E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৮ জুলাই, ২০২২ / ২৩ আষাঢ়, ১৪২৯

পরিবেশ আলোচনা

তেশিমা দ্বীপবাসীদের দূষণের বিরুদ্ধে স্মরণীয় লড়াই

তপন মিশ্র


১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে কাগায়া প্রিফেকচারাল বিল্ডিংয়ে তেশিমা দ্বীপবাসীদের প্রতিবাদ।
(ছবিঃ তেশিমা নো কোকোরো মিউজিয়মের সৌজন্যে।)

ঘটনাটি জাপানের। আমাদের অনেকের মনে হয় যে, উন্নত দেশগুলির পরিচ্ছন্নতার মান অনেক উপরে। কিন্তু বাস্তবে একদমই তা নয়। সরাসরি জাপানের তেশিমা (Teshima) দ্বীপের মানুষের পাহাড়প্রমাণ বর্জ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথায় আসি। জাপান দেশটা ছোটো ছোটো দ্বীপের সমাহার। এরকমই ১৪.৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপ তেশিমা, কিন্তু জনশূন্য নয়। প্রায় এক হাজার মানুষের দীর্ঘ দিনের বাস এখানে। এই দ্বীপের আর এক নাম হয়ে উঠেছিল আবর্জনার দ্বীপ (waste island)।

১৯৭৫ সালের শুরু থেকে তেশিমার পশ্চিম প্রান্তে তেশিমা পর্যটন কোম্পানি একটি জায়গা অধিগ্রহণ করে সেখানকার অরণ্য সাফ করে এবং শিল্পের কঠিন বর্জ্য জমা করতে থাকে। এই বর্জ্য কেবল তাদের শিল্পের নয়, অন্যান্য শিল্পের বর্জ্য আমদানি করেও ওই কোম্পানি এই দ্বীপে জমা করতে থাকে। ঘটনাটি জনসমক্ষে আসে ১৯৯০ সালে। এই ১৫ বছরের মধ্যে এখানে কম করে ৭০ লক্ষ টন বর্জ্য জমা হয়ে যায়। এই দ্বীপটি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হওয়ার কারণে তখন দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে তেশিমা হয়ে উঠেছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দ্বীপ। সেই সময়ে এই দ্বীপের প্রকৃতিক সম্পদের সম্ভার ছিল এখানকার বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহের মূল উপাদান। এর সাথে এই দ্বীপ ছিল বাণিজ্যের একটি জনপ্রিয় গন্তব্য স্থল। চাল, ইয়াম বা ওল জাতীয় খাদ্য উপাদান, স্কুইড় ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা হতো এখানে। এই উৎপাদিত ফসলগুলি দ্বীপের বাইরে রপ্তানি হতো। যুদ্ধোত্তর তেশিমাকে একসময় ‘‘দুধের দ্বীপ’’ও বলা হতো। আশপাশের অনেক দ্বীপের শিশুদের জন্য পুষ্টির উৎসস্থল ছিল তেশিমা। এ কারণে এখানে প্রতিবন্ধী এবং অসুস্থদের জন্য বেশ কয়েকটি স্যানিটোরিয়াম গড়ে উঠেছিল। এক কথায় এই দ্বীপকে “আইল্যান্ড অব ওয়েলফেয়ার” (“Island of Welfare”) ও বলা হতো।

উপযোগী বর্জ্যের তত্ত্ব

১৯৭৫ সালে তেসিমাতে শিল্প বর্জ্য জমা করার আবেদন তেশিমা পর্যটন কোম্পানি তৎকালীন গভর্নরের কাছে করে। আবেদনে বলা হয় যে, দ্বীপে কাঠের গুঁড়ো, কাগজের বর্জ্য, খাদ্যের অবশিষ্ট, এবং গবাদি পশুর বর্জ্য ইত্যাদি জমা করা হবে। এককথায় এগুলি উপযোগী বর্জ্য কারণ এগুলি পচনশীল। এই ঘটনায় দ্বীপের মানুষ প্রবল প্রতিবাদ করেন। তা সত্ত্বেও গভর্নর তেশিমা ট্যুরিজমের আবেদন মঞ্জুর করেন। গভর্নর যুক্তি দেন যে, এগুলি মূল্যবান এবং পচনশীল বর্জ্য। তাই এই বর্জ্যগুলি দ্বীপের জন্য উপযোগী হতে পারে। এভাবেই শুরু হয় দ্বীপে বর্জ্য আমদানি। পরে দেখা যায় যে, কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, তামার গুঁড়ো, পোড়া তেল, অ্যাসিড, গাড়ির ভাঙা অংশ, টায়ার, ব্যাটারি এবং ভারি ধাতব বর্জ্য ইত্যাদি এই দ্বীপে জমা করা হচ্ছে। ফলে দ্বীপের দূষণ ক্রমশই বাড়তে থাকল। সিসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়ামের দূষণের ফলে যে সমস্ত রোগ হয়ে থাকে, দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে সেগুলি দেখা যেতে লাগল। এসব সত্ত্বেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে বর্জ্যের পাহাড় হয়ে যায়। বড়ো বড়ো জাহাজে এই বর্জ্য বহন করে নিয়ে আসা হতো। এর বিরুদ্ধে দ্বীপবাসীদের মধ্যে এবং দ্বীপের বাইরে প্রচার ও সংহতি গড়ে তুলতে ১৯৯০ সালে শোজোআকি (Shozo Aki) নামে এক যুবক এগিয়ে আসে। শুরু হয় জোরদার আন্দোলন। শেষে ১৯৯৩ সালে সরকার বাধ্য হয় সম্পূর্ণ ঘটনার তদন্ত করতে। দ্বীপের বাসিন্দারা তাকামস্তু জেলা আদালতে ক্ষতিপূরণের দাবি করে। ১৯৯৬ সালে আদালত এই দাবি মঞ্জুর করে, অর্থাৎ তেশিমা পর্যটন কোম্পানিকে এক বড়ো অঙ্কের ক্ষতি পূরণ দিতে বাধ্য করে।

জাপানে এই ঘটনা প্রথম নয়

১৯৫৬ সালে জাপানের কুমামোটো প্রিফেকচারের (নির্দিষ্ট এক প্রশাসনিক এলাকা) মিনামাতা শহরে মিনামাটা রোগটি প্রথম দেখা দেয়। এটি ‘চিসো কর্পোরেশন’ নামক একটি শিল্প সংস্থার মালিকানাধীন একটি রাসায়নিক কারখানা। এই কারখানার থেকে শিল্প বর্জ্য হিসাবে জলে মিথাইলমারকিউরি নির্গত হয়। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হতো। অত্যন্ত বিষাক্ত এই রাসায়নিক পদার্থের জীবদেহে ক্রমাগত সঞ্চিত হওয়ার (bioaccumulation) ঘটনা মিনামাতা উপসাগর এবং শিরানুই সাগরের শেলফিশ এবং মাছে ঘটে। জীব দেহে এই রাসায়নিক পদার্থের ক্রমাগত বৃদ্ধি (biomagnification) ঘটতে থাকে। স্থানীয় মানুষ, যারা মূলত সামুদ্রিক জীব খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে, তারা পারদের বিষক্রিয়ার কবলে পড়ে। এই থেকে এক মারাত্মক জ্বর দেখা দেয় যার নাম ‘ড্যান্সিং ক্যাট ফিভার’ (‘dancing cat fever’)। এই রোগে বিড়াল, কুকুর, শূকর এবং মানুষের মৃত্যু প্রায় ৩৬ বছর ধরে চলতে থাকে এবং প্রায় মহামারির আকার ধারণ করে। এই রোগের মৃত্যুর হার ছিল ৩৫ শতাংশ। প্রথম অবস্থায় সরকার এই মহামারী প্রতিরোধে তেমন কিছুই করেনি।

সামুদ্রিক খাদ্যে পারদের উপস্থিতির সূত্র ধরে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিনামাতা উপসাগরে পারদের সন্ধান শুরু হয়। এর ফলাফল গবেষকদের হতবাক করে দেয়। উপসাগর থেকে সংগ্রহ করা মাছ, শেলফিশ ইত্যদিতে প্রচুর পরিমাণে পারদ পাওয়া যায়। হাইকেন হারবারে চিসো কারখানার বর্জ্য জল অপসারণের খালের চারপাশে সর্বোচ্চ হারে পারদের ঘনত্বে পাওয়া যায়। এই ধরনের কিছু অনুসন্ধান থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, ওই কারখানাটাই দূষণের উৎস। বর্জ্য জল অপসারণের খালের মুখে দূষণের পরিমাণ ছিল প্রতি টন পলিতে ২ কেজি পারদ। এই ঘনত্ব এতটাই বেশি যে, খালের কাদা থেকে পারদ পুনুরুদ্ধার এবং বিক্রি করার ব্যবস্থা করা হয়। অনুসন্ধানে বোঝা যায় যে, কারাখানা থেকে নির্গত মারকুরি সালফেট খালের জলে থাকা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে মিথাইলমারকুরি তে পরিণত হয়ে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। ১৯৬০-এর দশকে এই কারখানা বন্ধ হলেও ২০০১ সালের মার্চ মাসে জাপানে মিনামাটা রোগীর সংখ্যা ছিল ২২৬৫। মিনামাটা রোগ পরেও অনেকবার জাপানের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। কারখানার বর্জ্য সমুদ্রে ত্যাগ না করার জন্য বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। তার অনেক পরে ২০১৩ সালে পারদজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিনামাটা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।

লড়াইয়ের বার্তা

তেশিমা দ্বীপের ইতিহাসে প্রথম বার এখানকার বাসিন্দারা একটি বিক্ষোভে অংশ নেয় ১৯৭৭ সালে। দীর্ঘ ৩০ বছরের এই আন্দোলনের বেশ কয়েকটি অধ্যায় সংরক্ষিত আছে তেশিমা ন কোকোরো সংগ্রহশালায় (Teshima no kokoro Museum)। দ্বীপ কর্তৃপক্ষের বর্জ্য জমা করার অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধে বাসিন্দাদের বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর শুরু হলো দ্বীপের মধ্যে এবং বাইরে বাড়ি বাড়ি প্রচার। নৌকা করে স্বেচ্ছাসেবীরা ঘুরত অন্যান্য বিভিন্ন দ্বীপে। স্বাক্ষর সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে চলত প্রচার আন্দোলন। মাঝে মাঝে স্বেচ্ছাসেবীরা হতাশ হয়ে পড়তেন। কাউকে কাউকে কান্নায়ও ভেঙে পড়তে দেখা যায়।

তেশিমার ত্রুটির সংশোধন

আন্দোলনের চাপে ১৯৯৬ সালে জাপানের আদালত দ্বীপবাসীদের পক্ষে রায় দেওয়ার পরে তেশিমা দ্বীপে অবৈধভাবে ফেলে দেওয়া শিল্প বর্জ্য নিয়ে ২৫ বছরের পুরনো বিরোধ সমাধানের ব্যবস্থা হয়। আদলতের রায়ের পর যে ব্যবস্থাগুলি ২০০০ সালে নেওয়া হয় সেগুলি হলোঃ প্রথমত, বর্জ থেকে প্রবাহিত দূষিত জল সমুদ্রে প্রবাহিত হতে বাধা দেওয়ার জন্য সেই এলাকার উত্তর উপকূলে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, সমস্ত বর্জ্য গলিয়ে ফেলার জন্য নওশিমায় একটি নতুন চুল্লি বসান হয় যা বর্জ্য কে স্ল্যাগে রূপান্তরিত করতে পারে। এই চুল্লির ক্ষমতা হলো প্রতিদিন ২০০ টন বর্জ্য স্লাগে রূপান্তরিত করার। এই স্ল্যাগ কংক্রিটে পুনরায় ব্যবহার করার মতো উপযোগী করা হয়। তেশিমা দ্বীপের অধিবাসীদের আন্দোলনের ফলে দ্বীপে বর্জ্য জমা করার বিষয়টি বন্ধ হওয়ার সাথেই, আরেকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। তা হলো, বর্জ্য অপসারণের খরচ সরকার বহন করবে কেন? সরকারের অর্থ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দেওয়া করের অর্থ। ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এই দ্বীপ পরিচ্ছন্ন করার খরচ অনুমিত আনুমানিক ৪৯ বিলিয়ন ইয়েন (জাপানের মুদ্রা) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ বিলিয়ন ইয়েন হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জাপান সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে। অর্থাৎ একটা ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প দূষণ করল তার দায় নিতে হলো সরকারকে অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকদের।

অন্যটি হলো, তেশিমা দ্বীপের বাসিন্দাদের জমি ফেরত দেওয়া, যা অবৈধভাবে বিপজ্জনক বর্জ্য জমা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল, এই ধরনের বর্জ্য যাতে ফের দ্বীপে জমা করা না হয়।

পর্যটকরা এই দ্বীপে গেলে তেশিমাবাসীরা করপোরেট লোভের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের কথা শোনাতে ভোলেন না। এই ঘটনাকে স্মরণে রাখতে দ্বীপবাসীরা একটি সংগ্রহশালাও তৈরি করেছে। এক ধনতান্ত্রিক দেশে করপোরেট পুঁজির বেপরোয়া মনোভাবের বিরুদ্ধে এই ঐতিহ্যবাহী সংগ্রাম পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে এক নজির হয়ে থাকবে।