৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯
চলে গেলেন চলচ্চিত্র ও চৈতন্যের অভিভাবক
শ্যামল চক্রবর্তী
২ মে, ২০২২। কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহ। শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীরা মিলিত হয়েছেন বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে। মঞ্চে রয়েছেন দেশের দুই বিশিষ্ট চিত্রনির্মাতা। আদুর গোপালকৃষ্ণন ও তরুণ মজুমদার। সম্ভবত মঞ্চে তরুণ মজুমদারের সেদিনই ছিল সর্বশেষ উপস্থিতি। যাঁর ভাবনা ও করণকৌশলকে বুকে ধরে রেখেছেন আজীবন, সেই স্রষ্টার শতবর্ষে তাঁকে শেষ প্রণাম ও অভিবাদন জানিয়ে তিনি শেষ বিদায় নিলেন। সত্যজিৎ মুগ্ধতা ও সত্যজিৎ বিশ্লেষণ নিয়ে তরুণবাবুর বহু লেখা পড়েছি আমরা। তারই প্রতিভাস ভেসে উঠেছিল কলামন্দিরে তাঁর সেদিনকার বক্তৃতায়। বলেছিলেন তিনি, ‘‘সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন পর্দায় কখনো মিছে কথা বোলো না। পর্দায় মিছে কথা বলার অর্থ হলো সমস্ত সমাজকে কলুষিত করা। কেননা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হয়। যদি কোনো জিনিস লুকোনোর হয় যেটা উচিত নয় অথবা প্রকাশ করা হয় যা প্রকাশ করা উচিত নয়, তাহলে শুধু ভুল করছো না, সমাজের প্রতি পাপ করছো।’’
শৈশব থেকে কেমন করে তিনি বড়ো হয়েছেন, কেমন করে ধাতস্থ হয়েছেন চলচ্চিত্র বিদ্যায়, নিবিড় নয়নে চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীদের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখেছেন, জীবনের শেষবেলায় দুখণ্ডে তার বিবরণী (সিনেমাপাড়া দিয়ে) অনবদ্য গদ্যের সরসতায় ভরিয়ে তুলেছেন। কলকাতায় মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম হলেও শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বগুড়ায়। পরিবারের অনেকেই সে সময় কারাগারে বন্দি। অপরাধ, স্বাধীনতার যুদ্ধে নাম লিখিয়েছেন বাবা ও কাকারা। বগুড়া করোনেশন হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু হয়। তারপর কলকাতার স্টটিশচার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানের স্নাতক হয়েছেন। ছোটোবেলায় ছবি দেখার কথা বলতে গিয়ে চলচ্চিত্র সাংবাদিক নির্মল ধর মশাইকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলেবেলায় সিনেমা দেখায় বাড়ি থেকে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। পয়সাকড়ি ছিল একমাত্র বাধা - এছাড়া আর কোনো বাধা ছিল না।’’ অতি সাম্প্রতিক এক লেখায় (২৯ ডিসেম্বর, ২০২১) তরুণবাবু লিখেছেন, ‘‘তখন বাংলা ছবি শুধুমাত্র ‘ইস্টোরি’ই বলত।’’ তখন বলতে তিনি তাঁর ছোটোবেলার কথা বলেছেন। সত্যিই তো তাই, গল্প বলতে বলতেই তো বাংলাছবি সাবালক হয়েছে। গদারের পরের দিকের ছবি নিয়ে সত্যজিৎ রায়কে বলতে শুনেছি, ‘‘গদার এখন আর গল্প বলেন না, আমার আগ্রহ তাই কমে এসেছে।’’ যাইহোক, চলচ্চিত্র নির্মাণে যখন এলেন তরুণ মজুমদার, নিটোল গল্প বলার ধরনকে কখনও অবহেলা করেননি। তিনজনে মিলে তৈরি করেছিলেন ‘যাত্রিক’। দিলীপ মুখার্জি, শচীন মুখার্জি ও তরুণ মজুমদার। পরে দিলীপবাবু অভিনয়ে চলে গেলেন। শচীনবাবু আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। তরুণ মজুমদার ছবির জগৎ ছেড়ে যাবেন না। তিনি থেকে গেলেন। চায়ের দোকানের আড্ডার বন্ধু সুব্রত দাশগুপ্ত ‘পথের পাঁচালী’ দেখে এসে বন্ধুদের একদিন সেকথা বলছিলেন। ছবিটা কি চলবে না? তরুণবাবু ও তাঁর বন্ধুদের মনে হলো, ছবিটা যেন লোকেরা দেখে, একটা কিছু করা দরকার। পুরনো খবরের কাগজে আলতা দিয়ে কলমের পেছনে তুলো জড়িয়ে লেখা হলো ‘পথের পাঁচালী দেখুন।’ সাত আটজন বন্ধুতে মিলে উত্তর কলকাতার ফড়েপুকুর থেকে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (এখনকার বিধান সরণি) মিছিল হলো। মিছিলে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটেছেন তরুণ মজুমদার। সেই মিছিলে অনেক বছর পরে যিনি সিপিআই(এম)-এর পলিট ব্যুরো সদস্য হয়েছিলেন, সুনীল মৈত্র, তিনি ছিলেন। মিছিলে লোক এসে একসময় কুড়ি-পঁচিশজন হয়ে গিয়েছিল।
‘যাত্রিক’ অনেক কয়টি ভালো ছবি করেছে। বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবি। বাংলার দর্শক সমাজ সে সব ছবি গ্রহণ করেছে। ১৯৫৯ সালে ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবি দিয়ে ‘যাত্রিক’ এর পথ চলা শুরু হয়েছিল। তারপর ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘কাঁচের স্বর্গ’ ও ‘পলাতক’ (১৯৬৩)। ‘পলাতক’ করতে গিয়ে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। পরিচিত কোনো জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা নয়, প্রায় অজ্ঞাত অখ্যাত অনুপ কুমারকে নিয়ে এলেন নায়কের ভূমিকায়। তরুণ মজুমদার ও অনুপকুমার সমবয়সি। ১৯৩১ ও ১৯৩০ সালে জন্ম এঁদের। মনোজ বসুর একটি ছোটোগল্প নিয়ে ছবি। প্রযোজক ভি শান্তারাম। শান্তারাম নিছক অর্থকড়ি বিনিয়োগের লোক ছিলেন না। নিজে পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৬ সালে চিকিৎসক দ্বারকানাথ কোটনিস-কে নিয়ে দ্বিভাষিক (হিন্দি/ইংরাজি) ছবি পরিচালনা করেছিলেন। শান্তারাম নিজে ডাঃ কোটনিসের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সকলেই জানেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্গতদের সহায়তার জন্য এই ভারতীয় চিকিৎসক চীনদেশে গিয়েছিলেন। ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৪৭ সালে দেখানো হয়। অত কথা বলতে চাইলাম এই জন্য যে, ভি শান্তারাম তরুণ মজুমদারকে শুধু অর্থ দিয়েছেন তা নয়, চিন্তাভাবনা সে চলচ্চিত্র নির্মাণে হোক কিংবা সমাজ ভাবনায়, অবশ্যই গড়ে উঠেছিল। তখন তো এই ভাবী চলচ্চিত্রকারের মননের নির্মিতি হচ্ছে।
‘যাত্রিক’ যখন আর রইল না, তরুণ মজুমদার পরিচালক হিসেবে ১৯৬৫ সালে তাঁর প্রথম ছবি করেন ‘আলোর পিপাসা’। ছবির কাহিনিকার বনফুল। সঙ্গীত রচনা করেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও কাইফি আজমি। শিল্প নির্দেশনা বংশী চন্দ্রগুপ্ত। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একই বছরে দ্বিতীয় ছবি মনোজ বসুর কাহিনি নিয়ে ‘একটুকু বাসা’। যে কথা বলতেই হয়, প্রথম ছবি থেকে শুরু করে মোট ১৯টি ছবিতে সুর করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘আলোর পিপাসা’ (১৯৬৫) থেকে শুরু করে ‘আগমন’ (১৯৮৮)। ১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন। অন্য সঙ্গীত পরিচালককে তাঁর নিতেই হয়েছে। এই দুই স্রষ্টার দীর্ঘকালের সৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে আগামীদিনে নিশ্চয়ই কোনো অনুসন্ধানী গবেষক গবেষণা করবেন।
আমরা এই লেখায় তাঁর চলচ্চিত্রের পৃথক আলোচনায় যাব না। যে দুটি কথা তাঁর কাজ সম্পর্কে বলতেই হয় তা হলো, চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সম্পদকে তিনি মনপ্রাণ ভরে কাজে লাগিয়েছেন। দর্শকদের মনে উজাড় করে দিয়েছেন। এমনই তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া, ছাত্রজীবনের আলাপচারিতায় একদিন সুচিত্রা মিত্র বলেছিলেন, ‘‘বারাসতে গাইতে গেছি। এক শ্রোতা চিরকূট ধরিয়েছে, চরণ ধরিতে দিওগো আমারে (দাদার কীর্তি)।’’ আর দ্বিতীয় কথা, অচেনা অজানা অনেককে তিনি নায়ক-নায়িকা করে তুলেছেন। স্বীকারও করেছেন তাঁরা। তথাকথিত সুপারস্টার নির্বাচনে মজে থাকেননি।
মনে পড়ে, তরুণ মজুমদারকে নিয়ে সর্বজনমান্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি কথা। তরুণ মজুমদার একজন ‘টেকনিক্যালি কমপ্লিট ডিরেক্টর’। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা মেইনস্ট্রিম ছবি করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম তরুণ মজুমদার। তিনি টেকনিক্যালি কমপ্লিট ডিরেক্টর। কত ভালো করে ছবি করা যায় তার দৃষ্টান্ত তিনি।
তিনি ভালো বিষয় নিয়ে ছবি করেন। বস্তাপচা যেসব ছবি হয় তার থেকে সহস্র যোজন দূরে।... তাঁর ছবিতে সম্পাদনার ব্যাপারটাও থাকে খুব উঁচু দরের।’’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। দুটি ছবির কথা বলতেই হয়। ‘গণদেবতা’ ও ‘সংসার সীমান্তে’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘‘এই দুটি ছবি মেইনস্ট্রিম থেকে অনেকটা সরে করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এই ধরনের ব্যতিক্রমী ছবি তিনি আর করেননি। ‘গণদেবতা’ ও ‘সংসার সীমান্তে’ ছবি দুটি মাইলস্টোন হয়ে আছে।’’ সঙ্গীতের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘‘তাঁর ছবিতে গান আসে অতি স্বাভাবিকভাবে। গান রাখার জন্য তাঁর ছবিতে গান আসে না।’’
মানুষ এক সময় প্রবীণত্বে পৌঁছোয়। একসময় তাঁকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। জীবনটাকে তিনি সার্থকনামা করে গিয়েছেন। হাল আমলের স্বদেশ ও রাজ্য যে নৃশংসতা ও নৈরাজ্যের শিকার, তার প্রতিবাদে শানিত অভিমত রেখে গিয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রে তিনি বাংলার দর্শককে স্নিগ্ধতায়, মমতায় ও ভালোবাসায় গেঁথেছেন। সমাজজীবনে ব্যভিচারীদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ বাণ বিদ্ধ করেছেন। চলে যাওয়া জীবনের ধর্ম হলেও বড়ো কম ব্যবধানে চলে গেলেন চৈতন্যের তিন অভিভাবক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ ও তরুণ মজুমদার। বর্তমান সংকটকালে এ আমাদের এক অপূরণীয় ক্ষতি।