E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭

ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিতে কেন্দ্রের সরকারের আপত্তি কেন?

ঈশিতা মুখার্জি


দেশে কৃষক আন্দোলন চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত । এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি হলো ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। এই মূল্য নিয়ে দেশের সরকার এত অনড় কেন? কোথায় সমস্যা আছে ? এই মুল্য যদি ঘোষিত হয় তাহলে সরকারের কোথায় অসুবিধা হয়- এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে স্বামীনাথন ফরমুলার কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এই ফরমুলা ২০০৪-০৬ সালে কৃষি সংক্রান্ত যে কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক স্বামীনাথন সেই কমিশনের প্রস্তাবিত ফরমুলা। এই ফরমুলা অনুযায়ী ফসলের দামের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ফসল ফলানোর সম্মিলিত খরচ এবং এর সঙ্গে ৫০শতাংশ যোগ করে। এই সম্মিলিত খরচ হলো উৎপাদনের গড় খরচ। এই ফরমুলা আজ দেশের সব কৃষকের মুখে মুখে ফিরছে। বিজেপি সরকার ২০১৪ সালে তাদের নির্বাচনী ইশ্‌তাহারে এই ফরমুলা অনুযায়ী চাষিরা দাম পাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, কেন তাহলে এই মূল্য কৃষকেরা পাচ্ছেন না?

আসলে স্বামীনাথন কমিশন ৩ ধরনের খরচের কথা বলে। এগুলি হলো A2, A2+FL, C2 - যেগুলিকে কৃষির খরচ বলা যেতে পারে। এতরকম কেন তা এগুলি ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যাবে। A2 হলো ফসল উৎপাদনের টাকার অঙ্কে বা অন্যভাবে কৃষককে যা যা উপাদান কিনতে হয়, তার খরচ। যেমন বীজ, সার, কেমিক্যাল, খেতমজুরের মজুরি, জ্বালানি, সেচ ইত্যাদি। জমি আছে, যৎসামান্য হলেও জমি যদি থাকে তাহলেই তো ফসল ফলানো যায় না, এই খরচ তো আছেই। কিন্তু এটিই কী একমাত্র খরচ ? কৃষকের পরিবারের মানুষজন তো চাষ করেন, সেই পারিবারিক শ্রমের মূল্য না ধরলে তো সেই শ্রমের দাম থাকে না। তাই FL হলো সেই পারিবারিক শ্রমের মূল্য যা হিসেব করে যুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে বলা প্রাসঙ্গিক যে, মহিলা কৃষক এই পারিবারিক শ্রমের মধ্যে অন্তর্গত থাকে বলে তাঁদের সরকারি পরিসংখ্যানে কৃষক বলে কোনো পরিচিতি থাকে না। তাই, A2+FL হলো প্রকৃত অর্থে জমি বাদ দিয়ে চাষের খরচ। স্বামীনাথন ফরমুলা কিন্তু এই দুটির একটিকেও প্রকৃত খরচ বলে নি। তারা বলেছেন C2-র কথা। এই C2 হলো এই জমি থেকে খাজনা আয় না করে বা সুদ বাবদ আয় না করে এই জমিতে ফসল ফলানোর যে ঝুঁকি, তার দামও ধরতে হবে A2+FL-এর সঙ্গে মোট খরচের হিসেব ধরলে। ফরমুলা এই C2কেই খরচ ধরে এর সঙ্গে ৫০ শতাংশ যোগ করার কথা বলেছে। সরকার C2-কে খরচ হিসেবে দেখতে নারাজ। ২০১৮ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন যে, সরকার ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দেবে এবং এটিই প্রথম নাকি কৃষকদের কথা ভেবে কোনো সরকার বাজেট তৈরি করেছে। সেখানে কিন্তু ফরমুলা A2+FLকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, আর সরকারের এই হিসেবে আসলে কৃষক বঞ্চিত হয়েছিলেন। ফলে দেখা গেল যে, উৎপাদনের খরচ বলতে যা বোঝা যায়, তা আসলে মোট খরচের অনেক কম। ২০১৮ সালের সেই হিসেব কয়েকটি ফসলের জন্য নিচে দেখানো হলো।

তাহলে সরকারের হিসেবে তো ফসল ফলানোর খরচটাই উঠবে না, এই কৃষিকাজে তাহলে কৃষকের বঞ্চনা ছাড়া আর কী ছিল?

এখন প্রশ্ন হলো সরকার এরকম হিসেব করে যে চলেছে তার কারণ কী? কারণ হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি সংক্রান্ত বাণিজ্যে চুক্তিবদ্ধ আমাদের দেশের সরকার। এটি হলো AoA বা Agreement on Agriculture বা কৃষি সংক্রান্ত চুক্তি। এটি উরুগুয়ে রাউন্ডে থাকলেও কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যের আওতায় আনা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক মূল উদ্দেশ্য। আমাদের দেশ ২০১৪ পর্যন্ত এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় নি। এমন নয় যে, অন্য দেশগুলিও বিশেষভাবে এই বিষয়ে সক্রিয় হয়েছিল। এই চুক্তির মধ্যে ৩টি বিষয় আছে, যার মধ্যে একটি হলো দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমর্থন। এই সমর্থন হলো ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। এ নিয়ে তাই বিজেপি সরকার ২০১৮ সালে কৃষকদের কাছে এই অসত্য বার্তা দিয়েছে। এর কারণ হলো, সরকারের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ। ২০১৮ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে ভারত সম্পর্কে নালিশ জানায় যে, ১৯৮৬-৮৮ সালের ভিত্তিতে বিশ্বের বাজারে ফসলের গড় দাম স্থির করলে ভারতের কুইন্টাল পিছু ধান ও গমের সহায়ক মূল্য হয় ২০১৩-১৪ সালে ২৩৫ টাকা এবং ৩৫৪ টাকা যথাক্রমে। এরকম হাস্যকর একটি হিসেব দেওয়ার পরেও আমাদের দেশের তরফে তাদের সাথে আপস করার কথা বলেছে বিজেপি সরকার। আমাদের দেশে যে মূল্য চালু ছিল তা এমনিতেই কম, তা সত্ত্বেও তা ছিল ১৩৪৮ টাকা এবং ১৩৮৬ টাকা যথাক্রমে। তফাতটা মারাত্মক। এই হিসেব আমাদের দেশে চালু করার কথা ভাবা যায়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত অনুযায়ী এই হিসেব না মানা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিভঙ্গের শামিল - এই বলে চাপ দেয় বিজেপি সরকারকে। সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই দ্রুততার সাথেই ফসলকে বাণিজ্যভুক্ত পণ্য হিসেবে চালু করার কথা ভাবতে শুরু করে বিজেপি সরকার। দু মাস আগেও প্রশ্ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই প্রশ্ন। তাই তড়িঘড়ি কৃষিপণ্যকে বাণিজ্য পণ্যে রূপান্তরিত করে কৃষি আইন বলবৎ হলো। এই চুক্তির অন্য দিকটি হলো বিশ্ববাজারের অনুপ্রবেশ। সরকার অনুমোদিত বেশ কিছু রচনাও লেখা হলো এই মর্মে যে, বিশ্বের বাজারে আমাদের কৃষকদের বিক্রি করতে দেওয়া উচিত, দেশের মানুষের কাছে যা দাম পায় বিশ্বের খোলাবাজারে নাকি তার চেয়ে তারা বেশি দাম পাবে - এমনই সব কথা। কৃষককে হঠাৎ ব্যবসায়ী বানিয়ে দেওয়া হলো এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আর কোনো প্রয়োজন তাহলে নাকি থাকবে না।

এই বঞ্চনার কথাই সরাসরি না বলে এমন অসত্য আচরণ এবং তথ্য ২০১৪ সাল থেকে করে এসেছে বিজেপি-আরএসএস। কেন আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শুধুমাত্র কৃষকদের নয় দেশের মানুষের এই পরিসংখ্যান সেই তথ্য জানায়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকলে দেশের রেশনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আর খাদ্য সুরক্ষাও ভেঙে পড়বে – এই তথ্য সে কথাই বলছে।

ফসলের খরচ এবং সরকারের নির্ধারিত দাম সেই সময়ে (টাকা কুইন্টাল পিছু)

ফসল A2+FL C2 MSP ২০১৭-১৮ MSP ২০১৮-১৯
ধান ১১৬৬ ১৫৬০ ১৫৫০-১৫৯০ ১৭৫০-১৭৭০
জোয়ার ১৬১৯ ২১৮৩ ১৭০০-১৭২৫ ২৪৩০-২৪৫০
মুগ ডাল ৪৬৫০ ৬১৬১ ৫৫৭৫ ৬৯৭৫
তুলো ৩৪৩৩ ৪৫১৪ ৪০২০-৪৩২০ ৫১৫০-৫৪৫০