৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
কাঁথিতে বাম ও কংগ্রেস দলের যৌথ মিছিল ও সমাবেশে জনজোয়ার
বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের যৌথ সমাবেশে উত্তাল কাঁথি -
কাঁথির সমাবেশে বলছেন সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম।
সংবাদদাতাঃ রাধাগোবিন্দ মান্না
তৃণমূল-বিজেপি’র হাত থেকে মুক্তি চাইছে দেশ ও বাংলার মানুষ। তৃণমূল-বিজেপি-র চুরি জোচ্চুরির হিস্যার ঝগড়া থামিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের অধিকার ছিনিয়ে নেবেন রাজ্যের মানুষ। কালীঘাটের টালির বাড়ির শাসন আর চাইছে না বাংলার মানুষ। কথাগুলো বলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম। ৫ জানুয়ারি কাঁথিতে বাম সহযোগী দল সহ কংগ্রেস দলের আহ্বানে কাঁথির সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে সভা হয়। মেচেদা বাইপাস থেকে কয়েক কিলোমিটার রোড শো করে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে সভা শুরু হয়। কয়েক হাজার মানুষের লাল ও তেরঙা ঝান্ডার একত্রে মিছিল দেখা গেল এদিন। রাস্তার পাশে পুরবাসী ছাদের উপর থেকে ফুল ছড়িয়ে স্বাগত জানায় মিছিলের মানুষদের। পাঁচ কিলোমিটার হাঁটলেন সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি, সিপিআই নেতা স্বপন ব্যানার্জি, কংগ্রেসের শুভঙ্কর সরকার, মানস করমহাপাত্র, আরএসপি’র অমৃত মাইতি সহ বাম সহযোগী দলের নেতা কর্মী। কাঁথির রূপশ্রী সিনেমা হলের কাছ থেকে লম্বা মিছিলের লালঝান্ডা পতপত করে উড়েছে আর জনজোয়ারে ভেসেছে পুরো কাঁথি শহর। অলি গলি থেকে বেরিয়ে মানুষ দেখেছেন বাম-কংগ্রেসের দৃপ্ত মিছিল। শহরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে স্লোগান। ‘বিভেদ নয় শান্তি চাই’। ‘অন্নদাতার দাবি মানতে হবে’। ‘তিন কালা বিল বাতিল করতে হবে’। ‘দুহাতে কাজ চাই’। কাঁথি ও এগরা দুই মহকুমার মহামিছিল দেখিয়েছে প্রত্যাবর্তনের পথ। তৃণমূল জেলা সভাপতি শিশির অধিকারীর বাড়ির সামনে শান্তি কুঞ্জের পাশ দিয়ে যখন মিছিল হাঁটছিল তখন এলাকার মানুষ পুষ্পবৃষ্টি করে মিছিলের ওপর। তারা বোঝাতে চাইছিল তৃণমূল-বিজেপি’র হাত থেকে মুক্তি চায়। সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি। বলেন, বাম-কংগ্রেসের জোট চায় মানুষের মুক্তি।
কাঁথি রূপসী বাইপাস থেকে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের ডাকে মহামিছিলে জনজোয়ার। রয়েছেন মহম্মদ সেলিম, শুভঙ্কর সরকার, নিরঞ্জন সিহি সহ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ।
দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে মহম্মদ সেলিম, শুভঙ্কর সরকার ও অমিতাভ ঘোষরা বলেন, কৃষকরা রাস্তায়। সরকারের দৃষ্টি নেই। কারখানা বিক্রি করছে। তৃণমূল কাটমানি নিচ্ছে। দুই দলের চাওয়া পাওয়ার ঝগড়া। কিন্তু রাজ্যের মানুষ চাইছে শিক্ষা, বাসস্থান, কাজের অধিকার। ফের ভুল বুঝিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায় তৃণমূল-বিজেপি। লাগাতার মানুষকে বিব্রত করে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সিঙ্গুরের টাটার গাড়ি কারখানা সহ অনুসারী শিল্প করতে দেয়নি। সম্পূর্ণ হওয়া ন্যানো কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল। হাজার হাজার স্থানীয় যুবক-যুবতী নানাভাবে কাজ পাবে বলে আশা করেছিল। কারখানায় নানা অংশের কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সিঙ্গুরবাসী; হতাশায় আজও ভুগছেন তাঁরা। খোঁজ নেয়নি তৃণমূল সরকার। একইভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামের মানুষকে লাগাতার ভুল বুঝিয়েছিল তৎকালীন বাম বিরোধী শক্তি। ২০০৭ সাল থেকেই লাগাতার ধ্বংসের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল নন্দীগ্রাম। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার পরিকল্পনা করেছিল নন্দীগ্রাম, খেজুরি নদীর ধার বরাবর হলদিয়ার মতো জেলায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। কেমিক্যাল হাব হবে। তার সঙ্গে অনুসারী শিল্পের প্রসার ঘটবে। কাজ পাবে জেলা ও রাজ্যের হাজার হাজার মানুষ। বিপুল শ্রম দিবস সৃষ্টি হবে। মানুষকে মিথ্যা কথা বলে খেপিয়ে ভূমি উচ্ছেদের নামে আন্দোলন গড়ে তোলে তৃণমূল ও সহযোগী দল। দিনের পর দিন রাস্তাঘাট কেটে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেয় তৃণমূল। নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে জমি আন্দোলনে বাধ্য করে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জমি অধিগ্রহণ হবে না ঘোষণা করেন। তারপরও জমি রক্ষা কমিটির নামে তাণ্ডব চালায় তৃণমূল।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নতুন করে শিল্পকারখানা হয়নি। ১১ সালের পর হলদিয়া শিল্পনগরীর কলকারখানার দরজা বন্ধ হয়েছে। ছাঁটাই হয়েছে হাজার হাজার স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মী। গত দশ বছরে হলদিয়া বন্দরে আড়াই হাজারেরও বেশি শ্রমিক কর্মচারী অবসর নিয়েছেন। পরিবর্তে কোনো নিয়োগ হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিয়োগের ব্যাপারে নিরুদ্বেগ। হলদিয়ার সিআইটিইউ নেতা লক্ষ্মীকান্ত সামন্ত জানান, হলদিয়া বন্দর ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের দিকে যাচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়োগের প্রক্রিয়া বন্ধ করেছে। ইতিমধ্যে বন্দরের বার্থ ও জেটিতে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছে। হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যানের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সদ্য তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী। ফুল বদলে শুভেন্দু অধিকারী এখন দাবি করছেন রাজ্যের তৃণমূল সরকার কর্মসংস্থান করতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ বেকার সৃষ্টি করেছে। সিপিআই(এম) আগে থেকেই বলে আসছিল হলদিয়ায়, নন্দীগ্রামে শিল্পের মাধ্যমে জেলার কর্মসংস্থান ঘটবে। মানুষ কাজ পাবে।
কাঁথির হরিপুরে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে পরমাণু চুল্লি বন্ধ হয়েছে। জেলার তাজপুর বন্দর গড়ার পরিকল্পনা করেছে মাত্র তৃণমূল। এখনো কোনো বিনিয়োগ হয়নি। তৃণমূল সরকার জেলার মানুষকে শিল্পের স্বপ্ন দেখিয়েছে শুধু। অথচ কৃষিপ্রধান উপকূলবর্তী জেলার পানচাষিরা ফনী ও আমফান ঝড়ে বিধ্বস্তদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ক্ষতিপূরণের টাকা তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য নেতা কর্মীর পরিবারে ভাগ করেছে। মানুষের অভাব অভিযোগের ক্ষোভ অন্যদিকে ঘোরাতে ‘দুয়ারে সরকার’ হাজির করেছে। এসবের বিরুদ্ধেই পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ আজ প্রতিবাদ-প্রতিরোধে পথে নামছেন। তারই আভাস মিলেছে কাঁথির দৃপ্ত মিছিল ও সমাবেশে।