৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
সিপিআই(এম) মহারাষ্ট্র রাজ্য ২৩তম সম্মেলন
সম্মেলন উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন সীতারাম ইয়েচুরি।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২০ থেকে ২২ মার্চ নাগপুরে মতাদর্শ চর্চা ও আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে পরাস্ত করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে পার্টির স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠিত হলো তিনদিনব্যাপী সিপিআই(এম) মহারাষ্ট্র রাজ্য ২৩তম সম্মেলন।
সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ৫০ সদস্যের রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে সর্বসম্মতিতে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন উদয় নারকার।
সম্মেলনস্থলের নাম রাখা হয় কমরেড মহেন্দ্র সিং নগর। হলের নামকরণ করা হয় কমরেড ডাক্তার বিঠল মোরে এবং উদ্ধব ভাওয়ালকরের নামে। মঞ্চের নামকরণ করা হয় আল্লাহবক্স প্যাটেল এবং রতন বুধারের নামে। প্রসঙ্গত, ৩৭ বছর পরে নাগপুরে পার্টির মহারাষ্ট্র রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
বসন্তরাও দেশপান্ডে হলে ২০ মার্চ সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশন আয়োজিত হয়। প্রকাশ্য অধিবেশনের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। অধিবেশনে মূলত নাগপুর এবং বিদর্ভ এলাকার পার্টি সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণি ও গণসংগঠনসমূহের কর্মী এবং দরদিরা উপস্থিত ছিলেন ব্যাপক সংখ্যায়।
উদ্বোধনী সমাবেশে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আরএসএস-বিজেপি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যা সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত তার ওপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। মহারাষ্ট্রের মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করছেন এই ধারাবাহিক আক্রমণের তীব্রতা।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সংবিধানে বর্ণিত চারটি স্তম্ভের অন্যতম। আর বাকি তিনটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, আর্থিক সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক ন্যায়। কিন্তু কর্পোরেট-হিন্দুত্বের শক্তি এই ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং জাতীয় সম্পদ লুট করছে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের ভেক ধরে।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে বিজেপি সরকার দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সমূহের ওপর আক্রমণ তীব্র করেছে। সেই লক্ষ্যেই মুসলিম বিরোধী সিএএ চালু করার পাশাপাশি ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা জম্মু-কাশ্মীর যা দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য সেখান থেকে থেকে বাতিল করে।
সীতারাম ইয়েচুরি কাশ্মীর ফাইলস সিনেমার মাধ্যমে ঘৃণা এবং মিথ্যা ছড়ানোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ রিপোর্ট বলছে সে সময় ৮৯ জন কাশ্মীরি পন্ডিত মারা গিয়েছিলেন যা অবশ্যই নিন্দনীয়। একই সময়ে এক হাজার ৬৩৫ জন মানুষ, যাঁরা অন্য ধর্মমতে বিশ্বাসী সহ ব্যাপক সংখ্যক মুসলিম জনগণ ওই সময় মারা গিয়েছিল জঙ্গিদের আক্রমণে। তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন এই তথ্য সিনেমায় প্রদর্শিত হয়নি। শ্লেষের সঙ্গে তিনি বলেন, এটা মতপ্রকাশের অধিকারের স্বাধীনতা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর স্বাধীনতা।
সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রের বিভিন্ন জনবিরোধী পদক্ষেপের প্রসঙ্গে তিনি বিশ্লেষণ করেন সংসদীয় রীতি-পদ্ধতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি খর্ব করে কিভাবে রাজ্যগুলির অধিকারে হস্তক্ষেপ করে কৃষক বিরোধী তিনটি কালা আইন এবং কর্পোরেটমুখী চারটি প্রমোকোড চালুর মতো পদক্ষেপ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, যে চারটি রাজ্যে বিজেপি সম্প্রতি ক্ষমতায় এসেছে সেখানে তারা পুনরায় কৃষি আইন চালু করতে চায়। মহারাষ্ট্রের মানুষ বিশেষত কৃষকদের আত্মহত্যার রাজধানী হিসেবে পরিচিত বিদর্ভ অঞ্চলের মানুষ সহ দেশের জনগণকে এই প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে আরও একবার লড়াই-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বিজেপি সরকারকে নতজানু হতে বাধ্য করতে হবে।
পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু তাঁর বক্তব্যে হিন্দুত্ব মতাদর্শকে পর্যুদস্ত করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যুক্তিবাদী চিন্তা ভাবনা এবং সেই ঐতিহ্যকে তুলে ধরে এগনোর ওপর জোর দেন।
প্রকাশ্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্টির বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক নরসায়া আদম। সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
প্রসঙ্গত, নাগপুরের এই এলাকায় অবস্থিত সাবদার লেক একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখান থেকেই ৯৫ বছর আগে মহারাষ্ট্রের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা আর বি মোরে এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে এই লেক থেকেই দলিত অংশের মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রথম জল সংগ্রহ করেন এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৭ সালে এখানেই ঘটে আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এখানেই প্রথম বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়। এদিন সভার শুরুতে ডক্টর আম্বেদকরের মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নেতৃবৃন্দ।
সম্মেলনে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন রাজ্য কন্ট্রোল কমিশনের বিদায়ী চেয়ারপার্সন উদয়ন শর্মা। প্রতিনিধি অধিবেশন পর্বের শুরুতে প্রেসিডিয়াম গঠিত হয়। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডক্টর এস কে রেগে। বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক নরসায়া আদম রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্ট পেশ করেন। এরপর বিভিন্ন গণসংগঠনের রিপোর্ট পেশ করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা।
রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্টে আন্তর্জাতিক জাতীয় এবং সামাজিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিকের উল্লেখ রয়েছে। রাজ্যের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্র এই দুই বিজেপি সরকারের পরিচালনায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির দ্বারা মহারাষ্ট্রকে হিন্দুত্ববাদের গবেষণাগারে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়। সে সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে সতর্ক থাকার পাশাপাশি তা রোখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে খেতমজুর ফ্রন্ট এবং ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলির। একই সঙ্গে রয়েছে লঙ মার্চ পরবর্তী বিধানসভার ভোটে উল্লেখযোগ্য পরিস্থিতির কথা। ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পার্টি কুড়িটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় দু’লক্ষ ৮ হাজারের মতো ভোট পেয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালে আটটি বিধানসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পার্টি প্রায় দু’লক্ষ ৫হাজার ভোট পেয়েছে বিজেপি বিরোধী ভোটকে একত্র করার কৌশলের জেরে।
আবার একই সঙ্গে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পার্টি একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এক লক্ষ ৯ হাজার ভোট পেয়েছে, যেখানে ভোট বেড়েছে প্রায় ৩৭ হাজার। তবে নাসিক জেলার দাহানু আসনে বিজেপি-কে হারিয়ে জয়লাভ করলেও দীর্ঘদিনের জেতা কালওয়ান সংরক্ষিত আসনটি খোয়াতে হয়েছে এনসিপি’র কাছে সাড়ে ৬ হাজার ভোটে হেরে।
মহারাষ্ট্রে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীর সংখ্যা ১৮১ জন, যেখানে ৭৬ জন ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে রয়েছেন। ৫৩ জন কৃষক এবং খেতমজুর ফ্রন্টে রয়েছেন ১৪ জন, মহিলা ফ্রন্টে ১২ জন, ছাত্র-যুব ফ্রন্টে এবং পার্টি রাজ্য কার্যালয়ে রয়েছেন ৪ জন।
মহারাষ্ট্রে পার্টি সদস্যসংখ্যা ১২ হাজার ৮৩৭ জন। যেখানে শ্রমিকশ্রেণি থেকে ১৭.৬ শতাংশ, ৬০.৪০ শতাংশ কৃষক ফ্রন্ট থেকে এবং খেতমজুর ফ্রন্ট থেকে ১৭.৬ শতাংশ সদস্য রয়েছে।
সামাজিকভাবে আদিবাসী অংশ থেকে ৫৫ শতাংশ, দলিত অংশ থেকে ৯.২ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের থেকে ৫.৫ শতাংশ, মহিলা ফ্রন্ট থেকে ৬.৩৩ শতাংশ সদস্য এসেছেন। পার্টি সদস্যদের ৪০ শতাংশের বেশি ৪০ বছরের কম বয়সি।
এখানে পার্টির সদস্যদের ২১.৭ শতাংশ ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রায় ৫১ শতাংশ কৃষক ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত।
প্রতিনিধি অধিবেশন পর্বে সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেছেন নয়া উদারবাদী পথ এবং হিন্দুত্বের শক্তির অশুভ আঁতাতের দরুন দেশে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রের অস্থিরতা এবং জটিলতার কথা। তিনি দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জোরের সঙ্গে তুলে ধরে বলেন, জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও।
সম্মেলনে মোট ৩১৮ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন যার মধ্যে ৫৮ জন মহিলা। সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ৫০ সদস্যের রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়, যেখানে ৯ জন মহিলা। নব গঠিত রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে সর্বসম্মতিতে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন উদয় নারকার। সম্পাদকমণ্ডলী গঠন হবে পার্টি কংগ্রেসের পর। পার্টি কংগ্রেসে অংশগ্রহণের জন্য ১৬ জন প্রতিনিধি, দু’জন পর্যবেক্ষক এবং তিন জন বিকল্প প্রতিনিধির নাম চূড়ান্ত করা হয়।
সম্মেলনের সমাপ্তি পর্বে পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, যে শহরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানেই রয়েছে আরএসএস’র সদর দপ্তর। যে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক রিপোর্ট গৃহীত হয়েছে সেখানে মতাদর্শগত লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে পার্টিকে এবং পার্টি সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয়েছে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পার্টি কেন্দ্র দৃঢ়ভাবে পরিচালনার বিষয়েও জোর দিয়েছেন।
সমাপ্তিসূচক বক্তব্যে অশোক ধাওয়ালে আগামীদিনের পার্টি এবং গণফ্রন্টের কর্মসূচি ও কাজের বিষয়সমূহ ব্যাখ্যা করে তা সফল করে তোলার আহ্বান জানান। এরপর আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি সূচিত হয় সম্মেলনের।