৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
কেরালা বিধানসভায় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত
কেরালা বিধানসভায় কেন্দ্রের তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে পাস হয়েছে। বিরোধী ইউডিএফ বিধায়কদের সাথেই একমাত্র বিজেপি বিধায়কও এই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। সেদিক থেকে দেখলে বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও পরে বিজেপি’র চাপে ওই বিধায়ক রাজাগোপাল একটু অন্য সুর গাওয়া শুরু করলেও, পাস হওয়া প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কিছু বলেননি। উল্টে তিনি বলেছেনঃ বিধানসভায় প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে পাস হোক সেটাই তিনি চাইছিলেন, গণতন্ত্রের এটাই মর্মবস্তু। অন্যদিকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে ঘরে বাইরে বেসামাল বিজেপি চরম বেকায়দায় পড়ে যথারীতি এর জন্য বিধানসভার অধ্যক্ষ পি রামকৃষ্ণাণকেই দায়ী করেছে। এই নিয়ে দেশের তিনটি রাজ্য - পাঞ্জাব, রাজস্থান ও কেরালা বিধানসভায় কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হলো।
দিল্লির সীমান্তে চলা কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকদের অবস্থান গত ৪ জানুয়ারি ৪০ দিনে পড়ে। ওইদিনই কৃষকদের সঙ্গে কেন্দ্রের সপ্তম রাউন্ডের বৈঠক হয়। কেন্দ্র আইনে সংশোধনী আনার নামে লাগাতারভাবে কৃষক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও কৃষকরা তাঁদের দাবিতে অনড় রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি বিরোধী দল বা জোটের নেতৃত্বে চলা রাজ্যগুলির বিধানসভায় কৃষি আইন বিরোধী প্রস্তাব পাস এই আন্দোলনকে অবশ্যই বাড়তি শক্তি জোগাচ্ছে। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বও জানিয়েছেনঃ আগামী ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কৃষকরা দিল্লিতে প্যারেডের উদ্দেশে রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হবেন।
অন্তত মুখে বিজেপি বিরোধিতা করে এরকম দলের হাতে থাকা রাজ্য সরকারগুলিকে অবশ্য কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিধানসভাগুলিতে প্রস্তাব পাস করানোর পথে এখনো উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে হাতের কাছেই রয়েছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশার মতো রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে তো গত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস রাজ্য বিধানসভায় কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার দাবি জানিয়ে আসছে। সম্ভবত দেশের মধ্যে এই ধরনের দাবি ওটাই প্রথম ছিল। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান এবং বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রীকে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সর্বনাশা কেন্দ্রীয় বিলের বিরুদ্ধে রাজ্য বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকার প্রস্তাব দিয়ে চিঠিও লেখেন। যদিও তথাকথিত ‘কৃষক দরদী’ এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেপথে হাঁটেননি। দীর্ঘদিন ধরে এরাজ্যে বিধানসভার কোনো অধিবেশনও বসেনি।
অবশ্য এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এপথে হাঁটায় একটু অসুবিধাই আছে। তাহলে নিজের থুথু নিজেকেই গিলতে হবে। কেননা, ২০১৪ সালে রাজ্য বিধানসভায় কৃষি বিপণন আইনে তৃণমূল সরকার একটা সংশোধনী আনে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে কৃষি বিপণনে কর্পোরেটদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্টে পাস হওয়া আলোচ্য কৃষি আইনগুলির মধ্য দিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক এই কাজটাই করেছে। গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কৃষক সমাবেশ এবং বাম-সহযোগী দল ও কংগ্রেসের ডাকা অবস্থান বিক্ষোভ থেকেও এই আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। চাপের মুখে এখন শোনা যাচ্ছে, রাজ্য সরকার নাকি বিধানসভার অধিবেশন ডাকবে। তখন দেখা যাবে, নিজের তৈরি কৃষি আইন বাতিল এবং কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কী অবস্থান নেয়।
সাংবিধানিকভাবে কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। ওই তিন কৃষি আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কেন্দ্র-রাজ্যগুলির সাথে কোনো আলোচনাই করেনি। সংসদেও এই নিয়ে বিরোধীদের আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃষি আইন স্থগিত রাখার পরাপর্শ দিয়েছে। সেক্ষেত্রে একের পর এক বিধানসভায় কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হওয়াটা কেন্দ্রের সরকারের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই অস্বস্তির বিষয়। তাই বিজেপি বিরোধী দলগুলির হাতে থাকা রাজ্যগুলিতে বিধানসভা ডাকার ক্ষেত্রে রাজ্যপালরা বিরোধিতা করছেন। দেশের সংবিধান রাজ্যপালদের এ অধিকার দেয়নি। তবুও এটা তাঁরা যে কেন্দ্রের সরকারের নির্দেশেই করছেন তা বুঝতে কারুর অসুবিধা হবে না। কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানও সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকতে বাধা দিচ্ছিলেন। কিন্তু পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন কেরালার বাম গণতান্ত্রিক সরকার অধিবেশন ডাকতে তাঁকে বাধ্য করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা অধিবেশন সত্যি যদি সরকার ডাকে তাহলে হয়তো রাজ্যের রাজ্যপালও এধরনের অসহযোগিতা করতে পারে। অন্তত বিভিন্ন এসম্পর্কিত ঘটনা পরম্পরা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস তো এব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেঃ ‘‘কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব আনতে হবে এবং রাজ্যের প্রণীত কৃষক বিরোধী আইনও বাতিল করতে হবে।’’ অবশ্য ৬ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের সাথে চুপিচুপি দেখা করে এসেছেন। এখন দেখা যাক আবার কোনো গটআপের খেলা শুরু হলো কিনা?
পূর্বে বহুক্ষেত্রেই বিজেপি বিরোধিতায় মাঠে-ময়দানে সিংহ গর্জন করলেও আসল সময়ে ইঁদুর হয়ে যাওয়া কিংবা পালিয়ে যাবার বহু নিদর্শন তৃণমূল ইতিমধ্যেই রেখেছে। গত এক বছরের মধ্যে যার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ পাওয়া গেছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের ক্ষেত্রে।
গত দশ বছরের তৃণমূল শাসনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ সরকারটা কৃষকদের কথা ভাবে না। শুধু কৃষি বিপণনি আইনে সংশোধন এনে কর্পোরেটদের সুবিধা করে দেওয়া নয়, কৃষকদের জমি লুট, কৃষকদের ফসলের দাম না পাওয়া, কৃষক আত্মহত্যা, তৃণমূল দল ও সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে কৃষকদের অভাবী বিক্রিতে বাধ্য করার মতো সমস্ত কৃষকবিরোধী ঘটনা এ রাজ্যে আজ সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মেকি বিজেপি বিরোধিতা, অর্থ আর বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে সব নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে রাজ্যের বাজারি গণমাধ্যমগুলির নির্লজ্জ তাঁবেদারি আর সরকারি প্রচারের ঢক্কানিনাদের মধ্য দিয়ে এসব চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। এসবের মধ্য দিয়ে তারা যে সফল হচ্ছে না, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছে না - তা জোরগলায় বলা যাবে না। তাই এ রাজ্যে তো বটেই, সারাদেশে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আইনসভার অভ্যন্তরে সরকারি দল কিংবা বিরোধী হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করে কৃষি আইনের বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকে শক্তি জোগাতে হবে এবং সাথে সাথে দেশের সর্বত্র এই কৃষক আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অপরাপর শক্তিগুলিকেও এই লড়াইয়ে শামিল করতে হবে। এতে যেমন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আঘাত করা যাবে, তাদের আক্রমণের বর্শামুখকে ভোঁতা করে দেওয়া যাবে তেমনি আবার তৃণমূলের মতো মেকি বিজেপি-বিরোধী দলগুলির কৃষকদরদী মুখোশও খুলে দেওয়া যাবে।