৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
আরও সংগঠিত হয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসকদলকে পরাস্ত করতে হবে
গণশক্তির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দের আহ্বান
গণশক্তির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভায় বক্তা সীতারাম ইয়েচুরি। মঞ্চে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, হান্নান মোল্লা প্রমুখ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আমাদের দেশে সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক সংস্থা সব খতম করার জমানা চলছে। বিজেপি-আরএসএস’র উদ্দেশ্য হলো ধর্মভিত্তিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের নির্মাণ। দেশকে রক্ষার জন্য এদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে রাখা জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশেই বিজেপি-কে হারাতে হবে। এটাই আমাদের আজকের প্রাথমিক কাজ। এখন প্রশ্ন হলো এই প্রাথমিক কাজ কি ভাবে সফল হবে? রাজ্যে বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত তৃণমূলের অপশাসনের কারণে এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি-কে এনেছে এটা সবাই জানে। বিজেপি তৃণমূল দু’পক্ষই চায় এই নির্বাচনকে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক নির্বাচনে পরিণত করা। এরা শুধু নির্বাচনী বিকল্পর কথা বলে।
এখানে যা ঘটছে তা কি বিজেপি শাসনের বিপরীত? বিকল্প কোনো ব্যবস্থা? দু’টো দলেরই নীতি এক। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে প্রবল ক্ষোভ, ঘৃণা তৈরি হয়েছে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রয়েছে রাজ্যের জনগণের বড়ো অংশ যখন তৃণমূল কংগ্রেসকে সরাতে চায় তখন তৃণমূলের বিরোধিতা না করলে সেটা হবে বিজেপি’র হাতে জয় সঁপে দেওয়া। গণশক্তি পত্রিকার ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কলকাতার প্রমোদ দাসগুপ্ত ভবনে আয়োজিত সভায় একথা বলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
এই সভায় সভাপতিত্ব করেন গণশক্তি ট্রাস্টের সভাপতি বিমান বসু। অনুষ্ঠানে সীতারাম ইয়েচুরি ছাড়াও সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলনের নেতা, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য হান্নান মোল্লা, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, মহম্মদ সেলিম বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বার্থে গণশক্তির ভূমিকা উল্লেখ করেন। গণশক্তিকে শুধু সংবাদপত্র নয়,একটি বিপ্লবী ঐতিহ্যের কণ্ঠস্বর, সংগ্রামের হাতিয়ার, সংগ্রামের আওয়াজ ও সংগঠক বলে অভিহিত করেছেন তাঁরা।
কেন্দ্রের শাসকদলের বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, দেশে সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক সংস্থা সব খতম করার জমানা চলছে। এই সরকার এবং শাসকদলের উদ্দেশ্য হলো দেশের এই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কাঠামোকে ধ্বংস করে সেখানে থিয়োক্রেটিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের নির্মাণ। এটা তখনই সম্ভব যখন দেশে হিংসা এবং ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হবে। সংবিধান ধ্বংস করে নতুন ভারত গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য তাই বিজেপি আরএসএস-কে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে রাখা জরুরি। এদের নির্বাচনে হারানোটা অনিবার্য। এটাই আমাদের আজকের প্রাথমিক কাজ। এদের সমস্ত জায়গায় নির্বাচনে পরাস্ত করতে হবে।
দেশের সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব দেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্রকে মজবুত করা এবং সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করা। বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম খবর বা তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সময় সেখানে নিজস্ব মতাদর্শ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে। খবরের মধ্যে ফেক নিউজ মিশিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে এরাজ্যের সংবাদ মাধ্যমের ভুমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে বিজেপি তৃণমূল দু’পক্ষই চায় বিধানসভা নির্বাচনকে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক নির্বাচনে পরিণত করতে। এখানে মিডিয়া এদের কথাই বলে। বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে কি কোনো বিকল্প নীতি আছে? কেন্দ্রের কৃষি আইনের মতো আইন কি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল চালু করেনি? এখানে কি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন কৃষকরা? ফসলের কুইন্টাল প্রতি সরকার ঘোষিত মূল্য পাচ্ছেন কি? উল্টে ঘোষণা হচ্ছে আঠারোশো টাকা, কৃষক পাচ্ছেন বারোশো টাকার মতো। এটা কি বিকল্প নাকি? এখানে বেকারির কী পরিস্থিতি? গণতান্ত্রিক অধিকার এখানে কি সুরক্ষিত? দুটো দলেরই নীতি এক। এরা শুধু নির্বাচনী বিকল্পের কথা বলে। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান কি হবে তাও ঠিক নেই। মিডিয়াতে এসব বলা হয় না।
কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকা সম্পর্কে তিনি শ্লেষের সুরে বলেন, সরকার বলছে লকডাউনের প্রেক্ষিতে জনগণকে স্বস্তি দিতে ত্রাণ দেওয়ার মতো টাকা সরকারের কাছে নেই। কিন্তু সরকারের কাছে নতুন সংসদ ভবন বানানোর মতো টাকা রয়েছে। এইসব প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো কেউ নেই।
কৃষি আইন সম্পর্কে তিনি বলেন, মুনাফার নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে এই কৃষি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে। আইন একবার তৈরি হয়ে গেলে তা বাতিল করার ক্ষমতা সরকারের নেই। একমাত্র তা সংসদের আছে। সংসদ চালু থাকলে সেখানে চাপের মুখে পড়তে হবে আইন বাতিল করার জন্য,তাই সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হলো। জরুরি অবস্থা ছাড়া এমন কখনো হয়নি। সরকারকে যাতে জবাবদিহি না করতে হয় তাই সংসদকে শেষ করতে চায় বিজেপি-আরএসএস।
বিচার ব্যবস্থার ভুমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ৩৭০ ধারা বাতিল, সিএএ, ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত মামলা বছর খানেকেরও বেশি সময় ধরে পড়ে আছে সুপ্রিম কোর্টে। এসবের জন্য সময় নেই। কিন্তু মিডিয়ার এক সম্পাদককে জামিন দেওয়ার জন্য, একজন অভিনেতার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে সময় আছে। ন্যায় পাওয়ার জন্য মানুষের আস্থা রয়েছে বিচারব্যবস্থার ওপর। তাও শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, পক্ষপাতহীন নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে চলার কথা, কিন্তু কমিশন তা করছে না। ইভিএম নিয়ে এত প্রশ্ন মানুষের মনে, জবাব দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
কৃষকদের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, কৃষকদের এই সুবিশাল আন্দোলন থেকে নজর ঘোরাতেই উত্তরপ্রদেশ সরকার লাভ জিহাদ সংক্রান্ত আইন তৈরি করেছে। আমরা মনে করি এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি সুয়ো মোটো পদ্ধতিতে মামলা করতে পারে কারণ এটা সংবিধানবিরোধী। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কাকে বিয়ে করবেন সেটা তিনি নিজেই ঠিক করবেন এই অধিকার সংবিধান তাকে দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বাড়ছে। সবই হচ্ছে হিংসা ও ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করার জন্য। এ দেশ শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য, বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। এই নতুন ভারতের প্রতীক হিসেবে রাম মন্দির, নতুন সংসদকে তুলে ধরা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন বিহারের মতো বিজেপি’র বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে সবাইকে একজোট হতে হবে। ওখানে বিভিন্ন কারণে যদিও বিজেপি-কে হারানো যায়নি তবে কাছাকাছি পৌঁছানো গেছিল। এখন দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন। পাটিগণিতে এর সঙ্গে ২ যোগ করলে চার হয়। রাজনীতিতে সেটা শূন্য হতে পারে, ২২ হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি-কে এনেছে এটা সবাই জানে। কতবার তৃণমূল বিজেপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে লড়েছে, কতবার সমঝোতা করেছে, কতবার কেন্দ্রের মন্ত্রীসভায় থেকেছে সেটা সবাই জানে। জনগণের দাবি দাওয়া নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। তাই এদেরকে হারাতে গেলে পাটিগণিতের মাধ্যমে নয়, রাজনীতির মাধ্যমে হারাতে হবে। বিকল্প নীতির ভিত্তিতে পরাস্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ, রাজ্যের মানুষের প্রাথমিক দাবি এবং চাহিদা হলো বিজেপি-কে পরাস্ত করা। তাই মানুষকে সংগঠিত করে এই দুই দলকে পরাস্ত করতে হবে। বাংলার ভবিষ্যতের জন্য, বাংলার তরুণদের বাংলার মানুষের উন্নত আগামীর জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এটাই বিশ্লেষণ যা মার্কসবাদ আমাদের শিখিয়েছে।
সূর্য মিশ্র বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের হাতিয়ার হলো গণশক্তি। এই পত্রিকা আক্রমণের মুখে বারবার পড়েছে, কিন্তু তাকে কেনা যায়নি, আত্মসমর্পণ করানো যায়নি। মানুষের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে গণশক্তি এগিয়ে চলেছে।
এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, করোনার সঙ্গে যুদ্ধের বদলে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে বিজেপি এবং তৃণমূল। কিন্তু ২০২০ সালটা শুধু আঘাতের বছর ছিল না, ওটা প্রত্যাঘাতেরও বছর। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন সেই প্রত্যাঘাতকে দেখিয়ে দিচ্ছে, আগামীদিনে এরকম আন্দোলন আরও জোরালো হবে। আর গণশক্তি মানুষের এই সব আন্দোলনে ভাষা জোগাচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ এখন আমাদের প্রধান শত্রু চেনাতে উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। সিপিআই(এম)-কে শত্রু চেনাতে হবে না।
বিমান বসু বলেছেন, শত্রুরা বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে চাইছে। আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসকদলকে পরাস্ত করতে হবে। তিনি বলেছেন, গণশক্তির অর্থবল নেই, পত্রিকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। আদালতে মামলা জেতার পরেও গণশক্তিকে বিজ্ঞাপন দেয় না সরকার। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে পথ চলছে গণশক্তি।
গণশক্তির সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী সভায় গণশক্তির সকল শুভানুধ্যায়ীকে প্রতিষ্ঠা দিবসের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, গণশক্তির অর্থনৈতিক সঙ্কট আছে, কিন্তু গণশক্তির আত্মপরিচয়ে কোনও সঙ্কট নেই।
এদিনের অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন হিরণন্ময় ঘোষাল এবং সহ-শিল্পীবৃন্দ।