৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯
পণ্য পরিষেবা করের হারে পরিবর্তন সাধারণ মানুষের কাঁধে নতুন করে বোঝা চাপলো
ঈশিতা মুখার্জি
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিজয়ওয়াড়ায় বিক্ষোভ।
কিছুদিন আগেই পণ্য পরিষেবা কর সংক্রান্ত বৈঠক হয়ে গেল। দেশে এমনিতেই চলেছে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোপ। এর উপর বহু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর বসে গেল নতুন করের হার। এটি ছিল কর সংক্রান্ত ৪৭ তম বৈঠক। করের হার নতুন করে বাড়ল অনেকগুলি পণ্যের ওপর, কিন্তু একবারও সরকার প্রয়োজন মনে করল না বিবেচনা করার যে, এই কর বসিয়ে আমাদের অর্থনীতির কী সুবিধা হবে। কেন্দ্রের এই বিজেপি-আরএসএস’র সরকারের প্রতিটি আর্থিক নীতি এইরকমই। কেন কী নীতি নিচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা তারা দেশবাসীকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। কেন নোটবন্দি হয়েছিল এখনো দেশবাসীর কাছে অজানা। একই কথা প্রযোজ্য এই নতুন করের বোঝা চাপানোর ক্ষেত্রেও।
একটু বিশদভাবে এবারের কিছু সিদ্ধান্ত দেখা যাক। এক, সৌর চুল্লীর উপর করের হার ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ হলো। মনে রাখতে হবে, এই সরকার পরিবেশ বৈঠকে গ্লাসগোতে পৃথিবীকে কথা দিয়ে এসেছে যে, কয়লার ব্যবহার কমিয়ে সৌর চুল্লীর উপর জোর দেবে। কিন্তু এখানে এর দামটা বাড়ানো হলো। দেশবাসী সন্দেহ করতেই পারে পরিবেশ রক্ষার সাপেক্ষে এই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা আদৌ রয়েছে তার উপর। করপোরেটের কয়লা খনির উপর মুনাফা বাড়ানোই কী তার লক্ষ্য? চামড়া, জুতো ইত্যাদির উপর করের হার ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হলো। চামড়াকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছোটো ও মাঝারি উদ্যোগী সারা দেশে পণ্য উৎপাদন করে। তাঁদের উৎপাদনের খরচ বাড়ল। এমনিতেই বহু উদ্যোগী নোটবন্দি আর পণ্য পরিষেবা করের জন্য ব্যবসা ছেড়ে আজ বেকার। এর ফলে চামড়া শিল্পের উপর নতুন করে বড়ো আঘাত এলো। এই মুহূর্তে ভারত চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে দ্বিতীয় দেশ। অর্থাৎ আঘাতপ্রাপ্ত হবে আমাদের দেশের রপ্তানি বাণিজ্যও এই করের পরিবর্তিত হারে। এলইডি আলো, লেখার কালি, পেনসিল কাটার কল, ছুড়ি, চামচ, ধাতব পদার্থের ইলেকট্রিক সার্কিট এই সব কিছুর উপর করের হার ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। এরফলে আঘাত আসবে শিক্ষার উপর। আঘাত এল জীবনযাত্রার উপর। আঘাত এল বিদ্যুতের ব্যবহারের উপর। তাহলে কী এই আঘাত দেশের উন্নয়নের উপর হলো না?
প্যাকেট করার আগে খাদ্যপণ্য যেমন দই, ছানা, লসসি, চিঁড়ে, খই, আটা, এই সব পণ্য এই করের আওতার বাইরে ছিল। এখন এই সব খাদ্যপণ্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্যের মতোই ৫ শতাংশ করের আওতায় পড়ল। ছোটো উদ্যোগকে এখন আম্বানি-আদানির ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। এই সমতা কার স্বার্থে দেশবাসীর বুঝতে কী অসুবিধা হবে? প্রকাশ্যেই এই সরকার কাদের স্বার্থ দেখে চলছে তা আর লুকোছাপা নেই। ভোজ্য তেল এবং কয়লার উপরে কাঁচামালের কর ফেরত দেওয়ার একটি বিষয় ছিল, যাতে এই পণ্য উৎপাদনকারীদের দুবার এই করের আওতায় পড়তে না হয়। সেটা তুলে নিয়ে এই পণ্যগুলির দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যাঙ্কের চেক বইয়ের উপর ১৮শতাংশ হারে কর বসল। বোঝাই যায় সরকার ডিজিটাল লেনদেনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তা কী সাধারণ মানুষের স্বার্থে না ডিজিটাল কোম্পানিগুলির স্বার্থে? দৈনিক ১০০০ টাকার কম হোটেল ভাড়ার উপর করের হার ১২ শতাংশ। কিন্তু দৈনিক ৫০০০ টাকার হোটেল ভাড়ার উপর করের হার ৫শতাংশ। বৈষম্য বিস্তর। ফলে ছোটো হোটেল ব্যবসায়ীর উপর কোপ পড়ল। এরকমভাবেই আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের উপর চাপ ভীষণভাবে বাড়ানো হলো।
বোঝাই যাচ্ছে এই নতুন করের হার নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পোদ্যোগের উপর আঘাত। সরকার সবাইকে উদ্যোগী হতে বলছে। রাজ্য সরকার চাইছে সবাই নিজেরা উদ্যোগী হয়ে উঠুন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। স্টার্ট আপের কথা সব সময়েই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মুখে ফেরে। চাকরি নেই, রেকর্ড বেকারি, এই অবস্থায় ক্ষুদ্র শিল্পের উপর আঘাত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর নতুন করে আঘাত নিয়ে এলো।