেসের পরবর্তী সময়ে শহিদ ৬৭ জন পার্টির নেতা-কর্মী

পার্টির পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এবং গণআন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গত কংগ্রেসের পরবর্তী চার বছরে সারা দেশে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস সহ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে ৬৭ জন পার্টি সদস্য কর্মী শহিদ হয়েছেন। শহিদের তালিকা সবচেয়ে দীর্ঘ পশ্চিমবঙ্গে। এই সময়কালে ৩৪ জন এই রাজ্যে শহিদ হয়েছেন। পার্টিনেতা ও কর্মী শহিদের সংখ্যা ত্রিপুরায় ২০, কেরালায় ১৩ এবং বিহারে ১।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন ৩৩ জন এবং চাকরির দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে নিহত হন যুবনেতা মইদুল ইসলাম মিদ্দা। ত্রিপুরায় বিজেপি’র গুন্ডারা খুন করেছে ১৮ জন সিপিআই(এম)’র নেতা-কর্মীকে। এই রাজ্যে পার্টির ২ জনকে খুন করেছে সন্ত্রাসবাদীদের মদতদাতা রাজনৈতিক দল আইপিএফটি। কেরালায় আরএসএস খুন করেছে পার্টির ৭ জন নেতা কর্মীকে। এছাড়াও ৪ জনকে খুন করেছে কংগ্রেস, এসডিপিআই এবং মুসলিম লিগের হাতে খুন হয়েছেন একজন করে পার্টিকর্মী। বিহারে জমিদারদের গুন্ডাবাহিনী খুন করে পার্টি নেতা জগদীশচন্দ্র বসুকে।

পার্টি কংগ্রেসে শহিদ স্মরণে ও শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার। বিগত চার বছরে পার্টি হারিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩ জন বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যকে।

আন্দোলনের ভূমি কান্নুর

দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র কান্নুর। কেরালার উত্তরে অবস্থিত। এই প্রথম সিপিআই(এম)’র কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে কান্নুরে। যদিও এর আগে চারবার পার্টি কংগ্রেস হয়েছে কেরালায়। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস হয় পালঘাটে এবং সিপিআই(এম) প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর হয় কোচিন, তিরুবনন্তপুরম এবং কোঝিকোডে। স্বাধীনতা সংগ্রাম,শ্রমজীবী মানুষের দাবি আদায়ের সংগ্রাম এবং গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের এক গৌরবজনক ইতিহাসের অধিকারী কান্নুর।

১৯৩৭ সালে শ্রমিক অধ্যুষিত কালিকটের চেরুভান্নুরে এক সভায় কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট গ্রুপ তৈরি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এস ভি ঘাটে ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এই কমিউনিস্ট গ্রুপের সদস্যরা ছিলেন পি কৃষ্ণ পিল্লাই, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এন সি শেখর এবং কে দামোদরন। এরপর কান্নুর জেলার পিনারাই গ্রামে পারাপরমে বিবেকানন্দ ভায়ানাসালা নামক এক রিডিং রুমে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে হয় এক গোপন সভা। কালিকটে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট গ্রুপের সদস্যরা সহ ৯০ জন বিশিষ্ট নেতা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। আনজারাকান্ডি, ধর্মাদাম এবং ম্মাক্কুনু নদী দিয়ে তিনদিক বেষ্টিত পারাপরম ছিল জনজীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি স্থান। সভা চলত রাত্রিতে। এই সভাই কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা সম্মেলন। সভায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁরা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্ব হিসেবে কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে কাজ করতেন। এই সম্মেলন থেকে পি কৃষ্ণ পিল্লাই সম্পাদক নির্বাচিত হন। কেরালার কমিউনিস্ট ও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কৃষ্ণ পিল্লাইয়ের নামের সাথে ‘সাখুভা’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘কমরেড’। তিনিই ছিলেন কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট।

স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিভিন্ন কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনই ছিল কান্নুরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার উৎস। উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যুদ্ধবিরোধী সংগ্রাম। দুর্ভিক্ষ ও মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতিতে শ্রমিক, কৃষক সহ সাধারণ মানুষকে যুদ্ধবিরোধী সংগ্রামে সংগঠিত করে পার্টি। এই সংগ্রামের চারটি প্রধান কেন্দ্র ছিল মোরাঝা, মাট্টান্নুর, থালাসারি এবং কুথুপারামবা। ১৯৪০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এই সংগ্রামে স্কুল শিক্ষক আবু এবং বিড়ি শ্রমিক ছাথুকুট্টি পুলিশের গুলিতে মারা যান। এঁরা দু’জন হলেন কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট শহিদ।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর ১৯৪১ সালে পূর্বতন দক্ষিণ কানারা জেলার কায়ুরে সামন্ত জমিদার এবং রাজাকে জমি লিজের বকেয়ার না দেওয়ার দাবিতে কৃষকদের সংগ্রাম শুরু হয়।ব্রিটিশরা পাশবিক নিপীড়নের মধ্যদিয়ে কৃষকদের এই সংগ্রামকে দমন করে। ১৯৪৩ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেসের কিছুদিন আগে এই সংগ্রামের নেতা চার তরুণ কমরেড মাদাথিল আপ্পু, কুনহমবু নায়ার, চিরুকান্দন এবং আবুবাকের-কে ব্রিটিশরা ফাঁসি দেয়। স্বাধীনতার পরও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য কান্নুর বহন করে চলেছে। বর্তমানে জেলা হিসেবে কান্নুরেই দেশের মধ্যে সিপিআই(এম)’র সবচেয়ে বেশি পার্টি সদস্য রয়েছে।

এই কান্নুর কেরালা তথা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই মহান নেতা কমরেড এ কে গোপালন এবং ই কে নায়নারের জন্ম এবং কর্মস্থল। কমিউনিস্ট নেতা শহিদ আঝিক্কোডন রাঘবনের জন্মস্থানও হলো কান্নুর। বামফ্রন্টের আহ্বায়ক থাকার সময় তিনি শহিদ হন। পার্টির কেরালা রাজ্য কমিটির দুই প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড সি এইচ কানারন এবং কমরেড সি গোবিন্দনও এই কান্নুরেরই মানুষ ছিলেন।

কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা ৩২ ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির

সিপিআই(এম)’র ২৩ তম কংগ্রেসের সাফল্য কামনা করে বিভিন্ন দেশের ৩২টি ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছে। ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলি হলোঃ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি, উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি, লাও পিপলস পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ান ফেডারেশন, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি, ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল(ইউ এম এল), জাপানের কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রীলঙ্কার জেভিপি, স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব তার্কি, সাইপ্রাসের কমিউনিস্ট পার্টি, ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি, ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টি, পর্তুগালের কমিউনিস্ট পার্টি, আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টি, চিলির কমিউনিস্ট পার্টি, জার্মানির কমিউনিস্ট পার্ট, বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি। সম্মেলনে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির এবং উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি ও লাও পিপলস পার্টির অভিনন্দন বার্তা পাঠ করেন পলিট ব্যুরো সদস্য এম এ বেবি।

খসড়া প্রস্তাবের ওপর সংশোধনী

সিপিআই(এম)’র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব কংগ্রেসের দু’মাস আগে প্রকাশ করা হয় পার্টির সর্বস্তরে আলোচনার জন্য। পার্টিতে সমস্ত স্তরের সদস্যরা এই খসড়া প্রস্তাবের ওপর মতামত জানাতে পারেন, সংযোজনী ও সংশোধনী পাঠাতে পারেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে। বিবেচিত সংশোধনী ও সংযোজনীগুলি পার্টি কংগ্রেসে পেশ করা হয়। পার্টি গণতন্ত্রের এই অনুপম অনুশীলন এবারের সারা দেশের পার্টির সর্বস্তরে হয়েছে। ত্রয়োবিংশতিতম কংগ্রেসে সারা দেশ থেকে ৪০০১টি সংশোধনী এসেছে। কংগ্রেসে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশের সময় সারা দেশ থেকে আসা বিবেচিত সংশোধনী ও সংযোজনীগুলি পেশ করেন সীতারাম ইয়েচুরি।

পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রস্তাব

এনডিএ জমানায় পেট্রোপণ্যের ওপর যে কর চাপানো হয়েছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানালো সিপিআই(এম)’র ২৩তম কংগ্রেস।

কংগ্রেসের দ্বিতীয় দিনে ‘পেট্রোল এবং ডিজেলে দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের আহ্বান’ শীর্ষক প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি কংগ্রেসে পেশ করেন টমাস আইজাক। সমর্থন করেন স্বদেশ দেবরায়।

প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছেঃ ধনীদের ওপর কর চাপানো হোক এবং পেট্রোপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও কমানো হোক। পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্রের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে।

জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর নজিরবিহীন আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিরাট আকারে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে সারাদেশের জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছে পার্টি কংগ্রেস।


শংকর মুখার্জি