৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চরম হেনস্তার প্রতিবাদ-ধিক্কার রাজ্যজুড়ে
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও যে চরম নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও দুর্নীতি চলছে, তার সাম্প্রতিকতম নজির হচ্ছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিগ্রহের ঘটনা। গত ১ এপ্রিল গুন্ডামির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত তৃণমূলের ছাত্রনেতা গিয়াসউদ্দিন তার দলবল নিয়ে উপাচার্য মহম্মদ আলির ঘরে ঢুকে তাঁকে দীর্ঘ সময় ঘেরাও করে অত্যন্ত কদর্য ও নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে, মারধরের হুমকি দেয় ও তাঁর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। উপাচার্য পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ যায়নি। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী উপাচার্যের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়াসউদ্দিন ও তার বাহিনীকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ফোন কলের রেকর্ডিংও প্রকাশ্যে চলে আসে। তাতে এক তৃণমূল নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘পুলিশকে বলা আছে পুলিশ যাবে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এই অডিয়ো ক্লিপের কণ্ঠস্বর তৃণমূলের হয়ে ভোট প্রচার করা তৃণমূলের এক নেতার বলে জানিয়েছেন।
এদিনের ঘটনার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় রাজ্যজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্তার প্রতিবাদ জানিয়ে রাজ্যে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেই রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনা থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলার ঘটনা সমানে চলছে। এ সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, সেটাও প্রকট হয়ে উঠছে। এই সমস্ত ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্যের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। সেই সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন সহ সমস্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে। এই ঘটনায় রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় ৩ এপ্রিল গিয়াসউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসএফআই রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমান ও সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ন্যায্য দাবিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, আমরা তার প্রতি সংহতি জানাই। এই ছাত্র আন্দোলনেরই কর্মী ছিলেন আনিস খান, যাঁকে পুলিশ দিয়ে খুন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপাচার্যের বিরুদ্ধে টিএমসিপি নেতারা যে অমানবিক নিন্দনীয় আচরণ করেছে, তার প্রতিবাদে সোমবার (৪ এপ্রিল) রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভের আবেদন জানাচ্ছি।’
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্তার তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, রাইট টু এডুকেশন ফোরাম, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সহ বিভিন্ন সংগঠন।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্তার ঘটনাতেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যুক্ত বলে অভিযোগ করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। গত ৩ এপ্রিল তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা কেবল একদিন একজন উপাচার্যকে হেনস্তা করার ঘটনা নয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার জন্য মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে যে ধারাবাহিক অপচেষ্টা চলছে, এই গুন্ডামি ও মস্তানি তারই অংশ। উপাচার্যের হেনস্তার জন্য কেবল তৃণমূলের ছাত্রনেতা গিয়াসউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করলে হবে না। এর পিছনে যে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যুক্ত, তাঁদের ধরতে হবে। তাঁদের কথাতেই পুলিশ উপাচার্যকে রক্ষা করতে যায়নি।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূলী ছাত্রনেতার গুন্ডামি কেবল একটি অসভ্যতার ঘটনা হিসেবে দেখতে নারাজ সেলিম। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৈরি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে একটি উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার পথ থেকে বিচ্যুৎ করা হচ্ছে এবং ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের হেনস্তাকে দেখার কথা বলেন তিনি। সেলিম বলেছেন, পার্ক সার্কাসে আলিয়ার জমি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্বাধীনতার আগে থেকে বরাদ্দ ছিল। বামফ্রন্ট সরকার সেখানে একটি আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য যখন উদ্যোগ নিয়েছিল, তখনই কিছু ব্যবসায়ী এবং উচ্চপদস্থ আমলা ওখানে বাণিজ্যিক ও বসবাসের বিল্ডিং গড়তে চেয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি এবং কিছু মিডিয়া তখন থেকেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কেন, মাদ্রাসা নয় কেন বলে তখন থেকেই চিৎকার করেছেন। তিনি বলেন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি চলছে, অযোগ্যদের নিযুক্ত করা হচ্ছে, শিক্ষার পরিকাঠামো ও পরিবেশকে ক্রমাগত ধ্বংস করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধেই তো আলিয়ার ছাত্র আনিস খানরা লড়াই করছিলেন।
তিনি বলেন, এই রাজ্যে এখন এমন সরকার যে, অপরাধীদের বুকের পাটা বেড়ে গেছে। খুন-ধর্ষণে পুলিশ যাচ্ছে না অপরাধীদের ধরতে। সোশ্যাল মিডিয়াতে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক প্রচারে পুলিশ বাধা দিচ্ছে না, অথচ যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের পরে মালদহে সিপিআই(এমল)’র এক সদস্যকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার বিরোধী পোস্ট করার জন্য পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
আইএসএফ বিধায়ক নৌসাদ সিদ্দিকিও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্তার নিন্দা করেছেন।
চমকপ্রদ লক্ষণীয় ঘটনা হলো, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে করা তৃণমূলী ছাত্রনেতার অকথ্য, অশ্রাব্য গালিগালাজের ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘একটু কটু, খারাপ কথা’ বলে মন্তব্য করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যে স্তম্ভিত রাজ্যের মানুষ। এর আগে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যক্ষের ওপর তৃণমূলের হিংস্র হামলার পরও মমতা ব্যানার্জির মুখে ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলে শোনা গিয়েছিল।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রনেতা গিয়াসউদ্দিন মণ্ডলকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দায় এড়াতে চাইছে শাসকদল। কিন্তু সে গ্রেপ্তার হবার আগে নিজেই জানিয়েছে যে, সে তৃণমূল করে। তৃণমূল নিজেদের দায় এড়াতে নানাভাবে চেষ্টা করলেও এই ঘটনায় সর্বত্র প্রতিবাদ-ধিক্কার ধ্বনিত হচ্ছে।