৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
চলমান কৃষক আন্দোলন শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরের অভূতপূর্ব ঐক্যের নজির সৃষ্টি করছেঃ হান্নান মোল্লা
গণশক্তির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে বক্তব্য রাখছেন হান্নান মোল্লা। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ থাকবো লড়বো জিতবো। দেশের সর্ববৃহৎ কৃষক আন্দোলনের প্রথম কর্পোরেট বিরোধী এই স্লোগানকে সঙ্গী করে সরকারকে নতি স্বীকার করিয়েই ফিরবো। কালা কৃষক আইন প্রত্যাহার করতেই হবে সরকারকে। বৈঠকের নামে সময় নষ্ট করে কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে কৃষকদের মনোবল ভেঙে দিতে। কিন্তু কৃষকদের জেদ ও লড়াকু মেজাজ মোদীর জানা নেই। সরকারের জনবিরোধী নীতি এবং কর্পোরেটের একচেটিয়া লুটের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী লড়াইয়ে কৃষকরা জিতবেনই। এই কৃষক আন্দোলনের নতুন দিক হলো শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী। যা বৈপ্লবিক সম্ভাবনার একটা দিক। সমস্ত শ্রমিক সংগঠন কৃষকদের দাবিগুলি সমর্থন করছেন। এই লড়াইয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। চাপ সৃষ্টি করতে হবে দেশজুড়ে। ছাত্র, শিক্ষক, মহিলা, যুব-সকলের সমর্থন চাই। এটা ভারতের গণ আন্দোলনের একটা নতুন দিক।গণশক্তির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিশেষ আলোচনায় এ কথা বলেন সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা।
তিনি বলেন,৬ থেকে ২০ জানুয়ারি গোটা দেশে কৃষকরা থাকবেন রাস্তায়। ২৩, ২৪ এবং ২৫ জানুয়ারি প্রতিটি রাজ্যে রাজভবন ঘেরাও করে রাখবেন হাজার হাজার কৃষক। রাজ্যপাল কেন্দ্রের সরকারের প্রতিনিধি, তাই প্রতিটি রাজ্যের রাজভবন ঘিরে ফেলবেন কৃষকরা। ২৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকার দাবি না মানলে দিল্লির পাঁচটি সীমান্ত থেকে কৃষকরা এগিয়ে যাবেন রাজধানীর বুকে। ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসের সেনা কুচকাওয়াজের পর দিল্লি দেখবে কৃষকদের কুচকাওয়াজ। ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লির রাস্তায় সংগঠিত হবে ‘কিষান প্যারেড’। সরকার লাঠি চালিয়ে, গুলি চালিয়ে এই আন্দোলন ভাঙতে পারবে না।
হান্নান মোল্লা বলেন, রাতারাতি এই কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এই সরকার কৃষি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে কর্পোরেটদের স্বার্থে। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে গায়ের জোরে সরকার আইন তৈরি করেছে। কৃষকরা পরের দিন থেকেই রাস্তায়। দেশ জুড়ে কৃষি অর্ডিন্যান্সের কপি জ্বালিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন কৃষকরা। অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং আরও দু’শোটির বেশি সংগঠন মিলিয়ে মোট ৫০০টির বেশি কৃষক সংগঠনের যৌথ লড়াইয়ের মঞ্চ থেকে তখন সংযুক্ত কিষান মোর্চা ঘোষণা করে, দিল্লি যাবেন কৃষকরা। কৃষি অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে দেশের ৬০০টি জেলায় এক কোটির বেশি কৃষক জেল ভরো আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। দীর্ঘ সাত মাস ধরেই সরকারের কাছে ধারাবাহিকভাবে দাবি জানিয়ে এসেছেন কৃষকরা। তারপরেও সরকার কথা শোনেনি। ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে যখন সরকার অর্ডিন্যান্সকে আইন করতে চেয়েছে, সে দিনও কৃষকরা ছিলেন সড়কে। সরকার কর্ণপাত করেনি।
তিনি বলেন, ৫ নভেম্বর থেকে পাঞ্জাবে কৃষকরা রেল রোকোতে শামিল হয়েছেন, রাস্তা রোকোতে শামিল হয়েছেন। সরকার কথা না শোনায় কৃষকদের দিল্লি আসার পথেও বাধা দিয়েছে সরকার। লাঠি চলেছে, টিয়ার গ্যাস চলেছে। রাস্তা খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। তবু কৃষকদের থামানো যায়নি।
এই কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হান্নান মোল্লা বলেন, মূলত পাঁচটি কারণে এই কৃষক আন্দোলন ঐতিহাসিক। প্রথমত, দেশের স্বাধীনতার পর এটি বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন যা সারা দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকতম ঐক্য। ৫০০টির বেশি কৃষক সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত হলেও কৃষি আইন বাতিল সম্পর্কে মূল দাবির প্রশ্নে সবকটি সংগঠন একমত। তৃতীয়ত, আন্দোলনের চরিত্র অহিংস, একটিও হিংসার ঘটনা ঘটেনি। চতুর্থত, এই আন্দোলন গোটা দেশের মানুষের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। পঞ্চমত, এই আন্দোলন শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী শক্তিশালী করেছে, শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরের বেনজির ঐক্য গড়ে তুলেছে। নতুন বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
তিনি বলেন, কৃষকদের ক্লান্ত করে দিতে চাইছে সরকার বৈঠকের পর বৈঠক করে। আমরা তিনটি কৃষি আইন বাতিল করার পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাই। মানুষকে ভুল বোঝাতে আর মূলপ্রস্তাবগুলোর সঙ্গে একমত না হলেও সরকার ৫ শতাংশ দাবি মেনে নিয়ে বাইরে এসে বলেছে ৫০ শতাংশ দাবি মানা হয়েছে।
হান্নান মোল্লা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে কৃষকদের দাবি ব্যাখ্যা করে বলেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হলো যে দামের নিচে ফসল বিক্রি করলে কৃষকের লোকসান হবে। সরকার এখন যে দাম চালু রেখেছে সেটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। সরকার এই দাম বহাল রাখতে চাইছে। এই দামে কৃষকদের চাষের খরচ উঠছে না। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত সমস্ত খরচের দেড় গুণ। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেবার ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলছেন। মোদী যেটা রোজ টেলিভিশন এবং অন্যান্য জায়গায় বলে যাচ্ছেন সেটা মিথ্যে কথা। স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলা অনুযায়ী রাজ্যগুলি যে দাম চায় এটা তার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। সার, সেচ, বিদ্যুৎ, শ্রম, জল, ডিজেলের দাম এবং জমি ভাড়া বা জমির সারাবছরের ক্ষয়ক্ষতির যে মূল্য ধরা আছে স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলায়, তার ভিত্তিতে দাম ঠিক করতে হবে। কিন্তু সরকার এখন জমির দামটুকু ধরে দিচ্ছে। এই দাম পেলে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। তাঁরা আত্মহত্যা করছেন।
তিনি বলেন, কৃষকরা বলেছে আইনি অধিকার দিতে হবে পাঁচটি বিষয়ে। খরচের দেড়গুণ দাম হওয়া উচিত। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের তালিকায় চার-পাঁচটা ফসল এখনে যুক্ত আছে। আমরা বলছি সমস্ত ফসলের ক্ষেত্রে এই দাম দিতে হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এখন দেশের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক পায়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশ ছাড়া বাকি রাজ্যের কৃষকরা এটা পায়না। সরকারকে নির্ধারিত দামে ফসল সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি সংস্থা কিনলেও ওই দাম দিতে হবে। যে বা যারা এটা মানবে না তার সাজা হবে। আদানি আম্বানি - যাদের হাতে এই ফসল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার, তারা সঠিক দামে কিনবে না-এটা চলবে না। এইসবগুলির আইনি অধিকার না পেলে কৃষককে যেমন আজও ঠকানো হচ্ছে, আগামী দিনেও ঠকানো হবে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে কৃষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সংসদে প্রাইভেট বিল পেশ করে দু’টি আইন কৃষকরা আনতে চেয়েছিল। ফসলের দাম এবং ঋণ মকুব সংক্রান্ত ওই দু’টি পেশ করা প্রস্তাবে সরকার এখনো পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি। সরকার যেটা করছে তা মালিকের পক্ষেই যাচ্ছে।
কৃষক আন্দোলনের প্রতি দেশের সব অংশের মানুষের সমর্থনের প্রশ্নে তিনি বলেন, এই তিনটে আইন শুধু কৃষকের নয় সমস্ত মানুষের পক্ষেই সর্বনাশ ডেকে আনবে তা মানুষ বুঝছেন। মজুতদারি বন্ধ করবার জন্য ১৯৫৫ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন লাগু করা হয়। সংশোধনী এনে বাইশটি পণ্য বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। সরকার নিজের দায়িত্ব থেকে সরে গেল। এই আইন না থাকার কারণে সরকারকে কৃষকের থেকে কিনতে হবে না। কৃষক যে লাভ পেত তা পাবে না। আর সরকার না কিনলে রেশন ব্যবস্থা উঠে যাবে। তাহলে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর মধ্যবিত্ত এবং এমনকি কৃষকদের একটা অংশ যাঁরা নিজেদের ফসল বিক্রি করে দেন সহ সমস্ত অংশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তিনি বলেন, মান্ডি ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিহারে ২০০০ সালে তা তুলে দেওয়ার পর সেখান থেকে কৃষকরা এখন অন্যত্র কাজ করতে যান আপনারা জানেন। সরকারি মান্ডির পাশে পাশে আদানি আম্বানিরাও মান্ডি খুলবে। কিছুদিন পর এই আইনের ফলে সরকারের মান্ডি উঠে যাবে। তখন বেসরকারি এইসব সংস্থাগুলো যা ইচ্ছা দাম দেবে। ব্যাপারটা অনেকটা জিও টেলিফোনের মতো, প্রথমে অনেক ছাড় দেবে তারপর তিন গুণ ৪ গুণ দাম বাড়িয়ে দেবে। রাজ্য সরকারগুলি এই মান্ডিগুলি থেকে যে ট্যাক্স পেত সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।
মজুতদারি সম্পর্কে তিনি বলেন, আড়তে মজুতদারির সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আদানি আম্বানিরা বহু গোডাউন তৈরি করে ফেলেছে। এফসিআই গোডাউন বন্ধ হয়ে গেলে সমস্ত ফসল এই বেসরকারি গুদামে চলে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গরিব মানুষ।
হান্নান মোল্লা বলেন, কনট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তি চাষের ক্ষেত্রে আদানি আম্বানিরা সুযোগ পেলে চাষিরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে ৮৬ শতাংশ কৃষকের ২ একরের কম জমি আছে। এই ছোটো চাষিরা বড়ো কোম্পানির সঙ্গে অসম শর্তে চাষ করতে বাধ্য হবে। উৎপাদিত ফসলে কোনোরকম দাগ হলে তা কোম্পানি নিতে চাইবে না। কৃষকের লোকসান হবে। তার ক্ষতিপূরণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। তার দেনা হবে! দেনা মেটানোর জন্য তাকে আবার ঋণ করতে হবে। এই সুযোগে কর্পোরেট তাকে টাকা ধার দিয়ে তার জমি নিয়ে নেবে। কৃষকের জমি চলে যাবে। কৃষক তার নিজের জমিতে ক্রীতদাস হয়ে যাবে। দেশের কৃষিতে ২৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজার রয়েছে। ৭০ কোটি কৃষক রয়েছেন দেশে। ভারতের রোজগারের ৫০ শতাংশ কৃষি থেকে আসে। সরকারের আইনের ফলে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে। ছোটো আড়তদার বিক্রি করে স্থানীয়ভাবে। কিন্তু আদানি আম্বানিরা ফসল প্রচুর মজুদ করবে এবং ইচ্ছেমতো দাম বাড়াবে। এরা পরে বলবে, গম চাষের দরকার নেই। বিদেশে যা বিক্রি হয় তুমি সেটা চাষ করো।
তিনি তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, অন্নদাতারা নিজের লোকসান করে দেশবাসীকে খাওয়াচ্ছে, সরকার তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অন্নদাতারা চীন পাকিস্তানের দালাল! মোদী তুমি আমেরিকার দালাল হতে পারো তুমি দেশ বিক্রি করে দিতে পারো আমেরিকার কাছে।বাকি সব অংশের মানুষ বিক্রি হতে পারে, বুদ্ধিজীবী পলিটিশিয়ান অন্য অংশের ব্যাপারীরা বিক্রি হতে পারে, কিন্তু কৃষক কখনো বিক্রি হতে পারে না। তারচেয়ে বড়ো দেশপ্রেমিক নেই। কারণ দেশ হলো মাটি। আর মাটি থেকে কৃষকের জীবনের রসদ আসে।