৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠক ফের নিস্ফলা
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় কৃষক নেতৃবৃন্দ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সপ্তম দফার বৈঠকও নিস্ফলাই রইল। ৪ জানুয়ারির এই বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একযোগে জানিয়ে দিয়েছেন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আলোচনা এগোবে না। কেন্দ্রের তরফে ঘুরে ফিরে কৃষি আইনে সংশোধনীর কথা বলো হলেও তা মানতে রাজি হননি কৃষক নেতারা। পরবর্তী বৈঠক হবে ৮ জানুয়ারি। কৃষক নেতারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, সেদিন যেন সরকার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জানিয়ে দেয়। অযথা কালক্ষেপ করা কৃষকেরা আর মেনে নেবেন না।
এদিন নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে বৈঠকের শুরুতে আন্দোলনে মৃত এবং আত্মঘাতী কৃষকদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়। মন্ত্রীরাও যোগ দেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর, রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এবং কৃষি রাষ্ট্রমন্ত্রী সোমপ্রকাশ। বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী কৃষক নেতাদের কাছে আবারও সংশোধনী নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলে কৃষকনেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আমরা এ নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। বারবার একই কথা বলছে সরকার। একথা আর শোনা হবে না। বৈঠকে মন্ত্রী ৪০টি সংগঠনের কথা উল্লেখ করলে, কৃষক নেতারা জবাবে বলেন, ৪০টি নয়, ৪৫০টি সংগঠন রয়েছে, প্রত্যেকে একমত যে আইন প্রত্যাহার ছাড়া কোনো কথা শোনা হবে না। কোনো মতপার্থক্য নেই। কৃষক নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকারের কাছে একটিই বিকল্প রয়েছে - তিন কৃষি আইন তুলে নেওয়া। অন্য কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যাহারের বিকল্প প্রত্যাহারই।
কৃষকনেতারা বলেন, হাজার হাজার কৃষক রাস্তায় বসে রয়েছেন। বহু কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এ দায় সরকারের। সরকার যদি এখনো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা না করে তাহলে সরকারকে তার ফল ভুগতে হবে। এদিনের বৈঠকের বিরতিতে কৃষক নেতৃবৃন্দ লঙ্গর থেকে আনা খাবারই খান। বিকেল সওয়া পাঁচটা নাগাদ পুনরায় বৈঠক শুরু হলে কৃষকনেতারা নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় ঠিক হয় ৮ জানুয়ারি পুনরায় বৈঠক হবে। যদি সরকার তিন আইন তুলে নেয় তাহলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা দেওয়া নিয়ে কথা হবে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেন, কৃষক নেতারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিয়ে এসেছেন তুলে নাও, তুলে নাও, তুলে নাও। এছাড়া কোনো আলোচ্য বিষয় নেই। ৪৫০টি কৃষক সংগঠন একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু নেতাদের সিদ্ধান্ত নয়, কৃষকদের সিদ্ধান্ত। আইন না তুলে নেতারাও ঘরে ফিরতে পারবেন না। সরকার চাপে পড়েছে। মন্ত্রী আমাদের বলছেন, আইন তোলা অনেক অসুবিধা অছে। আমরা পথও বাতলে দিয়েছি। হয় অর্ডিন্যান্স এনে তুলে নাও, না হলে একদিনের জন্য সংসদ অধিবেশন ডাকো। সহজ রাস্তা। এরপরে কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু অকেজো কথা, কাজের কথা নয়। সরকার আমাদের বলেছিল আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুন, আমরা বলেছি আমাদের আলোচনা হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সরকার শেষে বলেছে, তারাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ৮ জানুয়ারি আবার বৈঠকে বসবে। ইতিমধ্যে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তা চলতে থাকবে।
ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতা বলবীর সিং রাজেওয়াল বলেন, আমরা স্পষ্ট জানিয়েছি আইন প্রত্যাহারের নিচে কোনো সমাধান সূত্র বেরোবে না। আইন প্রত্যাহারে রাজি হলে তখন এমএসপি-র আইনি নিশ্চয়তা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, সরকার অহংবোধে ভুগছে।
কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এখনও আশাবাদী। আবারও বৈঠক হবে। তবে এক হাতে তো তালি বাজে না। কৃষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। পরে কৃষক নেতারা বলেন, আইন পাশ করার আগে একথা সরকারের মনে ছিল না? কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে তখন কথা বলা হয়নি কেন? সংসদের নিয়মকানুনও মানা হয়নি।
আন্দোলন কর্মসূচি
কৃষক আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা করেন, দাবি না মিটলে ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে রাজধানী দিল্লির বুকে হবে কৃষক প্যারেড। ট্রাক্টর, ট্রলি ও অন্যান্য যানবাহন নিয়ে দিল্লির রাস্তায় প্যারেড করবেন কৃষকরা। সাধারণতন্ত্র দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানের পরই এই অভিনব প্যারেড দেখবেন দেশবাসী। দিল্লি ঘিরে কৃষক অবস্থানের ৩৮তম দিবসে ২ জানুয়ারি দিল্লির প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃবৃন্দ। এই সাংবাদিক সম্মেলনে বলবীর সিং রাজেয়াল, দর্শন পাল, গুরনাম সিং চাদুনি, অশোক ধাওয়ালে, জগজিৎ সিং ধালেওয়াল, অভিমন্যু কোহাদ, যোগেন্দ্র যাদব উপস্থিত ছিলেন।
কৃষক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন চালিয়েছি। অনেক অগেই আমরা সরকারকে বলেছি, সরকারের সামনে দু’টি বিকল্প খোলা আছে - হয় তিন কৃষি আইন বাতিল করো অথবা গায়ের জোরে আমাদের তুলে দাও। সময় এসেছে নির্ণায়ক সিদ্ধন্ত নেবার। আমরা ২৬ জানুয়ারিকে বেছে নিয়েছি দু’টি কারণে। এক, সাধারণতন্ত্র দিবস জনগণের অধিকার ঘোষণার দিন। দুই, সেইদিন দিল্লির সীমান্তে আমাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দু’মাস পূর্ণ হবে। অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে চূড়ান্ত ধৈর্য নিয়ে আমরা দু’মাস অপেক্ষা করছি।
তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা নিয়ে কেন্দ্র নিজেদের অবস্থানেই রয়ে গেছে। এদিন কৃষক নেতারা জানান, ৬ থেকে ২০ জানুয়ারি কৃষকদের দাবি ব্যাখ্যা করে এবং সরকারের অসত্য প্রচারের মুখোশ খুলে দিতে, ‘দেশ জাগৃতি অভিযান’ হবে। মিছ্লি ধরনা, সম্মেলন, বিক্ষোভ হবে দেশজুড়ে।
লোহারি/সংক্রান্তি পালিত হবে ‘কিষান সংকল্প দিবস’ হিসাবে তিন কালা কানুনের কপি পুড়িয়ে। ১৮ জানুয়ারি মহিলা কিষান দিবসে তুলে ধরা হবে কৃষিতে মহিলাদের ভূমিকার কথা। ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মবার্ষিকী পালিত হবে আজাদ হিন্দ কিষান দিবস হিসাবে। ওইদিন সব রাজ্যের রাজধানীতে রাজ্যপালের সরকারি বাসভবনের বাইরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হবে। ৬ জানুয়ারি কে এম পি এক্সপ্রেস ওয়েতে কৃষকদের মিছিল হবে। ট্রাক্টর, ট্রলি নিয়ে সেই মার্চ হবে। শাহজাহানপুরের অবস্থানকারী কৃষকরা রওনা দেবেন দিল্লি অভিমুখে। এইসব কর্মসূচির শীর্ষে সাধারণতন্ত্র দিবসে রাজধানীতে হবে কৃষক প্যারেড। ওইদিন দিল্লিতে শান্তিপূর্ণভাবে ঢুকে পড়া ছাড়া কৃষকদের কোনো বিকল্প থাকবে না। এদিন কৃষক নেতৃবৃন্দ স্পষ্টই জানিয়ে দেন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারই একমাত্র বিকল্প।
কৃষকদের উপর হামলার তদন্ত চেয়ে ছাত্রদের চিঠি
দিল্লি সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের উপর পুলিশি দমনপীড়নের ঘটনার তদন্তের দাবিতে দেশের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদেকে চিঠি দিলেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে ছাত্ররা অভিযোগ করেছেনঃ কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর অযৌক্তিকভাবে জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। একইসঙ্গে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে অবৈধভাবে আটকও করা হয়েছে। পুলিশের এই বাড়াবাড়ির তীব্র নিন্দা করে এই ঘটনায় উপযুক্ত তদন্তের দাবি করেছেন ছাত্ররা। পাশাপাশি, নিরপরাধ কৃষকদের বিরুদ্ধে পুলিশের জারি করা সমস্ত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে নির্দেশ দেবার দাবিও জানানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিরাচপতির কাছে।
প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে সাক্ষর করেছেন ৩৫ জন ছাত্র। তাঁরা চিঠিতে প্রধান বিচারপতির কাছে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের কাছেই যথাযথ নির্দেশ দেবার দাবি তুলেছেন। এছাড়া দিল্লি সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষক পরিবারের সদস্য বিশেষত শিশু, মহিলা ও প্রবীণদের জন্য শৌচাগার, পানীয় জল সহ ন্যূনতম পরিষেবা দেবার দাবিও চিঠির মাধ্যমে তুলেছেন ছাত্ররা।