E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯

চিরবিদায় তরুণ মজুমদার


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সৃষ্টি ও সংগ্রামের দৃপ্ত অভিযাত্রী, ছায়াছবির ভুবনের অনন্য দিশারি তরুণ মজুমদারের জীবনাবসান হয়েছে। ৪ জুলাই সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে এই বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। 'পদ্মশ্রী' সম্মা‍‌নে ভূষিত এই অনন্য স্রষ্টা চির বিদায় নিলেন তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী রক্তপতাকা ও গীতাঞ্জলি বুকে নিয়ে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তরুণ মজুমদারের শেষ ইচ্ছানুসারে এদিনই এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর দেহদান করা হয়েছে।

তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে চলচ্চিত্র জগৎ তো বটেই, সাংস্কৃতিক জগতের বহু বিশিষ্টদের সঙ্গে এদিন বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন। এদিন তাঁর প্রয়াণের পরে হাসপাতালে এবং টালিগঞ্জে এনটি-১ স্টুডিয়োতেও গিয়েছিলেন তাঁরা। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গভীর শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমি শোকাহত, মর্মাহত’। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, ‘সজ্জন মানুষ তরুণ মজুমদার সর্বদা উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতির কথা বলতেন যেখানে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ওঁর চলচ্চিত্রও সেটাই শেখায়। পাঁচের দশকে যাত্রা শুরু করেছিলেন আইপিটিএ’র মধ্য দিয়ে। আইপিটিএ’র দ্বিতীয় প্রজন্মের বিশিষ্ট কর্মী ছিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন, যে কাজ রেখে গিয়েছেন, তা তাঁকে বহুকাল স্মরণীয় করে রাখবে। আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’

সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার প্রয়াত হয়েছেন। গভীর শোকের এই মুহূর্তে শ্রদ্ধা জানাই চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অপরিসীম অবদান ও লড়াকু মানসিকতাকে।’ শোকজ্ঞাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ও। মুখ্যমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেছেন, ‘বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভিন্ন ধারার রুচিসম্মত সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণে তরুণ মজুমদার উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে গেছেন। তাঁর প্রয়াণ চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তরুণ মজুমদারের পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’

ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার শ্রদ্ধা নিবেদন করে একটি বার্তায় বলেছেন, ‘নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে অবিচল ও মূল্যবোধসম্পন্ন অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে পশ্চিমবাংলার শিল্প সংস্কৃতির জগতে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। মননে চিন্তনে ছিলেন জনমুখী। জনচেতনা জাগ্রত করতে তাঁর শিল্প কর্মকে উৎসারিত করেছিলেন। তাঁর স্মৃতি তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই স্মরণীয় ও অম্লান থাকবে।’

তরুণ মজুমদারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের সভাপতি অধ্যাপক পবিত্র সরকার ও সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়। আক্রান্ত আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে আহ্বায়ক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও অরুণাভ গাঙ্গুলি শোকপ্রকাশ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তরুণ মজুমদারের প্রতি। গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী প্রয়াত তরুণ মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বলেছেন, ‘গণশক্তি পত্রিকার দপ্তরে তিনি নিয়মিত আসতেন, লাইব্রেরিতে পড়াশোনাও করতেন। গণশক্তির কর্মীদের প্রতি স্নেহের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে গণশক্তির সমস্ত কর্মীই শোকাহত।’ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকেও তাঁর প্রয়াণে গভীর শোক জানানো হয়েছে।

তাঁর প্রয়াণে গভীর শেষ প্রকাশ করেছেন মাধবী মুখার্জি, সন্ধ্যা রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমি চ্যাটার্জি, দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, মিঠুন চক্রবর্তী, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

জাতীয় স্তরে চারবার সম্মানিত, পদ্মশ্রী সম্মানপ্রাপ্ত তরুণ মজুমদার চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ করেছেন পাঁচের দশকের শেষ প্রান্ত থেকে। বাংলার বুক থেকে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনরা যখন ভারতীয় সিনেমায় নবতরঙ্গ নিয়ে এসেছেন তখনই নিজস্ব শৈলীতে আরেক ধরনের সিনেমা তৈরি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। জীবনের শেষ পর্বে শারীরিক অসুস্থতা, অসামর্থ্য যতই বিঘ্ন ঘটাক, চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন কিছু করে যাওয়ার আগ্রহ ও চেষ্টা তিনি দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। বারে বারে সেই বিঘ্ন কাটিয়ে উঠলেও অসুস্থতাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে কাবু করে ফেললো গত ১৪ জুন। কিডনি ও বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার কারণে তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভরতি করা হয়। হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার নিয়মিত খোঁজ রাখতেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। বিমান বসু, মহম্মদ সেলিমরা হাসপাতালে গিয়েছিলেনও তাঁকে দেখতে। মুখ্যমন্ত্রীও খোঁজ নেন তাঁর স্বাস্থ্যের। চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তাঁকে আইসিইউ থেকে বের করে ওয়ার্ডে রাখাও হয়েছিল। কিন্তু ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৩ জুলাই তাঁকে ভেন্টিলেশন পাঠানো হয়। ৩ জুলাই সকালে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র চলচ্চিত্র জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা এবং সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ হাসপাতালে উপস্থিত হন।

হাসপাতালেই সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব প্রয়াত তরুণ মজুমদারের মরদেহ লাল পতাকায় ঢেকে দেন। বুকের ওপর রাখা হয় গীতাঞ্জলি। প্রয়াত তরুণ মজুমদারের দুই জ্যাঠতুতো বোন সোনালি খাসনবিশ মজুমদার এবং বন্দনা চ্যাটার্জি ও অন্যান্য আত্মীয়রা উপস্থিত ছিলেন।

এদিন দুপুরে এসএসকেএম হাসপাতালে থেকে তরুণ মজুমদারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এনটি ওয়ান স্টুডিয়োতে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ শায়িত রাখা হয় মরদেহ। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পরে ফের এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে এসে তা তুলে দেওয়া হয় হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগের কর্তৃপক্ষের হাতে। বিমান বসু, রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী, কনীনিকা ঘোষ, শতরূপ ঘোষ ও সুদীপ সেনগুপ্ত সহ সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য ইন্দ্রনীল সেন, অরূপ বিশ্বাসও উপস্থিত ছিলেন। এনটি-১ স্টুডিয়োতে এসে তরুণ মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে গিয়েছেন টালিগঞ্জের বহু অভিনেতা অভিনেত্রী, শিল্পী, কলাকুশলী ও কর্মীরা। শ্রদ্ধা জানান শ্রীলা মজুমদার, মানসী সিনহা, হরনাথ চক্রবর্তী, অরিন্দম শীল, কাঞ্চন মল্লিক, সোহিনী সরকার, অভিজিৎ গুহ, সুদেষ্ণা রায়, নেহাল দত্ত, দোলন রায়, জিৎ গাঙ্গুলি, সৃজিত মুখার্জি, দেবদূত ঘোষ, চন্দন সেন, শঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ।

যৌবনে তাঁর চেতনায় রেখাপাত করেছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। সেই তিনিই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বামপন্থী আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা পোষণ করেছেন এবং গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ ও সাম্প্রদায়িকতা-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ জানিয়েছেন, দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। বামপন্থী পরিচয় দিতে তিনি কখনও কুণ্ঠা প্রকাশ করেননি। বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে যখন এই সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চক্রান্ত হয়েছে, কুৎসা প্রচার করা হয়েছে - বামবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের শিবির তৈরি করে অবিরাম বামপন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়েছে, তখনও তরুণ মজুমদার মতাদর্শের অবস্থানে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। বামফ্রন্টের ডাকে ব্রিগেডের সমাবেশে এবং কলকাতার রাজপথে লাল ঝান্ডার মিছিলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই যোগ দিয়েছেন। আবার রাজ্যে তৃণমূলের শাসনে যখন গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে, বামপন্থীদের রক্ত ঝরেছে শাসকদলের দুর্বৃত্তদের তাণ্ডবে, রাজ্যের বুকে অন্ধকার নেমে এসেছে - তখন আঁধার ঘোচাতে রক্তপতাকার মিছিলে তাঁর দৃপ্ত পদক্ষেপ তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করেছে। তিনি প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন জীবনবোধ-সৃষ্টি ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অভিযাত্রী।