৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯
‘ছিলে নিছক বেড়াল, আমি বাঘ বানালাম তাকে...’
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘‘মানবতাবাদ হলো মূর্খতা এবং কাপুরুষতার বহিঃপ্রকাশ।’’ ‘‘সাফল্যের জন্য প্রথম এবং অপরিহার্য হলো চিরস্থায়ী ও নিয়মিত হিংসার জোগান দেওয়া।’’ ‘‘হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠন, মিথ্যা যতই বলো - জয়ের পরে কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না।” এক, দুই, তিন করে তিনটে উক্তিই বেশ কয়েকবার পড়লাম। বিখ্যাত নাকি কুখ্যাত জানিনা। তবে খ্যাতিমান (!) মানুষদের এসব সাড়াজাগানো কথাবার্তা একটু ‘হিচ হাইক’ করলেই খুঁজে পাওয়া যায়। আমারও তেমনভাবেই চোখে পড়ে গেল। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’-এর দেশে ‘বসন্ত এসে গেছে’-র মতো ফ্যাসিবাদও এসে গেছে, নাকি আসছে, নাকি পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, নাকি একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হচ্ছে - সেসব গূঢ়তর ও গুরুতর তত্ত্বের ময়নাতদন্ত দূরে থাক। আমরা থাকি আমাদের মতো। গা এলিয়ে, দাঁত কেলিয়ে, সুখযাপন। হিটলার কবে কী বলে গেছে, কেন বলে গেছে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ!!! ‘চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?’
‘‘কোনও দেশ জয় করতে হলে প্রথম সেই দেশের মানুষকে নিরস্ত্র করে দাও।” যার তিন উক্তি দিয়ে লেখা শুরু, এটাও ‘তাঁর’ই কথা। এই অস্ত্র মানে সমরাস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র নাকি মগজাস্ত্র ঠিক জানিনা। তবে সব অস্ত্র কেড়ে নিলেও মগজাস্ত্র যেহেতু সব অস্ত্রের বাপ সেখানে আক্রমণটাই তীব্র। যা ভোঁতা করতে পারলে দখলদারি এবং রাজ করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ক্রোনোলজি সেরকমই বলে। তাই আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন, ছেঁদো, অর্থহীন বিষয়গুলো হয়তো ততটা সরল নয়। তা দিয়েই শিকার ধরা। গুঁড়ি মেরে, থাবা বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সর্বগ্রাসী ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে আসা। দখল, দখল এবং দখল - যেন তেন প্রকারে। সবটুকু। ক্ষমতা - সে অতি বিষম বস্তু। ‘গহ্বরের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো, কেন কেন অসময়ে আমাদের এই বিনাশ?’
আমাদের দেশে ক্রোনোলজি তত্ত্বের জনক মাননীয় শাহ বাবু অথবা মহাঋষির ভেকধারী নরেন বাবু মাঝে মাঝেই গেছোদাদা স্টাইলে হুঙ্কার ছাড়েন। দেশের অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচন যতো এগিয়ে আসবে হুঙ্কারের মাত্রা তত বাড়বে। ঠিক যেভাবে রাজ্যে অনুপ্রেরণা ও উন্নয়নের জনক মাননীয়া বন্দ্যোপাধ্যায় হুঙ্কার ছাড়েন। গোদা ভাবনায় যেগুলোকে তথাকথিত বুদ্ধিমানেরা হেসে, বা বলা ভালো, খিল্লি করে উড়িয়ে দেন। যদিও এঁদের লক্ষ্য একদমই স্থির। এঁরা কেউই হাওয়ায় কোনো কথা ভাসিয়ে দেন না বা অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলেন না। এঁদের কথার শেষ নির্যাসটুকু সমাজের যে স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে এঁরা বাণী বিতরণ করেন, সেই পর্যন্ত কথাগুলো ঠিকই নেমে যায়। সেই বক্তব্য, ক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় আরও অনেক ঘটনা ঘটে। ‘ছিলে নিছক বেড়াল, আমি বাঘ বানালাম তাকে/ নিজের হাতেই খাল কেটে পথ দিলাম কুমিরটাকে।’
কোটেশন - ১ - ‘ইতিহাসবিদরা মুঘলদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। যে কারণে তাঁদের লেখনীতে স্থান পায়নি মৌর্য, গুপ্ত এবং পান্ড্যদের ইতিহাস। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ‘সঠিক তথ্য সংবলিত’ চালচিত্র তৈরি করতে হবে।’ এটা ১০ জুন, ২০২২-এর। নয়াদিল্লির ভাষণ। ইতিহাস বদলানোর কথা অমিত শাহ অবশ্য ২০২২-এর জুনেই প্রথম বলেননি। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বলেছিলেন। আমাদের সবার হয় নজর এড়িয়ে গেছিল, নয়তো গুরুত্ব দিইনি। সেবার তিনি সাভারকর বন্দনার পর বলেছিলেন, ‘‘সকলের কাছে আমার অনুরোধ যে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় ইতিহাসকে নতুন করে লেখার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কাউকে দোষারোপ না করে। ব্রিটিশদের আর কতদিন আমরা দোষারোপ করব যে, তারা আমাদের সাথে অবিচার করেছে?... আমাদের নিজের মতো করে ইতিহাস লিখতে হবে।’’ (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯, ই-ভার্সন)। তিনি আরও বলেন, বীর সাভারকর না থাকলে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহকে কেউ স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলত না, সকলেই একে সাধারণ বিদ্রোহ বলেই চালিয়ে দিত। সাভারকর অবশ্য জন্মেছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের ২৬ বছর পর, ১৮৮৩-র ২৮ মে। যে অমিত শাহ ইতিহাসের পাঠ পড়াতে গিয়ে জানিয়েছেন ভারতীয়রা কোনোদিন অন্য দেশ আক্রমণের পথে যায়নি, সেই তিনিই ১০ জুন দিল্লিতে জানিয়েছেন, ‘‘মৌর্যরা ৫৫০ বছর রাজত্ব করেছে - আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত। সাতবাহনরা ৫০০ বছর রাজত্ব করেছে। গুপ্তরা ৪০০ বছর রাজত্ব করেছেন। কিন্তু আমাদের ইতিহাসে এঁদের কোনও কথা লেখা নেই।” আবার ওইদিনই বলেছেন, ‘‘পান্ড্যরা ৮০০ বছর রাজত্ব করেছে, অহম সাম্রাজ্য ৬৫০ বছর রাজত্ব করেছে, পল্লবরা ৬০০ বছর রাজত্ব করেছেন, চোলরা ৬০০ বছর রাজত্ব করেছেন।... আমি ইতিহাসবিদদের বলতে চাই, এত এত রাজত্ব থাকলেও তারা শুধু মোগলদের নিয়েই ইতিহাস লিখেছেন।” অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান গুলিয়ে গেলে নিজের দায়িত্বে সামলে নেবেন। তবে এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য বা বিরোধিতা না করাই বোধহয় ভালো। তিস্তা শীতলবাদ বা মহম্মদ জুবেইর হয়ে লাভ কী? বেশ তো আছি। ‘‘তুমি ভেবেছিলে, তুমি যতটুকু জানো তার চেয়ে বেশি কোনও জ্ঞান নেই আর, তুমিই পরম...”
যদিও এই প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম গত ১২ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, ‘‘অমিত শাহ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়েছেন, তিনি স্নাতক হননি এবং ইতিহাস তাঁর বিষয় ছিল না। ইতিহাসে কী পড়ানো হয়েছে তা নিজেই যিনি পড়েননি তিনি ইতিহাস নিয়ে বলবেন! তিনি ইতিহাস পড়েছেন? মুশকিল হচ্ছে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেননি তারা স্বাধীনতার ইতিহাস শেখাচ্ছেন। যারা ইতিহাস পড়েননি তারা নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছেন। ভারতের ইতিহাস সংসদ কী বলছে? সেটাকে দখল করেছে বিজেপি। আমরা প্রথম দিন থেকে বলেছিলাম আরএসএস আমাদের ইতিহাসের অংশ নয়। তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে না, তাই তারা ইতিহাস বদলে দিতে চায়।”
প্রায় এই একই ভাষায় বলেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও। ৩ জুলাই হায়দরাবাদে বিজেপি'র জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে তিনি হায়দরাবাদকে ‘ভাগ্যনগর’ বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী মোদি সেদিনের সভায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘হায়দরাবাদই হলো ভাগ্যনগর, এই নতুন নাম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।...” এ নিয়ে কৌন বনেগা ক্রোড়পতি স্টাইলে চারটে অপশনের একটা প্রশ্ন হয়ে যেতেই পারে। প্রধানমন্ত্রী জেনে বুঝে বলেছেন। বিতর্ক উসকে দিতে বলেছেন। জনগণকে সুড়সুড়ি দিতে বলেছেন নাকি, না বুঝে বলেছেন। উত্তর যার যার ভাবনা অনুসারে ভেবে নিন। যার উত্তরে অবশ্য কে টি আর জানিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রথমে আমেদাবাদের নাম আদানিবাদ কেন করে দিচ্ছেন না?’ একধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়েছেন, ‘‘বিজেপি যখন এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসবে, তখন মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রীসভার সঙ্গে আলোচনা করে নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।” নাম বদলের এই খেলা গত আট বছর ধরে চলছে। যদিও তার আগে গুজরাট দাঙ্গার পরে সে রাজ্যের একাধিক ঐতিহাসিক সৌধ রাতারাতি উড়িয়ে দেওয়ার নজিরও আছে। আর কখনো এলাহাবাদ থেকে প্রয়াগরাজ, কখনো সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়ামের বদলে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম, কখনো বা মোগলসরাই স্টেশনের নাম বদলে দীনদয়াল উপাধ্যায় - এসব তো হালের ঘটনা। এমনকী আস্ত একটা ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংস করে মন্দিরের সাক্ষী তো আমরা সকলেই। লোকসভা নির্বাচনের আগেই ঘটা করে তার উদ্বোধনও আমরা দেখব। সেটাও তো ইতিহাস নতুন করেই লেখা, নাকি? লিস্টিতে আরও আছে। যাহা ক্রমশ ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য। ‘পেতেছিলাম ফাঁদ, পড়েছি উল্টোরকম ফাঁদে/বুঝতে পারবে সবাই সেটা আর ক’বছর বাদে।’
আর এই হায়দরাবাদের কর্মসমিতির সভা থেকেই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী তিন-চার দশক ধরে ভারতে রাজ করবে বিজেপি। শাহ বলেন, ‘‘আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলবে বিজেপি'র যুগ। আর এই সময়কালেই ভারত হয়ে উঠবে ‘বিশ্বগুরু’। তিনি জানিয়েছেন, বিরোধীরা এখন ছত্রভঙ্গ। দেশের ভালো হয়, এমন সমস্ত কিছুর বিরোধিতাই এখন তাঁদের লক্ষ্য। বিজেপি'র গৃহীত প্রস্তাবে জানানো হয়েছে, খুব দ্রুত তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করবে বিজেপি। একসময় কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওডিশায়ও ক্ষমতা দখল করবে বিজেপি। আরও কয়েকটি রাজ্যের ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে গুজরাট গণহত্যা মামলায় নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দেওয়া প্রসঙ্গে শাহ জানিয়েছেন, এই রায় ঐতিহাসিক। তাঁর নেতা মোদি ভগবান শিবের মতো সমস্ত বিষ হজম করেছেন। তা বেশ। ‘‘দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল/অন্যে কবে না কথা/বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে/সেটাই স্বাভাবিকতা।’
গুজরাট গণহত্যার পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি নিউটনের তত্ত্ব শুনিয়েছিলেন দেশবাসীকে। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর প্রশ্ন ছিল, পহলে আগ লাগায়া কিসনে? সে সব এখন অতীত। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফুল পাঠানোও। ফুলে ফুলে ফুলতুতো ভাইবোনের কথা এখন সর্বজনবিদিত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী নিয়ে মাননীয়ার পরস্পরবিরোধী অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যে তা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। তবে শাহ-র বক্তব্যের পালটা আমরাও বোধহয় পালটা কিছু বলতেই পারি। লড়াই তো জারি আছে। তিস্তা, জুবেইরদের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠদের আটক করেও তো সে আওয়াজ থামানো যাচ্ছে না। যেমন, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে খোলা চিঠি লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাক্তন আমলারা। চিঠিতে বলা হয়েছে, তিস্তা শীতলবাদকে নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা অবাঞ্ছিত। নাগরিক সমাজ এই অবাঞ্ছিত মন্তব্যে হতবাক। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগছে। সুপ্রিম কোর্টের উচিত এই অবাঞ্ছিত মন্তব্য কেন করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা। ব্যাখ্যা না করে প্রতিদিন নীরব থাকলে তা সুপ্রিম কোর্টের মান মর্যাদাকে আরও ক্ষুণ্ণ করে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিচারপতিদের উদ্দেশ্য কী ছিল? রায় দেওয়া নাকি শীতলবাদকে গ্রেপ্তার করা? একথার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে বিচারপতিদের। সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি তাঁর সম্পর্কে যে ‘ভিত্তিহীন পর্যবেক্ষণ’ করেছেন, তা প্রত্যাহার করারও দাবি তোলা হয়েছে প্রাক্তন আমলাদের পক্ষ থেকে।
হিটলারের উত্থান থেকে পতন - মোটামুটি বছর পঁচিশ বা তার সামান্য কিছু বেশির একটা সময়কাল। যে সময় উত্থান, আরও উত্থান, চরম উত্থান এবং বীভৎস পতন। যে পতনের পর থেকে বিগত সাতাত্তর বছরে সেই নাম, সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা আর কেউ মুখে আনতে চায় না। খুব বেশি কিছু বলা সমীচীন হবে না। তবে এটুকু বলা যায় - ইতিহাস সময়সীমা মেনেই চলে। শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখেছেন - আপাতত সে রকম মনে হতেই পারে, ‘‘যে মরে মরুক, অথবা জীবন/ কেটে যাক শোক করে -/ আমি আজ জয়ী, সবার জীবন/ দিয়েছি নরক করে।” যদিও ইতিহাসে বদল না করেও আগামী লিখবে মানুষের নতুন ইতিহাস। সংগ্রামের ইতিহাস। জয় ছিনিয়ে আনার ইতিহাস।