৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
কালের ধ্রুবতারা
অণিমা ভট্টাচার্য
শতবর্ষে এক দুরন্ত ঘোড়সওয়ার। ঝড়ের পিঠে ছুটে চলা এক অবিশ্বাস্য নারী সৈনিক। অনেক সৃষ্টির সংগ্রামের এক চলমান প্রেরণা, সমাজ পরিবর্তনের এক নির্ভীক অদ্বিতীয়া যোদ্ধা - তিনি কমরেড কনক মুখোপাধ্যায়। জন্মশতবর্ষের সূচনায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই, স্যালুট জানাই।
আমাদের দেশে বিপ্লব কবে হবে জানি না, কত দূর সে ধ্রুবতারা জানি না। কিন্তু একজন সংগ্রামী মানুষ সারাজীবন প্রবল গতিতে সমাজ পরিবর্তনের ধ্রুবতারাকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছিলেন। অজানিতের পথ কাটতে কাটতে এগিয়ে গেছিলেন - ভাবলে বিস্ময়ের অবধি খুঁজে পাই না।
এমন কত মেয়েই তো সংসারের পাঁকে হারিয়ে যায়, কিন্তু মনের ভেতর সমাজের ঘোর অন্ধকার, জড়তা দূর করবার দৃঢ় চেতনা নিয়ে যে দু’চারজন বল্গাহীন গতিতে বাধা ভাঙতে ভাঙতে, কঠিন পথ কাটতে কাটতে ছুঁটতে পারেন, ভেঙে গড়তে পারেন, তারা কখনও হারিয়ে যান না, যেমন কনকদিরা হারান না। তাই তাঁর জন্মশতবর্ষে বাংলার মানুষের কাছে, বিশেষ করে নারীসমাজের কাছে কনক মুখোপাধ্যায় ধ্রুবতারার মতো আকাশ উজ্জ্বল করে বেঁচে আছেন। আমরা তাই গর্বিত - তাঁকে লাল সেলাম।
আমি কলকাতার বাইরে মেদিনীপুরে কর্মসূত্রে থাকতাম। সমিতি সংগঠনের সুবাদে তাঁর সঙ্গে যোগ ছিল। ১৯৮৮ সালে মেদিনীপুর পার্টি সম্মেলনে কনকদি এবং আরও কয়েকজন মহিলা সমিতির নেতৃস্থানীয় কমরেড সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাকে দু’হাত ধরে অনুরোধ করলেন - অণিমা, একসাথে’তে লেখা দাও। আমার তখন চাকরি এবং অধ্যাপক সমিতির, পার্টির কাজের চাপের জন্য সময়াভাব জানালাম। বললেন - নিদেনপক্ষে রিপোর্টাজ লেখ। এইরকম করে একসাথে পত্রিকার জন্য লেখিকা সংগ্রহের দক্ষতা ছিল দারুণ। এইভাবেই রাজ্যজুড়ে এবং অন্য রাজ্যের থেকেও লেখিকা যুক্ত হয়েছিলেন অনেক। ১৯৯৫ সালের পর একসাথে পত্রিকা এবং কনকদির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে গেলাম।
কনকদি এবং ‘একসাথে’ পত্রিকা সমার্থক। আমার পার্টি সদস্যপদ সুকুমারদার হাতে। আমার রাজনীতির ক্ষেত্রও ছিল মেদিনীপুরেই। আমরা প্রতিদিনের সঙ্গী। তিনি শিক্ষক আমি ছাত্রী। সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা হলো। হাতেকলমে কাজ করিয়ে, ভুল শুধরে যোগ্য কর্মী তৈরি করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল কনকদির। ক্রমে আমাকে তিনি নিয়মিত লেখিকা তৈরি করলেন। প্রেস থেকে লেখা মুদ্রিত হয়ে এলে প্রুফ দেখা হতো - সেও তিনি দৃষ্টিহীন হলেও শিখিয়ে দিতেন। লেখা এলে সম্পাদকমণ্ডলীতে পড়া হতো, সবার মত নিয়ে লেখা নির্বাচিত হতো। এই কাজগুলো বিশেষ করে প্রুফ দেখার কাজটা হাতে কলমে করিয়ে নিতেন। বলতেন - ‘শিখে নাও আমি চলে গেলে তো এভাবেই পত্রিকা চালিয়ে যেতে হবে।’
তিনি আদ্যন্ত রাজনীতির মানুষ - ‘একসাথে পত্রিকা’, ‘সানন্দা’, ‘দেশ’-র মতো পত্রিকা নয়, পুঁজিবাদী সংস্কৃতির পত্রিকা একসাথে নয়। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের অনুপ্রেরণা, আশীর্বাদ নিয়ে একসাথের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৮-তে। অবহেলা, অজ্ঞানতা, শিক্ষাহীনতা, মানসিক জড়তা যে নারীসমাজকে পঙ্গু করে রেখেছে তাদের কথা লিখবে একসাথে, সামন্ততান্ত্রিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ নারীসমাজকে মুক্তির আলো দেখাবে একসাথে। পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে আজও সে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে - এর সৃষ্টি, পুষ্টি, আদর্শ কনকদির হাতে। অবশ্য একসাথে বাংলার মহিলা রাজনীতিকদের যৌথ সৃষ্টি।
কনকদির জীবনের কথা বলতে গেলে তাঁর পরিবার সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে হয়। শিক্ষানুরাগী, শিক্ষার পরিবেশে সমৃদ্ধ একটি পরিবার। পিতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত যশোহরের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী, মাতা নলিনীদেবী যাঁকে কনকদি শিশুকালেই হারিয়েছেন, পিতামহ সীতারাম দাশগুপ্ত এল এম এফ ডাক্তার। ঠাকুমা সৌদামিনীদেবী উন্নতমনা, দেশপ্রেম, উদারচিত্তের অধিকারী, যার প্রভাব শিশু পুটুকে (কনক) প্রভাবিত করেছিল। চরিত্রের মধ্যে বীজাকারে সেইবৈশিষ্ট্যগুলোই কনক মুখার্জিকে চালিত করেছিল।
বাড়ির অনেকে, অবশ্য ছেলেরা সবাই স্কুলে যেত, মেয়েরা যেত না। বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না। তবু মাতৃহারা পুটুর লেখাপড়া শেখার প্রবল আগ্রহেই তাঁকে গ্রামের পাঠশালাতেই ভরতি করে দেওয়া হলো। ছোটো বেড়াটা ভাঙল। প্রাইমারি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে ভরতি হলেন, আবার এম ই পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে ম্যাট্রিক পর্যন্ত এগোবার পথ সুগম হলো। ১৯৩৭-এ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ। ভরতি হলেন বেথুন কলেজে। যুক্ত হলেন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে।
ইতিমধ্যে স্কুল জীবনেই যশোহরের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড কৃষ্ণবিনোদ রায় (কেষ্টদা), সুকুমার মিত্র, শান্তিময় ঘোষ (বাচ্চুদা) প্রমুখ পার্টিনেতার সংস্পর্শে আসেন এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। বুকের ভেতর প্রতিবাদী সত্তাটা আগাগোড়া তাড়িয়ে বেড়াত, যা চলছে তা চলতে দেওয়া যাবে না, বেড়া ডিঙোতে হবে। শিশু অবস্থায় পাঠশালায় পড়ার সময়ই দাদা ক্ষিতীশ দাশগুপ্ত এবং জ্যাঠতুতো ভাই নরেশ দাশগুপ্তর মতো মানুষের প্রভাবে স্বদেশী আন্দোলনে এবং গ্রামেরই একটি বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছোরা খেলা, লাঠি খেলা এবং চরকা তকলিতে সুতো কাটার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।
কলকাতায় এসেও গ্রামের মেয়ে কনক দাশগুপ্ত ছাত্র রাজনীতিতে নেমে পড়লেন। ১৯৩৮ সালে গার্লস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা। ১৯৩৯-এ লক্ষ্ণৌ অল ইন্ডিয়া গার্লস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হয়ে লক্ষ্ণৌ কনফারেন্সে প্রতিনিধিত্ব করেন। ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিতে কেবলই গ্রেপ্তার। মুজফ্ফর আহ্মদের নির্দেশে আত্মগোপনে চলে যান। পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ১৯৪২-এ নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এলেন। লতিকা সেনের বাড়িতে উঠলেন। এবার জোরকদমে মহিলা সমিতি গঠনের কাজে লেগে যান। এবার তাঁর কথায় ‘পেরিয়ে এলাম বন্ধ ঘরের চৌকাঠ’।
কাজ শুধু কাজ, গড়া আর গড়া। ১৯৪২ সালের ১৫ অক্টোবর কমরেড সরোজ মুখার্জির সঙ্গে বিবাহ। জীবনে লড়াইয়ে নতুন পালক যুক্ত হলো। পারিবারিক জীবনের বন্ধন এলো। রাজনীতি এবং পরিবার একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল। কনক দাশগুপ্ত হলেন কনক মুখার্জি।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল মহিলা বাহিনী। কমরেড মণিকুন্তলা সেন, পঙ্কজ আচার্য, গীতা মুখার্জি, বেলা লাহিড়ী, যুঁইফুল রায়, বাণী দাশগুপ্ত প্রমুখ কমিউনিস্ট কর্মী। গড়া হলো ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। ১৯৩৮ সালে পার্টির যশোহর জেলার সম্মেলনে কনক মুখার্জিকে পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হলো।
ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সমস্ত কর্মকাণ্ড সামলে, পারিবারিক দায়িত্ব সামলেও একের পর এক পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করেছেন। হিন্দি পরীক্ষায় ডিস্টিংশনে পাশ, ১৯৪৬ সালে বিএ প্রাইভেটে পাশ, ১৯৫৩ সালে ডেভিড হেয়ার কলেজ থেকে বিটি পাশ করেন প্রথম বিভাগে। এক বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে পার্টির কর্মসূচির ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজিতে স্পেশাল অনার্স এবং এমএ পাশ করেন। ইতিমধ্যে ১৯৪৮ সালে একমাত্র পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে উইমেন্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজে যোগ দিলেন। ১৯৮১ সালে এই কলেজ থেকেই অবসর নিলেন। ১৯৬৭ সালেই ইংরেজি সাহিত্যে শিক্ষা শিক্ষণ ডিগ্রি ও হিন্দি সাহিত্যের ‘পরিচয়’ পরীক্ষায় ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেন। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ঝড়ের মতো এগিয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনের নিত্যসঙ্গী কারাবাস। এবং পুলিশি নির্যাতন। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পুরো সংগ্রামী জীবন - কখনও কোথাও স্থির নিশ্চিত থাকতে পারেননি। শিক্ষক অধ্যাপকদের আন্দোলনে বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেপ্তার, চলল পুলিশের লাঠি। ডেটিনিউ ওয়ার্ডে বন্দি হলেন। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট চলছে হাজরা পার্কে। ৪৪দিন অনশনের কঠিন কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ছেলে বাড়িতে। অন্যের হেফাজতে - সে এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা। ছাড়া পেলেন ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে। এত কিছু ঘটনাবহুল সময়ের মধ্যেও সাহিত্যচর্চা, কাব্যচর্চা থেমে থাকেনি।
আবার এক রাজনৈতিক দুর্যোগ - চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ। ১৯৬২। আবার বিনাবিচারে গ্রেপ্তার কমরেড সরোজ মুখার্জি, কনক মুখার্জি। ১৯৬৩-তে মুক্তি, এরই মধ্যে কলম থেমে থাকেনি। ‘বন্দী ফাল্গুন’ উপন্যাস এবং ‘কারাগার’ কাব্যগ্রন্থ রচনা হলো - এক হৃদয় নিংড়ানো বেদনার কথা কাহিনি।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি পেলেন শিক্ষাজগৎ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ভুবন মোহিনী দাসী’ স্বর্ণপদক প্রদান করে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট দিয়ে সম্মানিত করে। এক মুহূর্ত অবসর নেই।
গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সংগঠনের প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছিলেন।
নারীকে সাহিত্যচর্চা, কাব্যচর্চা, সংস্কৃতি চর্চা না করালে নারীসমাজ অজ্ঞতা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে না, আবার নারী আন্দোলন পঙ্গু হয়ে থাকবে। তার জন্য তৈরি করলেন ‘শিক্ষা সিরিজ’-এর ছোটো ছোটো পুস্তিকা। সংক্ষেপে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন সংগ্রাম সম্বন্ধে জ্ঞান পাবে। এও খুব পরিশ্রমের কাজ ছিল। ‘নারী আন্দোলন ও আমরা’ একটি দীর্ঘ ইতিহাস নারী মুক্তি আন্দোলনের। অগস্ট বেবেলের রচনার অনুবাদ, লেনিনের সঙ্গে ক্লারা জেটকিনের আলপচারিতার অনুবাদ সাহিত্যিক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।
কিন্তু এহো বাহ্য। একজন নারীর জীবনজয়ের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বিবৃত হলো।
কত পাশ করেছেন, কত ডিগ্রি অর্জন করেছেন - সেটা তাঁর জীবনের আসল কাহিনি নয়। নারীমুক্তির লক্ষ্য অর্জনে কতটা অগ্রসর হচ্ছেন, মেয়েরা স্কুল ডিঙোবেন, কলেজের ডিগ্রি আয়ত্ত করবেন - এইটাই ছিল লক্ষ্য। ঘোমটা পরা হেঁশেল থেকে মুক্তির প্রয়োজন; সন্তানকে দেশ, সমাজ, জীবনকে চেনাবে, তবে দেশ তৈরি হবে। মায়ের কাজতো সেখানেই। তাই নিজেকে সেভাবে মুখপাত্র করে তুলবেন। উপরে উল্লিখিত ‘শিক্ষা সিরিজ’, ‘নারী আন্দোলন ও আমরা’র মতো রাজনৈতিক জীবনের দিক্নির্দেশক বই লিখেছেন। ৬০ বছরের নারী মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ছোটোদের জন্য ছড়া কবিতা মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ৪০-এ বেশি। ঊনবিংশ শতকের নারী জাগরণের পথ প্রশস্ত হয়েছিল বিদ্যাসাগরের, রামমোহনের হাত ধরে। এখনকার শতকে কনকদি সহ নারী জাগরণের হোতারা তেমনিই আন্দোলনের পথ কেটে কেটে এগিয়েছেন।
তৈরি করলেন পত্রিকা প্রকাশের লড়াই। এই নারীসংগ্রামী বাহিনী নারীমুক্তি সংগ্রামের কারিগর। পায়ে পায়ে পথ আবিষ্কার করেছেন, পথ চলতে চলতে বহু মানুষের হাত ধরেছেন।
সামন্ততান্ত্রিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ নারীসমাজ বাইরে আকাশের মুক্তির আলোয় এসে নতুন সমাজ তৈরির কারিগর। একক ব্যক্তির বিপ্লব ঘটানোর কাজ নয়, সংগঠিত মহিলা বাহিনী গঠিত হচ্ছে।
যখন বেথুন কলেজে পড়ছেন - তখন ছাত্র আন্দোলন প্রবল। আন্দামানের আজীবন বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন দুর্বার, হাজার ছাত্রের মিছিলে বাংলার ছাত্রসমাজ চঞ্চল, সেই প্রথম মিছিলে হাঁটা, বাংলার ছাত্র ফেডারেশনের হাত ধরলেন, ‘ছাত্র অভিযান’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তাতে কবিতা লেখার হাতেখড়ি। ছাত্র ফেডারেশনেও নেতৃত্বে।
নারীকে রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সাহিত্য কাব্যে পরিচিত করতে হবে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ মহিলা সংগঠনের পত্রিকা হলো ‘ঘরে-বাইরে’। কনকদি সম্পাদিকা। কিন্তু পত্রিকা পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিগত কিছু সমস্যা দেখা দিল। পত্রিকা পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু মতাদর্শগত সঙ্কট দেখা দিল। তখন যাঁরা পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ তৈরি হলো। বামপন্থী শিবিরে একসঙ্গে কাজ চালানোয় অসুবিধে দেখা দিল। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হলো - তৈরি হলো সিপিআই(এম)। তখন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির শিবিরে যোগ দিলেন। যাঁরা তাঁদের পক্ষে, তাঁদের ‘ঘরে-বাইরে’তে কাজ করা সম্ভব হলো না। ১৯৬৮ সালে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের নির্দেশে ‘একসাথে’ পত্রিকা প্রকাশ পেল। কনকদি যথারীতি সম্পাদিকা। পত্রিকা অনেক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেল। বাংলার রাজনীতি তখন খুব ঘোরালো। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চলতে থাকল। ’৬২’র যাঁতাকলে কমরেড জ্যোতি বসু, মুজফ্ফর আহ্মদ এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কমরেডরা কারাগারে। অসম্ভব জটিল পরিস্থিতি - এই প্রতিকূলতার পাহাড় ভেঙে মহিলা সমিতির পত্রিকা জন্ম নিল। ১৯৬৮ সালে। ঠেকিয়ে রাখা যায়নি আজ তার বয়স পঞ্চাশোতীর্ণ। আজও সে সম্মুখপানে আগুয়ান।
সারা জীবনের এত ধকল। এত কঠিন কাজ সামলে তাঁর চোখ আর আলো দিতে ব্যর্থ হলো। কনকদি প্রায় অন্ধত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। তাই নিয়েই বছরের পর প্রকাশ পেতে থাকল ‘একসাথে’।
তাঁর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একজন কমিউনিস্টের যা থাকবে - সে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন সংগ্রাম করতে করতে। এক নম্বর - তাঁর শৃঙ্খলাপরায়ণতা, তাঁর সময়ানুবর্তিতা, মানুষকে আপন করে নেবার এবং দেখবার চেতনা - তাই একজনকে কমিউনিস্ট গড়ে দেয়। তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই গুণগুলো দেখেছি। এই গুণের অধিকারী না হলে সৎ কমিউনিস্ট হওয়া যায় না।
চোখ যখন বন্ধ - সারা জীবনের কথা লিখলেন ‘মনে মনে’। নিজে লিখতে পারেন না - কমরেড বিভা ঘোষ গোস্বামী - বিভাদির লেখা, কনকদির বলা। শৈশবের সেই ‘পায়ে মল, নাকে নোলক’ ছোট্ট পুঁটুর, কনক মুখার্জি হয়ে ওঠার ইতিবৃত্তান্ত লেখা হলো। রাজনীতির ওঠাপড়ার সঙ্গে কনক মুখার্জির জীবনের ওঠাপড়ার সমস্ত বৃত্তান্ত ধরা রইল। নারীমুক্তি আন্দোলনের, তখনকার ‘বেন্দা’ গ্রামের গল্প, সেখান থেকে সংসদে পা রাখা, সেখানে সাংসদ জীবনের লড়াই, দেশের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হওয়া, বিশেষ করে দুর্বল নারীসমাজের জন্য সোচ্চার হওয়া, এই পথে চলতে গিয়ে নির্যাতিতা নারীসমাজ, দরিদ্র শোষিত মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে গেছেন, সংসারকে কখনও অবহেলা করেননি, স্নেহপ্রীতির জোরে দূরের মানুষকে কাছে টেনেছেন। এই আত্মকথার যে বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সেগুলির মধ্যে আছে সামন্ততান্ত্রিকতার বেড়াজাল ভেঙে একটি মাতৃহারা শিশুর আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বেড়ে ওঠার কাহিনি; দ্বিতীয়ত, অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন প্রসারিত করার সংগ্রামী ইতিবৃত্ত আর দিয়েছেন কেমন করে ‘ভালো’ কমিউনিস্ট হওয়া যায় তার শিক্ষা, নির্লোভ, মুক্তমনা মানবদরদী, শ্রেণিকে চেনানো ইত্যাদি। মানুষের কর্মে আস্থা বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, মানুষের কাছে অপরিহার্য হতে হবে। প্রয়োজনে গরিব ঘরে খেতে হবে, শুতে হবে।
আর শৃঙ্খলাপরায়ণ না হলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। পত্রিকা মাসের প্রথম দিনেই প্রকাশ হবে - তার জন্য নিয়মমতো কাজ করতে হবে, প্রুফ দেখতে হবে। লেখা সুবিন্যস্তভাবে নিয়ে প্রেসে যেতেন। আমাদের নিয়ে যেতেন - বলতেন - শিখে নাও, শিখে নাও। চোখ দিয়ে অবিরত জল ঝরছে, ভীষণ যন্ত্রণা, তবু নিপুণভাবে পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি উৎকর্ষ নিয়ত চিন্তা। আর কনকদির কমিউনিস্টসুলভ ব্যক্তিত্ব সবার কাছে অনুকরণীয় - এমন না হলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না।
অতএব আজকের কমিউনিস্ট হতে চাওয়া মানুষের কাছে আবেদন -
কনকদির মতো ব্যক্তিদের অনুসরণ, অণুকরণ করো। কমিউনিস্ট নিধনের আদর্শ নিয়ে আজ যারা রাষ্ট্র, রাজ্য চালাচ্ছেন - তাদের প্রতিহত করার শিক্ষা নিয়ে চলার শপথ নিতে হবে।
এই মানবশিক্ষককে অভিবাদন জানাই তাঁর শতবর্ষে।