৫৯ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৮ এপ্রিল, ২০২২ / ২৪ চৈত্র, ১৪২৮
ওএনজিসি-র অশোকনগর প্রকল্প
অমিতাভ রায়
উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর এলাকায় ২০০৯-এ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা ওএনজিসি (অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন)। অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব ২০০৬-০৭ নাগাদ দিয়েছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের একঝাঁক বামপন্থী সাংসদ বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারকে ধারাবাহিকভাবে তাগাদা দিতে থাকায় ২০০৯-এ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। প্রথমে সাড়ে তিন একর জমির উপর কুয়ো খুঁড়ে অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়। কলকাতা থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরের অশোকনগরে চলতে থাকা এই কর্মকাণ্ডের খবর সেই সময় রাজ্য বা জাতীয়স্তরের সংবাদমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কারণ, সমস্ত ধরনের সংবাদমাধ্যম তখন বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতায় মুখর।
প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৪-য় শেষ হয়। প্রথম পর্যায়ের কাজে সাফল্য পাওয়ার পর শুরু হয় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। ২০১৭-য় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সেখানে ভূগর্ভস্থ তেল ও গ্যাসের মজুত ভাণ্ডার সম্পর্কে নিশ্চিত হয় ওএনজিসি। অনুসন্ধান চালাতে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি কুয়ো খননের পরিকল্পনা করে ওএনজিসি। তৃতীয়টি খোঁড়ার পরেই ২০১৮-র ২০ আগস্ট প্রথম গ্যাসের উপস্থিতির বিপুল মজুতের খোঁজ মেলে এবং তার কয়েক দিন পরেই পাওয়া যায় তেলের ভাণ্ডার। মাটির গভীরে থাকা খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য অয়েল ইন্ডিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে ওএনজিসি। প্রথমে চার একর ও পরে রাজ্যের কাছে আরও ১২ একর জমিও চেয়েছিল ওএনজিসি। অনুসন্ধান শেষে ২০১৮-য় ওএনজিসি জানায় যে, , এটিই পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতে প্রথম খনিজ তেলের খনি।
অশোকনগর তেলক্ষেত্রের খনিজ তেলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য হলদিয়ায় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের শোধনাগারে প্রায় ৩০,০০০ লিটার অপরিশোধিত খনিজ তেল পাঠানো হয়। পরীক্ষায় তেলের গুণমান অত্যন্ত ভালো ও তা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন লাভজনক হবে বলে জানায় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের শোধনাগার। এর পরে অশোকনগর তেলক্ষেত্রের বাইগাছি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে খনিজ তেল উত্তোলনের কার্যক্রম শুরু হয়।
অশোকনগরের বাইগাছিতে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তেল উত্তোলন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তখনকার কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী। তিনি রাজ্যের প্রথম তৈলকূপ প্রকল্পকে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। উদ্বোধনের পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম খনিজতেলের কুয়ো অশোকনগর-১ কুয়োটি খনিজ তেল উত্তোলন শুরু করে। এই খবরটি সেদিন সমস্ত টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়। পরেরদিন সমস্ত সংবাদপত্রে খবরটি বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় বেঙ্গল বেসিন-এ অবস্থিত অশোকনগরের এই তেলক্ষেত্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩.২ কিলোমিটার নিচে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের বিপুল ভাণ্ডার নিয়ে গঠিত। এখানে যে ভাণ্ডার রয়েছে, তাতে একটি গ্যাসের কুয়ো থেকে প্রতিদিন এক লক্ষ ঘন মিটারের কিছু বেশি গ্যাস ও তেলের কুয়ো থেকে দিনে ১৫-১৮ ঘন মিটার অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করা সম্ভব। পরিভাষার এক ঘন মিটার তেল মানে এক হাজার লিটার তেল। অর্থাৎ দিনে ১৫ থেকে ১৮ হাজার লিটার অপরিশোধিত খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম অশোকনগর প্রকল্প থেকে উত্তোলন করা সম্ভব বলে জানানো হয়েছিল।
তেলক্ষেত্রটি থেকে খনিজ তেল উত্তোলনের জন্য ২০২০ সালে জমি অধিগ্রহণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল যে, পরের তিন বছরে ৩০টি কুয়ো থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরে তেল ও গ্যাস উৎপাদন করার জন্য কুয়ো সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১০০টি কুয়ো স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানানো হয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান ছিল, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার তেল উৎপাদন ব্লকের বাণিজ্যিক উৎপাদন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের শেষের আগেই শুরু হতে পারে এবং প্রাথমিক উৎপাদনের পরিমাণ ১২০ ঘনমিটার হতে পারে।
প্রথম পর্যায়ের কোভিড সংক্রমণ ও তার প্রতিক্রিয়ায় আকস্মিকভাবে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষিত লকডাউন-এ অবরুদ্ধ জনজীবন যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করছিল তখন নিঃসন্দেহে এ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ খবর। আশার আলো জ্বালিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন বছর ২০২১। জানুয়ারির ৫ তারিখে সাংবাদিক সম্মেলন করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, রাজ্য মন্ত্রীসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অশোকনগরের প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে ১৩.৪৯ একর জমি ওএনজিস-র হাতে তুলে দেওয়া হবে।
তারপর কেটে গেছে অনেক সময়। শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের কোভিড সংক্রমণ। আবার অবরুদ্ধ জনজীবন। অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি। কাজছাড়া, কাজহারা মানুষের হাহাকার। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। সেই আবহে সম্পন্ন হলো রাজ্য বিধানসভার অবাধ অশান্তিপূর্ণ নির্বাচন। ঘটনার ঘনঘটায় হারিয়ে গেল ওএনজিসি-র খবর।
দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করেই নজরে এসেছে একটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সংবাদ। “উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের বাইগাছিতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এ বার অশোকনগরেরই দৌলতপুর এলাকায় তেল-গ্যাসের সন্ধানে ওএনজিসি কাজ চালাচ্ছে...” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ, ২০২২)। তিন একর জমির উপর কাজ চলছে বলে জানানো হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে ওএনজিসি-র অশোকনগর প্রকল্পে কী হচ্ছে? বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পনেরো মাস পর আবার নতুন করে ‘সন্ধানের কাজ’ শুরু করার প্রয়োজন কেন হচ্ছে? ২০২০-র ২০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধুমধাম করে যে প্রকল্প দেশবাসীর উদ্দেশে সমর্পণ করে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে গেছিলেন সেখান থেকে কী পরিমাণ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে? রাজ্য সরকার যে প্রকল্পের জন্য জমি হস্তান্তর করেছিল সেই জমিতে কী হচ্ছে? প্রকল্পের উপর রাজ্য সরকারের কোনো নজরদারি আছে কী? থাকলে, রাজ্য সরকার বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসছে না কেন?
ওএনজিসি কর্তৃপক্ষ নীরব। কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার এবং শাসকদল নিরুত্তর। তাহলে কি সবটাই ছিল নিছক নির্বাচনী প্রচারের অংশ। অর্থাৎ ধাপ্পা, যা আজকাল সর্বভারতীয় পর্যায়ে জুমলা বলে বহুল প্রচলিত।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হিরন্ময় নীরবতা শেষ কথা নয়। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জনসমক্ষে আনার দাবিতে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই প্রকৃত পরিস্থিতির খোঁজ পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে শুরু হতে পারে ওএনজিসি-র অশোকনগর প্রকল্পে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের কাজ। অন্য কোনো বিকল্প পথ আছে কি?