৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচন
পাড়ায় পাড়ায় উৎসাহ সিপিআই(এম) প্রার্থীকে ঘিরে
প্রচারে সিপিআই(এম) প্রার্থী সায়রা হালিম।
বামফ্রন্ট প্রার্থীর বিপুল গ্রহণযোগ্যতার জেরে নিজেদের প্রার্থী লুকোচ্ছে তৃণমূল। বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচন নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছে তৃণমূল। কারণ এখানে তৃণমূলের প্রার্থীকে নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়ার মুখ নেই। তাই পুরনো কায়দা অনুযায়ী বিধানসভার অন্তর্গত বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে তৃণমূল কাটা রেকর্ডের মতো বলছে, মমতা ব্যানার্জিই প্রার্থী এই কেন্দ্রে। তাই ৬০, ৬১, ৬৪, ৬৫ ওয়ার্ডের দেওয়াল লিখনে তৃণমূল প্রার্থীর নাম নেই। শুধু প্রতীক চিহ্ন রয়েছে। যদিও বা দু-এক জায়গায় দেওয়ালে তৃণমূলের বিজেপি ফেরত প্রার্থীর নাম লেখা হয়েছে সেখানে ঝাঁ-চকচকে ব্যাপারটাই উধাও। দায়সারাভাবে উল্লেখ রয়েছে।
প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়কে নিয়ে কেন এই পরিস্থিতি সে কথায় আসার আগে এই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী সায়রা হালিম কেমন অভ্যর্থনা পাচ্ছেন ওয়ার্ডগুলিতে সে সব একটু দেখে নেওয়া যাক।
বাসিন্দারা বলছেন, ইয়ে লোগ পুরানা চাওয়াল হ্যায়। পুরানা আদমি হ্যায় জিসকা ইলাকে মে বুনিয়াদ হ্যায় (এই প্রার্থী এবং তাঁর দল পুরনো চালের মতো। এই এলাকায় এদের শিকড় রয়েছে দীর্ঘদিন)। সকালের ব্যস্ততার মধ্যেই বস্তির দরজায় দরজায় পৌঁছে যাওয়া বাম প্রার্থী সায়রা হালিমকে দেখে প্রাথমিক মুগ্ধতা চেপে রাখছেন না মহল্লার বাসিন্দারা।
বামফ্রন্ট ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যালঘু মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচবার প্রশ্নে আপসহীন - একথা প্রকাশ্যেই বলছেনও তাঁরা। বলছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে। ৩৪ বছরের বাম জমানায় সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেবার ইতিহাস, দাঙ্গাইদের অর্থাৎ দাঙ্গাবাজদের মেরুকরণের মাথা ভেঙে দেবার দাওয়াই দেবার কথা জোর গলায় জ্যোতি বসু- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের বলতে শুনেছেন তাঁরা - আলাপচারিতায় প্রবীণদের গলায় উঠেও আসছে সেসব। হঠাৎ এসবই বলছেন কেন। বলার কারণ অভিযোগ রয়েছে প্রাক্তন বিজেপি সাংসদের আসানসোল দাঙ্গায় মদত থেকে সিএএ চালু করার ক্ষেত্রে খুলে আম ধমকি দেবার, ভয় দেখানোর। সেসব লব্জ মনে রেখেছেন এখানকার মানুষ। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তার সেসব সোনায় মোড়া সাম্প্রদায়িক মন্তব্য এখনও ভাইরাল। বলার কারণ তৃণমূলের দ্বিচারিতা। মুখে বিজেপি’র বিরোধিতা করলেও প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কেন প্রাক্তন সাংসদের অবনতি ঘটিয়ে এখানে আনা হলো তার জবাব দেবার মুখ নেই।
মুখ নেই ভোট চাওয়ার। হাজার টাকা পেরনো গ্যাসের দাম, পেট্রোল-ডিজেলের সেঞ্চুরি পার করা দাম নিয়ে নাভিশ্বাস গরিব মানুষের। তাদের কাজ নেই। প্রতিদিন জিনিসের দাম বাড়ছে। সেসব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ নেই মমতা ব্যানার্জিদের - সোচ্চারে এসব কথা তুলে ধরছেন তাঁরা বাম প্রার্থীর সামনে।
বাম প্রার্থী সায়রা হালিম বলছেন, এই ভোট হুকুমত অর্থাৎ রাজ্যের শাসকদলকে বদলাতে পারবে না, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সবক শেখানো যাবে কেন্দ্র এবং রাজ্যের ক্ষমতাসীন দুই দলকেই। বেনিয়াপুকুর, ওস্তাগর লেন, থেকে জাননগর রোড - সিএএ বিরোধী আন্দোলনে এখানকার মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করেছেন সে সময়। লাগাতার অবস্থান করেছেন। তাদের মনে আছে সরকার তাদের পাশে থাকে নি। বামফ্রন্ট পাশে ছিল তাঁদের। আর এই বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে থাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা আনিস খানকে হত্যা থেকে তৃণমূলী ছাত্র নেতা গিয়াসউদ্দিনের অধ্যক্ষকে গালিগালাজ থেকে খুনের হুমকি সবটাই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। মুখ্যমন্ত্রীর পাশ কাটানো মন্তব্য ‘ওরা অল্প কটু কথা বলেছে’ গোটা বিধানসভা ক্ষেত্রের মানুষই ভাল ভাবে নিচ্ছেন না।
কলকাতা শহরের অন্যত্র ওয়ার্ডগুলিতে যেসব তৃণমূলী অপকর্ম চলে বালিগঞ্জ তার ব্যতিক্রম নয়। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বস্তা ঢাকা দেওয়া বেআইনি নির্মাণ মাথা উঁচু করেছে একাধিক জায়গায়। তোলা আদায়ের তৃণমূলী মেশিনারি মসৃণভাবে কাজ করে এখানে। কিন্তু পাশে শাসকদলকে পান না মানুষ। ৬০ বছর বয়স্ক নাজমা বেগম এবং তাঁর প্রতিবেশীরা বলছিলেন বেওয়া কার্ড অর্থাৎ বিধবাদের জন্য কার্ডের নথিভুক্তি লাইন থেকে কিভাবে পুলিশ দিয়ে তাঁদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নাম লেখা হয়নি।
এখানে আভিজাত্যের পাশাপাশি রয়েছে সীমাহীন দারিদ্র্যে হাঁসফাঁস করতে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাজ না পাওয়ার, কাজ হারানোর গুমরানো মন। তারা বাম প্রার্থীকে আশ্বস্ত করে বলছেন হামারা জমির সাথ নেহি দেগা উন লোগো কো ভোট দেনে কে ওয়াস্তে (হৃদয় সাড়া দিচ্ছে না ওদের আবার ভোট দিতে)। এখানে বস্তিতে মহল্লায় গরিব মানুষ ঘরে বসে চপ্পলের কাজ এবং বাক্স বানানোর কাজ করে জীবিকা অর্জন করেন। কিন্তু লকডাউনের জেরে কমেছে চাহিদা, তাই অনিশ্চিত হয়েছে এদের রোজগার। পানীয় জল এখানে নেই যা বাম জমানায় অমিল ছিল না। অপরিসর গলিগুলি জলের অপেক্ষায় থাকা ড্রামের ভিড়ে আরও অপরিসর হয়েছে। সার দিয়ে চারতলা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচে অচল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাকা দেওয়া পরপর বাইক স্কুটার। জ্বালানি তেলের দাম নাগাল ছাড়া হওয়াতেই গণপরিবহণে সওয়ার হচ্ছেন তুলনায় অবস্থাপন্ন মানুষ। সমাজকর্মী সায়রা হালিমের পরিচয়ের অন্য মাত্রায় এখানের মানুষ সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করছেন। প্রবাদপ্রতিম বামফ্রন্ট নেতা হাসিম আব্দুল হালিমের পুত্রবধূ তিনি, প্রখ্যাত চিকিৎসক ফুয়াদ হালিমের সহধর্মিনী। অভিনেতা এবং সমাজমনস্ক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিন শাহ এখানে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন সায়রা হালিমকে ভোট দেবার জন্য। তাই সব মিলিয়ে ব্যাকফুটে তৃণমূল। মুখ লুকোচ্ছে তৃণমূল।
সদ্যসমাপ্ত কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার রাগে ফুঁসছেন বালিগঞ্জের বড়ো অংশের মানুষ। বলছেন ও কমিনা লোগ ভোট নেহি দেনে দিয়া। ওরা আমাদের ভোট দিতে দেয়নি। তাই অঘটন ঘটতে চলেছে। বাবুল সুপ্রিয় টুপি পাঞ্জাবি লুঙ্গি পড়ে যতই ভেক ধরুন না কেন, ভোটের বাক্সে পৌঁছে মানুষ তার দ্বিচারিতার জবাব দেবেনই। এসব আঁচ করেই মুখ লুকোচ্ছে তৃণমূল।