E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭

শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ঐতিহ্য ‍‌কলুষিত করা হচ্ছে

গৌতম রায়


বামফ্রন্ট সরকার কলকাতার পার্কে ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবী হো চি মিনের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছিল। এখনও তা স্বমহিমায় বিদ্যমান। কিন্তু মূর্তি স্থাপনের সেই সময়ে কমিউনিস্ট বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সেই পার্কে হো চি মিনের মূর্তি সরিয়ে সেই জায়গায় স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি স্থাপনের হুজুগ তুলে স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছিলেন। বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তিও তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু অন্নদাশংকর সেই দাবিপত্রে স্বাক্ষর করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছিলেন। স্বাক্ষর সংগ্রহ উদ্যোগীদের তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে ছিলেন, কলকাতা শহরে অনেক পার্ক আছে। সেখানে বিবেকানন্দর মূর্তি স্থাপন করা যায়। একজনের মূর্তি উপড়িয়ে অপরজনের মূর্তি স্থাপনকে আমি কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারব না।

আজ রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে সেখানকার প্রবহমান সংস্কৃতির বিপরীত স্রোতে হেঁটে, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ স্বামী বিবেকানন্দের নামে যে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির নামকরণ করলেন, তাতে অন্নদাশঙ্করের সেদিনের সেই দৃঢ়চেতা মানসিকতার কথাই প্রথমে মনে এলো। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেখানকার ভাবধারার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তি বা পরিসর অনুযায়ী বিভিন্ন পল্লির নামকরণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই ধারাবাহিকতাই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পালন করে গিয়েছেন। যে অংশগুলি প্রয়োজনের নিরিখে পরবর্তীতে সংযোজিত হয়েছে, সেই অংশগুলির নামকরণও শান্তিনিকেতনের সার্বিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই রাখা হয়েছে।

শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে ফরটিফাইভ কোয়াটার্স নামে বিশ্বভারতীর পঁয়তাল্লিশটি কোয়াটার্স আছে। লোকমুখে সেই জায়গাটি ফরটিফাইভ বলে প্রচলিত হলেও রামকিঙ্কর থেকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত ওই পল্লিটির পোশাকি নাম ‘অ্যানড্রুজ পল্লি’। তেমনিই আছে পিয়ার্সন পল্লি, সেবা পল্লি, গুরু পল্লি। রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর পরবর্তীতে যাঁরা আশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে থেকেছেন, তাঁরা কেউ কখনো মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধীর মতো দেশবরেণ্য কোনো ব্যক্তিত্বের নামে শান্তিনিকেতনের কোনো রাস্তা বা পল্লির নামকরণ করেননি।

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন, এমন কারও নামে সেখানকার কোনো পল্লি বা রাস্তার নামকরণের কোনো প্রথা আজ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় নি। বিবেকানন্দ অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতা শহরে প্লেগের সেবাকার্যে বিবেকানন্দের ক্ষীণ সংযোগ হয়েছিল। যদিও সেটি প্রত্যক্ষ সংযোগ বলা চলে না। বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথ প্লেগের সেবাকার্যে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটি রবীন্দ্রজীবনের প্রেক্ষিতে খুব একটা আলোচিত হয় না।

শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য ভেঙে বিবেকানন্দের নামে সেখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণের ভিতর দিয়ে বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্তৃপক্ষ যে সর্বনাশা রাজনীতি সেখানে চাপিয়ে দিতে চাইছে, তা কেবল বিশ্বভারতীর পক্ষেই ক্ষতিকর হবে না, গোটা বাংলায় বিভাজনের রাজনীতিকে আরও তীব্র করে তুলবে। যে বিবেকানন্দকে আজ আরএসএস, বিজেপি তুলে ধরতে চায়, সে বিবেকানন্দকে তারা নাগপুরের রেশমবাগের ‘কেশব ভবনে’র সৃষ্ট বিবেকানন্দ হিসেবেই তুলে ধরতে চায়। বিবেকানন্দের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতপাতের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার মানসিকতাকে একটিবারের জন্যেও হিন্দুত্ববাদীরা তুলে ধরে না। ধর্মান্ধতা, যেটির বিরুদ্ধতা বিবেকানন্দ তাঁর গোটাজীবন ধরে করেছিলেন, সেই ধর্মান্ধতার সঙ্গে মিশেল করেই আরএসএস, বিজেপি আজ বিবেকানন্দকে তুলে ধরে। আর সেই উদ্দেশেই মহামানবের মিলনতীর্থ হিসেবে যে শান্তিনিকেতনকে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে বিকৃতভাবে রাজনৈতিক হিন্দু সন্ন্যাসী হিসেবে বিবেকানন্দকে তুলে ধরে আরএসএস’র রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কেই প্রচার, প্রসার আর প্রয়োগের স্বার্থে আরএসএস ঘনিষ্ঠ উপাচার্য বিবেকানন্দের নামে রাস্তার নামকরণ করেছেন।

বিকৃতভাবে, খণ্ড-ক্ষুদ্র করে বিবেকানন্দকে উপস্থিত করে, তাঁকে আরএসএস’র আত্মঘাতী দর্শনের অন্যতম চিন্তক হিসেবে তুলে ধরা হলো হিন্দুত্ববাদীদের উদ্দেশ্য। যে বিকৃত চেতনাকে ভারতীয় চেতনা হিসেবে তুলে ধরে হিন্দুত্ববাদীরা, সেই চেতনার উদগাতা হিসেবে দেখাতে বিকৃতভাবে বিবেকানন্দকে উপস্থাপনার সামাজিক প্রযুক্তি আরএসএস বহুদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বিবেকানন্দের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা তারা একবারও বলে না। বিবেকানন্দের জাতপাতের উপর কষাঘাত হানার মানসিকতার কথাও তারা একটিবারের জন্যেও উচ্চারণ করে না।

বিবেকানন্দের বাণীকে নিজেদের ইচ্ছেমতো খামচাকরে তুলে ধরে তারা দেখাতে চায় বিবেকানন্দও রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কথাই বলেছেন। আর সেখান থেকেই বিকৃত উপস্থাপনার বিবেকানন্দকে তারা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে, ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’র ধারণা দেওয়া বিবেকানন্দের কথা কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুরা বলে না।

এই অবস্থায় বিশ্বভারতীতে বিবেকানন্দের নামে রাস্তার নামকরণ করে একদিকে রবীন্দ্রনাথের ভাবধারাকে খণ্ড বিখণ্ড করে দিতে চাইছে আরএসএস ঘনিষ্ঠ বর্তমান কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে ধর্মপ্রাণ অথচ ধর্মনিরপেক্ষ যে সব মানুষ কেবল শান্তিনিকেতনেই নন, গোটা বাংলা তথা দেশে আছেন, তাঁদের ভিতরেও একটা বিভ্রান্তির পরিবেশ তৈরি করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চায় রাজনৈতিক হিন্দুরা। যেসব ধর্মনিরপেক্ষ অথচ ধর্মপ্রাণ মানুষ শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে ওয়াকিবহাল নন, তাঁদের কাছে বিবেকানন্দের নামে শান্তিনিকেতনে একটি রাস্তার নামকরণ ঘিরে বিরোধিতা নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হবে। আর সেই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়েই ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক নন, অথচ আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী, এইসব মানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা হলো বিবেকানন্দের বিরোধিতা - এভাবেই উপস্থাপিত করবে আরএসএস-বিজেপি। আর সেভাবেই তারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একটা বড়ো অংশ, যাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তাঁদেরও সাম্প্রদায়িক করে তুলবার চেষ্টা করবে।

ইতিমধ্যেই আরএসএস তার সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে শান্তিনিকেতনে নীরব প্রচার চালাচ্ছে যে, পিয়ার্সন, অ্যানড্রুজ - এঁরা সকলে জন্মসূত্রে খ্রিস্টান ছিলেন। খ্রিস্টধর্মই তাঁরা আজীবন পালন করে গিয়েছেন। তাঁদের নামে পল্লি ঘিরে তো কোথাও কোনো আপত্তি ওঠেনি। তাহলে কেন বিবেকানন্দের নামে রাস্তার নামকরণ ঘিরে এতো বাদানুবাদ? এতো আপত্তি?

বস্তুত নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই যে কায়দায় আরএসএস গোটা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে কবজা করে চলেছে, শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীতেও সেই একই কায়দা চলেছে। সরাসরি ধর্মান্ধতার রাজনীতি সেখানে কায়েম না করে, একটু ঘুরপথে সাম্প্রদায়িক চেতনা বিশ্বভারতীর পঠনপাঠন থেকে শুরু করে সার্বিক আদবকায়দাতে অত্যন্ত ধীর অথচ ক্ষিপ্রতায় প্রয়োগ করে চলেছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। সেই লক্ষ্যে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য তাঁর কার্যকালের প্রথমদিন থেকে কাজ করে চলেছেন। যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভ্রাতৃত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থী একটি কালাকানুন, সেই আইনের উপযোগিতা বোঝাতে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য, শান্তিনিকেতনের ভিতরে বিজেপি’র রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন।

বৈচিত্র্যের ভিতর ঐক্যের সাধনা ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবেদ। এই লক্ষ্যেই বহুধাকে কখনো খণ্ড ক্ষুদ্র করে দেখার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। যে রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ ‘‘আমাকে একেবারে চাপা দিলে বা বেঁধে ফেললে আমার জীবন ব্যর্থ হতে থাকে’’ (ভানুসিংহের পত্রাবলী, পত্র সংখ্যা-১৩, পৃষ্ঠা-৩২), সেই রবীন্দ্র চেতনার হত্যাকারী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনকে ব্যবহার করেছেন বর্তমান উপাচার্য। এখানেই থেমে থাকেননি বর্তমান উপাচার্য। বিজেপি সাংসদের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্রদের উপর নানাধরনের পুলিশি অনাচার সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন উপাচার্য।

পুলিশ পরিচালিত হয় রাজ্য সরকারের দ্বারা। বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিজেপি’র সাংসদকে দিয়ে শান্তিনিকেতনের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছেন, আর তার বিরুদ্ধে যাতে কোনো গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত না হয়, সেই জন্যে উপাচার্যের নির্দেশে শান্তিনিকেতনে অঘোষিত জরুরি অবস্থার পরিবেশ কায়েম করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রনাধীন পুলিশ।

শারদ উৎসবের আগে (২০১৯) রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশ শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের উপর যে ধরনের গণতন্ত্রহত্যাকারীর ভূমিকা পালন করেছে, তার সাম্প্রতিক নজির আমরা সহজেই পাই উত্তরপ্রদেশে অজয় সিং বিশোওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের পুলিশের আচরণের ভিতর দিয়ে। সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি মমতার পুলিশ করেছে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের শান্তিনিকেতন সফরের সময়কালে। মমতার পুলিশ যে যে ছাত্রনেতারা অমিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে পারেন বলে অনুমান করেছে, সেইসব ছাত্রকে শাহের সফরকালে গৃহবন্দী করে রেখে প্রমাণ করেছে, অঘোষিত জরুরি অবস্থা কায়েমের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ভিতরে এতোটুকু ফারাক নেই।

সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকাকে জীবনের ধর্ম বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। এই পর্যায়ে নিজের মতের বাইরে রাজনৈতিক অভিমতকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা কবি নিজের জীবনে একটিবারের জন্যেও করেননি। সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারার প্রতি আস্থা তাঁর ছিল না। তা সত্ত্বেও সেই ভাবনার মানুষদের তিনি কি স্নেহচ্ছায়ায় নিজের পরিসরে রাখতেন তা বোঝার জন্যে কবির ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’ই যথেষ্ট। কেবল সাহিত্যসৃষ্টির ভিতর দিয়েই ভিন্নরুচির অধিকারকে, বহুত্ববাদী চেতনাকে তিনি স্বীকৃতি দেননি; বাস্তব জীবনে যেন মাতৃস্নেহে তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের ঢেকে রাখতেন। তাই ছোটোলাট অ্যান্ডারসনের যখন তিনের দশকে শান্তিনিকেতন সফর ঘিরে স্বদেশি আন্দোলনের সাথে যুক্ত সন্দেহে পুলিশ কয়েকটি ছাত্রকে আটকের ষড়যন্ত্র করেছিল, কবি এতোটাই ক্রুব্ধ হয়েছিলেন যে, ছোটোলাটকে আসতে নিষেধ করার সংকল্প করেছিলেন।

চিন্মোহন সেহানবীশের ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজে’র ভিতর দিয়ে কয়েকটি নিখিলেশকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। ইসলাম দর্শন ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে দুইয়ের দশকের শেষ থেকে তিনের দশকের শুরুর অনেকটা শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক কাটিয়েছিলেন হাঙ্গেরীয় অধ্যাপক জ্যুলা গারমাধনুশ। তাঁদের স্মৃতিলিপিতে আমরা দেখতে পাই, সশস্ত্র বিপ্লবী ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত ছাত্রছাত্রীদের কিভাবে পুলিশের হাত থেকে আগলে রাখছেন রবীন্দ্রনাথ। বিপ্লববাদী ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জ্যোতি বসু’র সম্পর্কিত পিসিমা ইন্দুসুধা ঘোষ। পুলিশের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করতে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে তিনি ভরতি হয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে।

বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকালে তাঁদের নেতৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাসের ভিতর সরকারি বা দলীয় স্তরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার পরিপন্থী কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। এই সুযোগটিকে অবশ্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকেরা খুব সফলভাবেই ব্যবহার করেছিল। ফলে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি সেখানে ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনে, কবি যখন শারীরিকভাবে বেশ কমজোরি, শান্তিনিকেতনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে বিশেষ নজর দিতে পারছেন না, সেই সুযোগ একাংশের মানুষ কাজে লাগিয়েছিল। এই ধারা কবির মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও বেশ জোরদার ছিল। কেবল কমিউনিস্ট হওয়ার ‘অপরাধে’ই বীরভূমের ভূমিপুত্র হয়েও শান্তিনিকেতনে ভরতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন কলিম শরাফি।

আজ মনীষীদের নিজেদের দলীয় সভ্য হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা একাধারে বিজেপি আর তৃণমূল করে চলেছে, তার এক একটি উপকরণ হিসেবেই উঠে আসছে এই প্রতিক্রিয়াশীলতার গবেষণাগার হিসেবে শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীকে উপস্থাপিত করবার প্রচেষ্টা। বাংলা তথা বাঙালির বুদ্ধিদীপ্ত বিভাসাকে আচ্ছন্ন করাই এখন নিজের নিজের মতো করে আরএসএস, বিজেপি, তৃণমূলের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই এখন তাদের বোড়ের চাল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিনয়-বাদল-দীনেশরা।