৫৮ বর্ষ ২১শ সংখ্যা / ৮ জানুয়ারি ২০২১ / ২৩ পৌষ ১৪২৭
নিঃস্ব ভারতী?
পল্লব সেনগুপ্ত
যদিও এই অভাজন কলমচি কোনোদিন বিশ্বভারতীর ছাত্র কিংবা অধ্যাপক ছিল না, শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকও সে নয়; তবু বিশ্বভারতী তার সঙ্গে কোন্ এক অলক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, তাই তার হানি এবং গ্লানিতে সে পীড়িত হয়। একটু নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলছি - মার্জনা করবেন বন্ধুরা! সেই কোন্ ৮৪ বছর আগে এই দুর্মুখ বৃদ্ধ-কলমবাজের বাবাকে - তখন তিনি তরুণ প্রজন্মের একজন লেখক - স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে কাছে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যসচিবের পদে, আর সেই থেকেই পারিবারিক এক অনুভবের বাঁধনে মানসিকভাবে বিশ্বভারতীর সঙ্গে জড়িয়ে আছি যেন। পরিণত বয়সে, ওখানকার অধ্যাপনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না হয়েও, বিদ্যায়তনিক উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন হয়ে থাকার সুযোগ হয়েছিল বেশ অনেকগুলো বছর। এখনও অনেক বছর ধরেই প্রতি বছরে ৩/৪ বার তো ওখানে যাই, প্রাণের টানেই বলুন আর যা-ই বলুন না কেন - তার সুবাদে! তাই বিশ্বভারতীর ‘সাড়ে-সর্বনাশের’র জন্যে যখন পদ্মবনের মত্ত মাতঙ্গরা উঠে-পড়ে লেগেছে এখন, অন্য সমস্ত শুভবুদ্ধি-মানুষের মতো এই কলমচিকেও তাদের অপহ্নবী প্রয়াসের নিন্দাবাচনে বাধ্য হতে হলো। এবং এই সমস্ত কিছু অন্যায়, অবিমৃশ্যকারিতা ও রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধির সিদ্ধির জন্য ভীমদর্পে গদা ঘোরাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি-তথা-সঙ্ঘ পরিবারের হুকুমবর্দার-স্বরূপ স্বয়ং ওখানকার প্রধান ব্যক্তিই। প্রতিবাদ তো করতেই হবে ভাই।
আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অনেকবারই অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানান হাস্যকর এবং ভ্রান্ত তথ্যই বক্তৃতায় বা আলাপচারিতায় প্রতিবেদিত করেছেনঃ যথা, ১৯৪৬-এর দাঙ্গার পর যখন গান্ধিজি অনশন করেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই অনশন ভাঙিয়েছিলেন ফলের রস খাইয়ে এবং সেই সময়েই ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’ এই গানটি তৎক্ষণাৎ রচনা করে এবং সুর দিয়ে নিজেই গেয়েছিলেন! কিংবা, তাঁর আরেকটি সুভাষিতঃ শেক্সপিয়র, কিটস এবং রবীন্দ্রনাথ পরস্পরের সমসাময়িক কবি! ...তা এসব শুনে অনাবিলভাবে হাসা যায়, কিন্তু ওই সব ধরনের কথায় হাসার ‘অনুপ্রেরণা’ পাওয়া ছাড়া আর কিছু ঘটেনা!
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে (এবং শান্তিনিকেতন ও শান্তিনিকেতনীদেরকে) নিয়ে বিজেপি’র ম্যামথ থেকে মথ - সর্বপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাই যেটা শুরু করেছেন তাঁদের অনুগামী প্রচ্ছন্ন কিছু লোকজনসহ - সেটা আর ঠাট্টা-রসিকতার স্তরে থাকছে না। এবারে বিজেপি প্রায় বর্গী-হানা দিয়ে যেভাবে বঙ্গবিজয়ের উন্মত্ত প্রত্যাশায় মেতেছে, তাতে ওরা রবি ঠাকুরকেও ওদের গ্র্যান্ড ডিজাইনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে - স্রেফ বঙ্গবাসীকে ধোঁকা দিয়ে মন জোগানোর অভিলাষেই। কিন্তু ওরা চুড়ো-থেকে-গুঁড়ো সবাই ওদের অপরিমেয় ‘আধা-সেঁকা’ রবীন্দ্র-ভক্তির আতিশয্যে যা’করছে, তাতে প্রায় সময়েই সেটা বিপরীত ফল দিচ্ছে। এবং ওরা বেহায়া-বেড়ালের মতো জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে ফের পরবর্তী মূঢ়তার প্রকাশ ঘটানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে নিয়মিতভাবেই এবং তার পরিণামে গড়পড়তা বঙ্গভাষী মানুষ বিরক্তই হচ্ছেন উত্তরোত্তর।
।। দুই ।।
বঙ্গালকে মহৎতিয়পূর্ণ ঐতিহিয় ঔর পরম্পরাকে লিয়ে বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের এতই উন্মাদনা যে, খোদ মোদী এবং শাহ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতন সম্পর্কে যা-যা করতে শুরু করেছেন, তাকে পাগলামি বলব না নষ্টামি বলব - সেটাই বুঝতে পারছি নে! পাগলামি-তথা-ম্যাডনেসও যদি হয় (দুঃখিত, জানি শব্দটা অপরিষদীয়/আনপার্লিয়ামেন্টারি যে, তা জানি, কিন্তু এখানে ওটা ব্যবহার না করেও উপায় নেই!) তাহলে সেটা সম্পর্কে বলব - ওখানে ‘মেথড ইন ম্যাডনেস’ বলে ইংরেজি প্রবাদটির ছায়াপাত ঘটেছে!
কেন? বলছি। রবীন্দ্রভক্তির মুখোশ পরে ওরা বস্তুতপক্ষে তাঁর ভাবধারার অপহ্নব তো ঘটাচ্ছেই। রবীন্দ্রনাথের বলা সেই ‘মহামানবের সাগরতীরে... একদেহে হল লীন’’ ভারতীয়ত্বের চেতনাটাকেই তো ওরা মানে না - যদিও সেটাই ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক - জাতিতাত্ত্বিক দিক থেকেই চূড়ান্ত সত্য।
ধর্মসমন্বয়, ধর্মীয় সহাবস্থান, মানবিকতার মূল্য প্রদান - রবীন্দ্র দর্শনের, রবীন্দ্রচিন্তার যা-যা প্রধান প্রধান কিছু দিক - বিজেপি-তথা-সঙ্ঘীদের সঙ্গে তার কোনোটাই মেলেনা। শুধুমাত্র বাঙালির রবীন্দ্র আবেগকে তুরুপের তাস করে ওরা নির্বোধ (অথচ, শয়তানিভরা) কাজকর্ম, কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন, ওদের এক স্ব-নন্দিত তাত্ত্বিক নেতা রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং সুরারোপিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের ওপর কাঁচি চালানোর ফতোয়া দিয়েছিলেন। তাঁর নাম সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামী। তারপর মহাশক্তিমান শ্রীল শ্রীশ্রী অমিত শাহ বাংলায় এসে ‘‘গুরুবর টেগোর’’-জিকে ‘‘পরনাম’’ জানালেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী-প্রবর ‘শান্তিনিকেতন হলো রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান’ এমন এক নিদান হেঁকে লোক হাসালেন। চূড়ান্ত কেলেঙ্কারি করলেন ওদের জনৈক ‘মিনি’ মুখিয়া - গৌরব ভাটিয়া - তিনি একটি টিভি চ্যানেলে শান্তিনিকেতনে ‘‘কুলপতিজি’’ ওরফে ভাইস-চ্যান্সেলর বিদ্যুৎ চক্রবর্তীবাবুর তুঘলকি কাজকর্মের সমর্থন করছিলেন। তখন ওই আলোচনার অন্যতম এক প্যানেলিস্ট - তিনি বঙ্গভাষী - একবার ‘‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’’ বলায়, বিজেপি-র সেই দিগ্গজ মূর্খটি তাঁকে বিদ্রূপ করে বলেন যে, ‘‘বঙ্গালি’’-রা যাঁর ‘‘নামভি ঠিক্সে বোল নহি পায়ে’’ - তারা আবার তাঁকে নিয়ে বড়াই করে কোন্ সাহসে! বুঝুন! অজপণ্ডিত শেষতক লড়ে গেলেন - কবির পদবি ছিল ‘‘টেগোর’’ - ‘‘ঠাকুর’’ নয়! ‘ঠাকুর’ কীভাবে সাহেবদের মুখে মুখে ‘‘টেগোর’’ হয়েছিল - সেটুকুও তাঁর জানা নেই! অথচ, এরাই এখন রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতনের তাবৎ অছিদারি নিতে চাইছে। এনসিআরটি-র পাঠ্যপুস্তক থেকে তো রবীন্দ্রনাথকে ব্রাত্যই করে দিয়েছে ওরা অনেকদিন হলো। এখন শান্তিনিকেতনের সমস্ত চিরাচরিত রীতি ভেঙে, আইনের পরোয়া না করে নিজেদের চৌকিদারটিকে দিয়ে ফরমান জারি করিয়ে, বিশ্বভারতী এবং শান্তিনিকেতন এবং শান্তিনিকেতনের অধিবাসীদের উচাটন শুরু করেছে।
পৌষমেলা, বসন্তোৎসব, নন্দোৎসব, বর্ষামঙ্গল প্রভৃতি ওখানকার নিজস্ব যে-সব ছোটোবড়ো উৎসব বিখ্যাত, সেগুলো ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করেছেন এই চৌকিদারটি। যততত্র পাঁচিল তুলে - বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণকে প্রায় অস্কার ওয়াইল্ডের গল্প ‘স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে’ পরিণত করছেন তো বটেই; আশ্রমিকদের প্রতিবাদ শুনে, তাঁদেরকে ‘ধান্দাবাজ’, ‘বিশ্বভারতীকে ভাঙিয়ে খাওয়া’ ইত্যাদি ভাষায় অপমান করছেন নিজের বরকন্দাজদের দিয়ে; বিশ্ববরেণ্য নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনকে ‘জমি-অপহারক’ আখ্যা দিচ্ছেন মিথ্যে এক টেলিফোনের গপ্পো ফেঁদে - যদিও অধ্যাপক সেনের আইনি চিঠি পেয়ে, নিজের ওই অপভাষণ গিলেও ফেলছেন ‘দ্য গ্রেট ভিসিয়াস’! তাঁর লোকাল গার্জেন দি ঘো বাবুর মদত বিশেষ কাজে লাগছে না! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অনুমোদনে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষ পেরোনো শান্তিনিকেতনের বসবাসকারিণী মহিলাদের প্রায় ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে-টলে, তাঁদের শতাব্দীপ্রাচীন কার্যালয় থেকে বিতাড়িত করছেন। সেটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়, বিজেপি’র গর্ভগৃহ যে ‘‘সঙ্ঘ’’ তারা তো মহিলাদের অসম্মান করার ব্যাপারে প্রায় বিশ্বনিন্দিত। তো, তাঁদের হুকুমবর্দার (না-কি, হুঁকোবর্দার?) যে প্রবীণ মহিলাদের অসম্মানে মণ্ডিত করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?
।। তিন ।।
কিন্তু এটা কতদিন চলতে পারে? বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্তৃপক্ষের ওইসব লজ্জাজনক এবং নিন্দাজনক কাজকর্মের বিরুদ্ধে তৃণমূল এবং তার সুপ্রিমো যা বলছেন, সে তো তাঁদের রাজনৈতিক ফয়দার প্রয়োজনে। তাঁর রবীন্দ্রভক্তির ‘পোড়াকাষ্ঠ’ তো আমাদের অচেনা নয়। এখন অমিত শাহর নিচে রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরি করার বিরুদ্ধে তিনুবাবুরা খুব নিন্দেমন্দ করছেন। ঠিক তেমনটা তো তাঁদের ক্ষেত্রেও হয়েছে - উপরে সেই ‘তিনি’, তাঁর নিচে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ। সুতরাং, দলমত-নির্বিশেষে - রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিস্পর্ধী-ফায়দাবাজি দুটোকেই ঠেলে রেখে সকলকে এই অপহ্নবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে তো? তাই না?