৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯
রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যথাযোগ্য মর্যাদায় হুল দিবস উদ্যাপিত
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্রতি বছরের মতো এবছরও ৩০ জুন রাজ্যের বিভিন্নস্থানে হুল দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। দেউচা পাঁচামি সহ রাজ্যের বিভিন্নস্থানে আদিবাসী এবং বিভিন্ন প্রান্তিক জনঅংশের মানুষ নিজেদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি জল, জমি ও জঙ্গলের অধিকার রক্ষার শপথ নিয়েছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ‘হুল’ মানুব মুক্তির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার, জোতদার, মহাজন এবং তাদের দোসর পাইক, বরকন্দাজ, পুলিশ, সর্বোপরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-রাজ শক্তির বিরুদ্ধে এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
সাঁওতালি শব্দ ‘হুল’ শব্দের অর্থ বিদ্রোহ। আর ‘মাহা’ শব্দের অর্থ ‘দিবস’ বা ‘দিন’। ৩০ জুন হলো এই হুল মাহা। ১৮৫৫ সালের এই দিনটিতে দলদলি পাহাড়ের কাছে ভগনা ডিহি গ্রামে সিধু-কানু শালগিরা দিয়ে দামিন-ই-কো অঞ্চলের আদিবাসীদের সভা আহ্বান করেছিলেন। সাঁওতাল ও অন্যান্য জনজাতি-আদিবাসী অংশের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ওই সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা জমিদার, মহাজন, পুলিশ, পাইক, বরকন্দাজ, ঠিকাদার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ক্ষোভে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। জমিদার, মহাজনেরা যেভাবে রাজস্ব আদায়ের নামে তাদের সোনার ফসল কেড়ে নিয়েছে, ঠিকাদারের লোকজন বাড়ির মহিলাদের যেভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালিয়েছে, যেভাবে তাদের অধিকার হরণ করা হয়েছে, সীমাহীন শোষণ-অত্যাচার চলেছে, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, যন্ত্রণা নিয়ে এসেছিলেন সমাবেশে। ওই জমায়েতে ঠিক হয় একদল যাবে সিউড়ি জেলা কালেক্টরের কাছে প্রতিকার চাইতে, তারপর সিউড়ি থেকে পদযাত্রা করে কলকাতায় গিয়ে বড়োলাটের কাছে বিচার চাইবে।
এই উদ্দেশ্য নিয়েই সিউড়ি অভিমুখে সাঁওতাল আদিবাসীদের পদযাত্রা শুরু হয়। এই পদযাত্রার খবর ছড়িয়ে পড়তেই জমিদার, মহাজনেরা দারোগার সাহায্য নেয়। দারোগা তার বাহিনী নিয়ে সিধু-কানুকে গ্রেপ্তার করে। এতেই পদযাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে মহাজন-সিপাহিদের ওপরে। বিদ্রোহী পদযাত্রীদের হাতে অনেক সিপাহি, মহাজনের প্রাণ যায়। এরপর জমিদার, মহাজনেরা ব্রিটিশ কোম্পানি-রাজের শরণাপন্ন হয়। তারপর বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহীদের ঘিরে ফেলে। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনীর সঙ্গে সাবেকি তীর ধনুক, টাঙ্গি, বল্লম, তরবারির সাথে অসম যুদ্ধে সাঁওতাল আদিবাসীরা পরাজিত হন। নেতাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং অনেককে কারাগারে বন্দি করা হয়। বহু সাঁওতাল গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে বৃদ্ধ, নারী, শিশুদের হত্যা করা হয়েছিল। সিধু-কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এই নিদারুণ অত্যাচার সত্ত্বেও বিদ্রোহের আগুন নেভানো যায়নি।
এই বিদ্রোহ সাঁওতাল জনজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এক সুবিশাল গণবিদ্রোহ ও গণসংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। এই বিদ্রোহ শ্রেণি-চরিত্রগতভাবে ছিল কৃষকদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও তাদের অনুগত সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণসংগ্রাম।
১৬৭ বছর আগে সাঁওতাল আদিবাসীরা সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যে ‘হুল’ বা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক সংগ্রাম সংগঠিত করেছিল তা দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
আজ স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরও আদিবাসীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত রয়ে গেছে। তাদের উপর নানাভাবে শোষণ-নির্যাতন নামিয়ে আনা হচ্ছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকারের আমলে আদিবাসীদের ওপর আক্রমণের মাত্রা সীমা ছাড়িয়েছে। আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী নানা সংগঠন সাঁওতাল-আদিবাসীদের অশিক্ষা-দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে নানাভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। আদিবাসী জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে জঙ্গলমহলকে নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের চক্রান্ত করছে।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আদিবাসী প্রান্তিক মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে স্কুল স্থাপন, অলচিকি লিপিতে সাঁওতালি ভাষা পড়ানো, আদিবাসীদের জন্য ছাত্রাবাস ও শিক্ষার সহায়ক পরিবেশ তৈরি, মিড ডে মিলের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা প্রকল্প রূপায়িত হয়েছিল। এছাড়া আদিবাসীদের মধ্যে খাসজমি বণ্টন, বর্গার অধিকার দেওয়া সহ কাজ ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। অর্থাৎ ভূমি সংস্কার কর্মসূচি ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাঁওতাল আদিবাসীসহ সমস্ত অংশের মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি রূপায়িত হয়েছিল। সর্বোপরি আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে তৃণমূলের শাসনে এই সমস্ত কিছুই নস্যাৎ করা হয়েছে। রাজ্যে আদিবাসীরা নানাভাবে বঞ্চিত ও অত্যাচারিত হচ্ছেন। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং সরকারি অর্থে জঙ্গলমহলে সরকারি সভা, মেলা, খেলা, উৎসব ইত্যাদি হলেও আদিবাসীরা দিনে দিনে নিদারুণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তাঁরা অধিকার হারিয়ে অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। এবারের হুল দিবসে অতীতের ঐতিহাসিক সংগ্রামের কথা স্মরণ করার পাশাপাশি আদিবাসীসহ পিছিয়েপড়া মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দাবিদাওয়া আদায়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নেওয়া হয়েছে।
৩০ জুন এই ‘হুল’ দিবসকে কেন্দ্র করে পদযাত্রা, শহিদবেদি ও প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, আলোচনাসভা, আদিবাসীদের চিরাচরিত সাজে নৃত্য, খেলাধূলা ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে। আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, সামাজিক ন্যায় মঞ্চ, সারা ভারত কৃষক সভা ও সারা ভারত খেতমজুর সংগঠনের উদ্যোগে জেলায় জেলায় এই দিনটি উদ্যাপিত হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রায় তিন শতাধিক স্থানে এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় শতাধিক স্থানে ঐতিহাসিক হুল দিবস শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়েছে। এই সংগঠনগুলির যৌথ উদ্যোগে এই দুই জেলার বিভিন্নস্থানে ভূমিজ, কুড়মি, কড়া, মুন্ডা, মাহালি, খেড়িয়া, কামার, কুমোর, তাঁতি প্রভৃতি বিভিন্ন অংশের মানুষ নানা কর্মসূচিতে অংশ নেন।
হুগলি জেলার বিভিন্নস্থানেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়েছে। হরিপাল হড়া ফুটবল মাঠে কৃষক সভার আয়োজনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারকেশ্বরে মোহনবাটি মুক্ত মঞ্চে হুল দিবস পালিত হয়েছে। এখানে পতাকা উত্তোলন, নৃত্য, ভাদু-টুসু গান, আবৃত্তি, একাঙ্ক নাটক ইত্যাদি পরিবেশিত হয়েছে। জাঙ্গিপাড়ায় কৃষকসভা ও খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। এছাড়া কামারপুকুর, চণ্ডীতলা, পাণ্ডুয়ার বিভিন্নস্থানে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালি ১ ও ২নং ব্লকের বিভিন্ন স্থানেও আলোচনা সভা সহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
কৃষ্ণনগর চাঁদড়া আদিবাসীপাড়ায় আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিন ‘পাহাড় বাঁচাও, প্রকৃতি বাঁচাও’ এই শপথ নিয়ে পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার তিলাবনি পাহাড়ের নিচে হুল দিবস পালিত হয়েছে। এই কর্মসূচিতে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম থেকে মানুষেরা এসে যোগ দেন। এখানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। এছাড়া আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের উদ্যোগে বান্দোয়ানের নেকড়া, আরশার সিধু কানু মিশনে, হুড়ার হিড়বাংডি ও বলরামপুরে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাঁকুড়া ১নং ব্লকের কালাপাহার অঞ্চলে, ঝিলিমিলিতে আদিবাসী অধিকার মঞ্চের ডাকে হুল দিবস পালিত হয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও দিনটি নানা পালিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের ডাকে আলিপুরদুয়ারে হুল দিবস উপলক্ষে রক্তদান শিবির হয়। নাগরাকাটায় আলোচনা সভা হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরে তপন, কুমারগঞ্জ ছাড়াও বালুরঘাট ব্লকের বিভিন্ন স্থানে হুল দিবস পালিত হয়েছে।
দেউচা পাচামিতে আদিবাসী মানুষদের হুল দিবস উদ্যাপন।
দেউচা পাঁচামিতে জল, জমি রক্ষার শপথ
এদিন ঐতিহাসিক হুল দিবস উপলক্ষে পাঁচামির হরিণশিঙা ময়দানে হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ সমবেত হয়ে হুল বিদ্রোহের শহিদদের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে তাঁদের প্রদর্শিত সংগ্রামের পথেই জল, জমি ও জঙ্গলের অধিকার রক্ষার জন্য আপসহীন সংগ্রামের শপথ নেন।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আদিবাসী মানুষের জল, জমি, জঙ্গলের অধিকার যখন কেড়ে নিতে চাইছে, তখন রাজ্য সরকার আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার বদলে কয়লা খননের নামে পাঁচামিতে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করতে চাইছে। রাজ্য সরকারের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলনের শপথ নিতে ঐতিহাসিক হুল দিবস পালন করেন আদিবাসীরা। এদিনের এই কর্মসূচি থেকে আওয়াজ ওঠে ‘কয়লা খনি দূর হটো’।
প্রস্তাবিত কয়লাখনি এলাকার আদিবাসী জনগণের প্রত্যেক বাসিন্দাই এদিন উপস্থিত ছিলেন হরিণশিঙা মাঠের সমাবেশে। বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন ও গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি বীর যোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত বর্ণনা সহ আদিবাসীদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিদর্শন তুলে ধরা হয়। সমাবেশ থেকে আওয়াজ ওঠে মুখ্যমন্ত্রী ‘মানুষ না চাইলে খনি হবে না’ - এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, জমি রক্ষার আন্দোলনে জড়িতদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার হয়নি। তাই সমাবেশ থেকে শপথ নেওয়া হয়েছে - আন্দোলনই একমাত্র পথ। আদিবাসীদের কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন ফিকে হয়ে গেছে - এই জাতীয় মিথ্যা প্রচারকে নস্যাৎ করে এদিন হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ শপথ নিয়েছেন - কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন আরও দুর্বার হবে।