৫৯ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ৮ অক্টোবর, ২০২১ / ২১ আশ্বিন, ১৪২৮
লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যাকারীদের শাস্তি চাই
যোগী সরকারের ফ্যাসিস্ট আচরণের প্রতিবাদ দেশজুড়ে
শহিদ কৃষকদের কফিন নিয়ে লখিমপুরে আন্দোলনকারীরা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরিতে আন্দোলনরত চার কৃষকের হত্যার প্রতিবাদে সরব গোটা দেশ। ৩ অক্টোবর কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অবস্থানরত কৃষকদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র। এই বর্বরোচিত ঘটনায় ৪ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে একজনকে আশিস সরাসরি মাথায় গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় গোটা দেশ। সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছে। ৫ অক্টোবর সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে বলেছে, ৩ অক্টোবর লখিমপুর খেরিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত কৃষকদের পিষে মারার মতো নৃশংস হামলা চালানোর জন্য সরাসরি দায় বর্তায় অজয় মিশ্র টেনির ঘাড়েই। তিনি ২৫ অক্টোবর প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দেন এবং তাতে কৃষকদের বিরুদ্ধে হিংসায় লিপ্ত হওয়ার উস্কানি দেন।
পলিট ব্যুরো এর পাশাপাশি বলেছে, গণতন্ত্রের লকডাউন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে বিরোধী নেতাদেরই গ্রেপ্তারের জন্য যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা এবং ধৃতদের মুক্তি ও বিরোধী নেতারা যাতে নির্বিঘ্নে ওই পরিবারগুলি ও আহতদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন সেই দাবিও জানিয়েছে।
লখিমপুর খেরির যে গ্রামে কৃষকদের হত্যা করা হয়েছে সেই টিকুনিয়ায় যোগী প্রশাসনের নানা বাধাকে ঠেলেই প্রতিবাদ মিছিল করেন কৃষকেরা। তারা চার কৃষকের দেহ নিয়ে অবরোধ সংগঠিত করেন। আন্দোলনের চাপে প্রশাসন কৃষকনেতা এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করতে বাধ্য হয়। আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি অভিযুক্ত আশিস মিশ্রের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এছাড়া আরও ১৫ জন অভিযুক্তকে এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তার করার আশ্বাস দিয়েছে যোগী প্রশাসন।
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে চারজন কৃষকের মৃত্যুর খবর মিলেছে তাঁরা হলেন লাভপ্রীত সিং (২০), দলজিৎ সিং (৩৫), নচত্তর সিং (৬০) এবং গুরবিন্দর সিং (১৯)।
লখিমপুরে কৃষকদের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে এলাহাবাদে সিপিআই(এম)’র মিছিলে সীতারাম ইয়েচুরি, সুভাষিণী আলি, হীরালাল যাদব প্রমুখ।
এই শহিদদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সংযুক্ত কিষান মোর্চা এক বিবৃতিতে বলেছে, হেলিপ্যাড এলাকায় কৃষকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সময় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র টেনিই যে তিনটি গাড়ি সমেত সেই বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে আসেন এবং কৃষকদের গাড়ি চালিয়ে পিষে দেন তা নিশ্চিত। এই জঘন্য কাণ্ডের শেষে সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতা তাজিন্দর সিংহ ভার্ককেও আক্রমণ করা হয় এবং তাকেও গাড়ি চালিয়ে পিষে মারার চেষ্টা চলে। এই হামলার ঘটনায় গুলি পর্যন্ত চলেছে এবং আশিস মিশ্র টেনি ও তার দলবলের ছোঁড়া গুলিতেই একজনের মৃত্যু হয়েছে।
কৃষকদের উপর এই জঘন্য হামলার ঘটনায় জড়িত আশিস মিশ্র টেনি এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২নং ধারার অধীনে হত্যার মামলা করার দাবি জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত করার দাবিও জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি কৃষকদের বিরুদ্ধে নির্মম হুমকি দিয়েছিলেন একথা ভুললে চলবে না।
সুপ্রিম কোর্টে কর্তব্যরত কোনো একজন বিচারকের অধীনে এই রক্তস্নাত হামলার গোটা ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
এই ঘটনায় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার যে বক্তব্য রেখেছেন সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষ থেকে তীব্র ভাষায় তার নিন্দা করা হয়েছে। কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করতে হিংসাত্মক আক্রমণের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। সংযুক্ত কিষান মোর্চা দাবি জানাচ্ছে অবিলম্বে তাকে এই বিষয়ে ক্ষমা চাইতে হবে এবং নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
সংযুক্ত কিষান মোর্চা বিবৃতিতে চলেছে, বিগত দশ মাস ধরে কৃষকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল নাগরিক যেমন শান্তিপূর্ণ এবং অন্তিম পথে নিজেদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা সেভাবেই এই লড়াইতে যুক্ত থাকুন। বিজেপি-আরএসএস’র দুষ্কৃতী বাহিনী মরিয়া হয়ে এই লড়াই সংগ্রামকে ভাঙবার জন্য সমস্ত কায়দা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। সত্য এবং অহিংসাকে পাথেয় করেই এই ধরনের যাবতীয় বাধা পেরিয়ে কৃষকদের আন্দোলন সামনের দিকে এগোতে থাকবে, সংযুক্ত কিষান মোর্চা এই প্রত্যাশায় দৃঢ়।
লখিমপুরের কৃষকদের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে কলকাতায় মিছিল।
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি উত্তরপ্রদেশে পার্টির রাজ্য সম্মেলনে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, বিজেপি’কে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে কৃষক এবং শ্রমিকদের সংগ্রামে সিপিআই(এম) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেছেন, কৃষক আন্দোলনের প্রতি বিজেপি এবং সরকারের আচরণ শুরু থেকেই স্বৈরাচারী এবং দমনমূলক। লখিমপুর খেরিতে ৩ অক্টোবর যে ঘটনা ঘটেছে তা বিজেপি সরকারের ওই আচরণের ফলাফল। তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা দশমাস ধরে আন্দোলন করছেন। সরকার তাঁদের কথা শুনতে রাজি নয়। উলটে সরকারের মন্ত্রীরা এবং বিজেপি নেতা কৃষক আন্দোলনকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। কৃষকরা দৃঢ়তা এবং প্রবল সাহসের সঙ্গে এই আন্দোলন করছেন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ বিফলে যেতে দেওয়া হবে না।
লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যা ও হিংসার ঘটনা যে পূর্ব পরিকল্পিত, তার একের পর এক প্রমাণ মিলেছে। কোনো না কোনোভাবে এই বিক্ষোভ দমনে হিংসার পথ নেওয়া হবে তার আভাস মিলছিল নানা ঘটনায়। বিজেপি নেতাদের হুমকি, দলের কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ চলছিল। লখিমপুরে ২৪ সেপ্টেম্বর কৃষকরা স্থানীয় সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্র টোনিকে কালো পতাকা দেখিয়েছিলেন। খেরি সংসদীয় ক্ষেত্রের পালিয়ায় এক জনসভায় এসেছিলেন মিশ্র। তাঁকে কালো পতাকা দেখান ক্রান্তিকারী কিষান ইউনিয়ন ও ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের কৃষকরা। এর পরেই মিশ্র কৃষকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁর সেই বক্তৃতার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তাতে দেখা যায় মিশ্র বলেছেন, ‘আমার মুখোমুখি পড়ুক, দু’মিনিটে সবক শিখিয়ে দেব।’
এই ঘটনার প্রতিবাদে দিল্লিতে উত্তর প্রদেশ ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা। এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সারা ভারত কৃষক সভা এবং সিআইটিইউ কর্মীরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হন।