৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯
রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় চরম বিপদে বাংলার কৃষক
সুপ্রতীপ রায়
গত এক দশকেরও বেশি সরকার পরিচালনা করছে তৃণমূল। কিন্তু গ্রামীণ বাংলা সহ সমগ্র পশ্চিমবাংলাকে নিয়ে মমতা ব্যানার্জির দীর্ঘস্থায়ী কোনো পরিকল্পনা নেই। থাকার কথাও নয়। সে বোঝে শুধু নির্বাচন। যেমন করে হোক নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে। কৃষি ও কৃষককে নিয়েও আজ পর্যন্ত কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা তৃণমূল সরকার গ্রহণ করেনি। চমক দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা মমতার জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির একটি অঙ্গ। কিন্তু প্রকল্পগুলি থেকে মানুষ উপকৃত হচ্ছেন কিনা তা দেখার দায় সরকারের নেই। সরকারে আসার পর মমতা ব্যানার্জি কৃষি বিষয়ক অনেকগুলি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। যেমন কৃষকবন্ধু, বাংলা শস্য বিমা যোজনা, কৃষক রত্ন, সুফল বাংলা প্রভৃতি। এই প্রকল্পগুলি থেকে কৃষক কতটা উপকৃত হচ্ছেন? ‘কৃষকবন্ধু’র টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য তৃণমূলের নেতাদের কাটমানি দিতে হয়। তৃণমূলের সৌজন্যে অবৈধ কৃষকরা ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের টাকা পাচ্ছে।
তৃণমূলের আমলে চুক্তি চাষ, ঠিকা চাষ বাড়ছে। মরছে কৃষক। দেখা যাচ্ছে “চুক্তি চাষ কি ভাল?”-এ প্রশ্নটার মানে হয় না। কেমন কোম্পানি, কী শর্তে চুক্তি প্রশ্ন সেখানে। বাঁকুড়ার ময়নাপুর, বিষ্ণুপুরের কিছু যুবক এলাকার চাষিদের কাছ থেকে আলু নিয়ে কয়েক কোটি টাকার আলু দেন এক কোম্পানিকে। একটি টাকাও দেয়নি সেই কোম্পানি। চাষিরা কানাকড়িও পায়নি। ২০১৩ সালের সেই মামলা আজও ঝুলছে আদালতে। “আমরা একুশ দিন ধরনা দিয়েছি। এলাকার বিধায়ক, সাংসদদের হাতে পায়ে ধরেছি। নবান্নেও গিয়েছিলাম, কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের..”। (পৃঃ ১৭৫ – ফসলের রাজনীতি – বাংলার চাষির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ - স্বাতী ভট্টাচার্য, অশোক সরকার)। অসংখ্য চাষি আজ চুক্তি চাষের ফলে প্রতারিত সর্বস্বান্ত। চুক্তি ভঙ্গের অসংখ্য অভিযোগ বাংলা জুড়ে। আবার চুক্তির ‘লুকানো শর্ত’ থাকে যা চাষি জানেন না। বিপদে পড়েন কৃষক, চুক্তিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার নীরব।
তৃণমূলের আমলে ঠিকা চাষির সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের রাজ্যে চাষের জমিকে ঠিকা দেওয়া বা লিজ দেওয়া অর্থাৎ অন্যের জমি ভাড়ায় চাষ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনানুসারে অন্যের জমি চাষ করার একমাত্র উপায় বর্গা চাষি হিসাবে নথিভুক্তি। জমির মালিক যে কৃষককে বর্গা দেবেন তাঁকে কখনই জমি থেকে উৎখাত করা যাবে না। আমাদের রাজ্যে ১৫ লক্ষ বর্গাচাষি আছেন। কিন্তু সেই রাজ্যে ২০১২-১৩ সালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে পরিমাণ জমি অন্যকে দিয়ে চাষ করার জন্য দেওয়া হয়, রবি মরশুমে তার ৫৫শতাংশ দেওয়া হচ্ছে নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে, আর ফসলের ভাগে চাষ করতে দেওয়া হচ্ছে ২৮শতাংশ জমিতে। ঠিকা চাষি ঠকছেন, বর্গাদার উচ্ছেদ বাড়ছে যা উদ্বেগের। বর্গাদার উচ্ছেদ গত এক দশকে বেড়েছে। বহু গরিব চাষি জমি হারিয়ে অন্যের জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন, খেতমজুরি করছেন। ২০১৮ সালের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে এরাজ্যের ১২ লক্ষেরও বেশি জোতে কেবল ঠিকা নিয়ে চাষ হচ্ছে। প্রতিদিন সংখ্যা বাড়ছে।
চাষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ বীজ, সার। পশ্চিমবাংলায় চাষিরা বীজ কি সঠিকভাবে পাচ্ছেন? এ বিষয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী? বাজারে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরা চাষিকে ঠকাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে ‘কৃষ্ণা-গোদাবরী’ বীজ কোম্পানির কথা বলা যেতে পারে। ২০২০ সালে পূর্ব বর্ধমান জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকের কৃষকেরা খরিফ চাষে ‘কৃষ্ণা-গোদাবরী’ কোম্পানির ধান বীজ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু নভেম্বর মাসে ধান কাটার সময় চাষিরা দেখতে পান ৮০শতাংশ ধানের শিস শূন্য। তাতে চাল আসেনি। বীজের দোষের কারণেই এঘটনা ঘটে। খবরটি সংবাদ মাধ্যমে বেরিয়েছিল কিন্তু রাজ্য সরকার কত জন চাষির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছিলেন?
আমাদের রাজ্যে গত এক দশকে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলির ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু বীজের মান খারাপ হলে চাষির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো পরিকাঠামো রাজ্য সরকার গড়ে তোলেনি। ক্রেতা সুরক্ষা আদালত বা হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হলো বীজের জন্যই যে ফসল মার খেয়েছে - তা প্রতিষ্ঠা করা চাষির পক্ষে কঠিন। এমনকী বীজ উৎপাদনের জন্য সমবায়কেও রাজ্য সরকার কাজে লাগায় না। তৃণমূলের দলীয় রাজনীতি কখনই পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সমবায়কে কৃষকবন্ধু হয়ে উঠতে দেয়নি।
গত একদশকে পশ্চিমবাংলার সরকার কৃষির উন্নতির জন্য যে দীর্ঘস্থায়ী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি তার বড়ো প্রমাণ নতুন জলসেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়নি। চাষের কাজে জল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। সেই জল সরবরাহের কাজে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী? রাজ্য সরকারের দাবি ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প সফল হয়েছে। রাজ্য পঞ্চায়েত দপ্তরের ওয়েবসাইটে ২০১৫ পর্যন্ত দেওয়া তথ্য অনুসারে প্রায় দেড় লক্ষ পুকুর, বিল কাটা হয়েছে। কিন্তু যত পুকুর কাটা বা সংস্কার করা হয়েছে, তার কতগুলিতে সেচের জল পাওয়া গিয়েছে? যেসব পুকুর কাটা হয় তার কতগুলি পুকুরে জল উঠছে তার হিসাব কোথায়? ১০০ দিনের কাজে পুকুর কাটার যে হিসাব দেওয়া হয় সেই হিসাব কতটা সঠিক?
তৃণমূলের রাজত্বে কৃষিখাতে সরকারি টাকার বেশিরভাগ যাচ্ছে অনুদানে, বিজ্ঞাপনে। কিন্তু চাষের পরিকাঠামো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের আগ্রহ নেই। সেচ সহ পরিকাঠামোয়, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ ও ফসলের বিপণনের উন্নতিতে রাজ্য সরকারের খরচ অনেক কম। কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে বর্তমান রাজ্য সরকার চরম অবহেলা দেখিয়ে চলেছে। চাষের উপকরণের দাম বাড়ছে। ফলে চাষির স্বার্থে ডিজেল, বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক প্রভৃতিতে রাজ্য সরকারের ভরতুকি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বর্তমান রাজ্য সরকার এসব বিষয়ে ভরতুকি দেয় না।
রাজ্যে কৃষি বিষয়ক দপ্তরগুলির অবস্থা কেমন? চাষির পাশে থাকা, চাষ বিষয়ক নতুন নতুন প্রযুক্তির সন্ধান দেওয়া, চাষ আবাদে সমস্যা হলে সমাধানের রাস্তা যাদের বলার কথা সেই সরকারি কর্মচারীদের কি কৃষকরা পাশে পাচ্ছেন? উত্তর, না। কারণ গত ১০ বছরে রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কমছে। যেমন উদ্যান পালন বিভাগে সম্প্রসারণ কর্মী প্রতি ব্লকে একজন করে থাকার কথা। অর্থাৎ প্রয়োজন চার শতাধিক। রয়েছেন শ’খানেক। আসলে সম্প্রসারণ কর্মীদের চাষির কাছে যাওয়ার কথা। তথ্য প্রদান করার কথা। সে সব বন্ধ। উদ্যানপালন দপ্তরে ব্লক স্তরে সম্প্রসারণ কর্মী রয়েছেন সারা রাজ্যে ১০০ জন, যদিও এরাজ্যে চাষির সংখ্যা ৭২ লক্ষ।
কৃষি দপ্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ আছে – কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক (কেপিএস)। আগে কেপিএস-দের চাষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হতো, খাতায় সমস্যা লিপিবদ্ধ করতে হতো, আবার কৃষি দপ্তরের আধিকারীকরাও কেপিএস-দের উপর নজর রাখতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে কেপিএস-এর পদ শূন্য হয়েছে – পূরণ হয়নি। ২০২০-র ডিসেম্বরে ১২০০ ফাঁকা কেপিএস পদে নিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ পঞ্চায়েতে কেপিএস-দের পদ শূন্য ছিল। ২০২১ সালে এপ্রিল মাসের হিসাব অনুসারে কর্মীর সংখ্যা ছিল সত্তরের নিচে।
ফিল্ডে নেমে যে কাজ করার কথা (কৃষকবন্ধু, শস্যবিমা, কৃষক পেনশন প্রভৃতি) কর্মীর অভাবে তা অফিসে বসেই সরকারি কর্মীরা করেন। আগে নতুন প্রযুক্তিতে ট্রেনিং দেওয়া হতো মাসে দু’বার। এখন ওসব হয়না। চাষিকে প্রশিক্ষিত করার কাজ বর্তমান রাজ্য সরকার করছে না, ওটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সার ও কীটনাশক কোম্পানির ডিলারদের দিয়ে ওই কাজটি রাজ্য সরকার করে নিচ্ছে। গত একদশকে রাজ্য সরকার কৃষির উপর যে দায়বদ্ধতা পালন করা দরকার তা করছে না। সবটা ছেড়ে দিয়েছে বাজারের উপরে।
‘মা-মাটি-মানুষ’র সরকার কৃষকদের প্রতি যে কতটা উদাসীন তা নিচের তথ্য থেকে প্রমাণিত।
রাজ্যের বাজেট চাষের উন্নতির জন্য খরচ ও বরাদ্দ (কোটি টাকায়)
- | ২০১৯-২০ সালের খরচ | ২০২০-২১ সালের সংশোধিত বরাদ্দ |
রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা | ৯২.৩৮ | ১০১.৫ |
প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা (ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প) | ২৩.৬ | ২.৫৩ |
সুস্থায়ী কৃষি মিশন | ৯.৪৬ | ৮.৮১ |
সয়েল হেল্থ কার্ড | ৩.৮৬ | ০০ |
হাই ইল্ডিং বীজ বিতড়ন | ১১.৮২ | ৭.৫২ |
জল বিভাজিকা প্রকল্প | ১০১.০০ | ১.৪০ |
অন্যান্য | ২২.০০ | ১৪.০০ |
তথ্যসূত্রঃ Demand For Grants of Agricultural Marketing Department in State budget-2021-2022-P-87-187.
আরও একটি তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় বর্তমান রাজ্য সরকার আসলে চাষিদের জন্য কিছুই ভাবেন না -
কৃষি বিপণন ২০১৯-২০২০ সালের খরচ
ফল-সবজি সংরক্ষণ | ১.১৪ কোটি |
ওই বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ | ১.৪৮ কোটি |
মাঠ থেকে বাজার সংযোগ তৈরি | ৫.৩০ কোটি |
গ্রামীণ হাট উন্নয়ন | ০.৭৪ কোটি |
আলু পরিবহণ ভরতুকি | ০.৯৬ কোটি |
সবজি পরিবহণ ভরতুকি | ৬.২৪ কোটি |
মোট | ৬.২৪ কোটি |
বাজার ও সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো উন্নয়ন | ৬৬ কোটি |
স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে খরচ | - |
কৃষি বিপণন দফতরের কর্মীদের বেতন ও প্রশাসনিক | ২০ কোটি |
২০২১-২২ সালের বরাদ্দ (স্থায়ী সম্পদ তৈরি সমেত) | ২২০ কোটি |
চাষির দরকার বাজার। সেই বাজার ধরার জন্য কৃষি বিপণনের দফতর, পৃথক বরাদ্দ। উপরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে তার জন্য রাজ্যে খরচ হয় ২২০ কোটি টাকা। এরাজ্যের কৃষক ৭২ লক্ষ। অর্থাৎ মাথা পিছু বরাদ্দ মাত্র ৩০৬ টাকার ধারে কাছে। এতে কী হয় চাষির? বাংলায় ২৯০০ গ্রামীণ হাট আছে, সেগুলোর জন্য উন্নয়নে খরচ হয়েছে মাত্র ৭৪ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ হাট পিছু বছরে খরচ ২,৫০০ টাকা। অতএব তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে, মুখে কৃষক দরদের কথা বললেও আসলে এই তৃণমূল সরকার শুধু উদাসীনই নয়, কৃষক বিরোধী।