৫৯ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ৮ অক্টোবর, ২০২১ / ২১ আশ্বিন, ১৪২৮
বহুমাত্রিক সংগ্রামই সময়ের দাবি
ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য ১৯তম সম্মেলনের ঘোষণা
রায়গঞ্জে সমাবেশ মঞ্চ খুলে দিয়েছে পুলিশ। প্রতিবাদে যুব নেতৃবৃন্দের মিছিলে শামিল মানিক সরকার, মহম্মদ সেলিম সহ অন্যান্যরা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ধর্মের নামে ভাষার নামে জাতপাতের নামে বিভেদের রাজনীতি চলছে দেশে। দক্ষিণপন্থীরা চাইছে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে। তাই আগামী প্রজন্মকে আরও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। মতাদর্শের কথা তুলে ধরতে হবে তাদের কাছে। বহুমাত্রিক সংগ্রামই সময়ের দাবি। হতাশার কোনো অবকাশ নেই। রুজির দাবি, কাজের সংকট সহ স্থানীয় ইস্যুকে যুক্ত করতে হবে বৃহত্তর লড়াইয়ে। পাড়া-মহল্লার সমস্যাকে টেনে আনতে হবে রাজপথে। গরিব শ্রমজীবী বস্তিবাসী যুবদের আরও বেশি সংখ্যায় সংগঠনে নিয়ে আসতে হবে। আগামী লড়াইয়ের রূপরেখার এই আহ্বানই ধ্বনিত হলো রায়গঞ্জে ২ অক্টোবর থেকে তিনদিন ধরে চলা ডিওয়াইএফআই রাজ্য ১৯তম সম্মেলন থেকে।
১৯তম সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশের জন্য পূর্ব নির্ধারিত রায়গঞ্জের রেল ময়দানের সভা বানচাল করার চেষ্টা করে তৃণমূল সরকার। সভামঞ্চ রেল ময়দান থেকে খুলে দিয়ে স্বৈরাচারের নয়া নিদর্শন তৈরি করে মমতা ব্যানার্জির পুলিশ। তবুও সমাবেশ রোখা যায়নি। স্থানীয় স্নেহলতা পার্কে সমাবেশ হয়। সমাবেশ স্থল থেকে এই অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করেন যুব ও গণ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। সমাবেশে ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার বলেন, এই মুহূর্তে দেশের কৃষক, মজুর, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, সংখ্যালঘু, ছোটো ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ কেউ ভালো নেই। ভালো আছেন আম্বানি-আদানিদের মতো বড়ো-বড়ো পুঁজিপতিরা। দেশের সরকার যাদের হাতে তারা কর্পোরেটদের স্বার্থেই আইন তৈরি করছে। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যেমন কৃষকরা আন্দোলন করছেন, তেমনি শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে সোচ্চার শ্রমিকরা। ত্রিপুরায় বিজেপি শাসনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই সিপিআই(এম) একমাত্র আক্রমণের লক্ষ্য। যদি কেউ মনে করেন শুধু লাল ঝান্ডার উপরে আক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকবে তা ঠিক নয়, সাধারণ মানুষও রেহাই পাবেন না। রাজ্যে আইনের শাসন নেই, জঙ্গলের রাজত্ব চলছে ত্রিপুরাতে। সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত। সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর আক্রমণ করেছে বিজেপি। ত্রিপুরার মানুষ এসব মেনে নিচ্ছেন না।
উপচে পড়া সমাবেশে মহম্মদ সেলিম বলেন, মইদুল ইসলাম মিদ্দা পুলিশের লাঠিতে খুন হয়েছেন। তাতে যুব আন্দোলন থামেনি। সন্ত্রাস করে পুলিশ দিয়ে বামপন্থীদের দমানো যায় না। ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভয় মুখার্জি সমাবেশ বাতিলের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, যে তৃণমূল সমাবেশ বাতিল করার চেষ্টা করছে তাদের করোনাকালে মানুষের পাশে দেখা যায়নি। এই যুবরাই মানুষের পাশে ছিলেন বিপদে। সায়নদীপ মিত্র এদিন পুলিশকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, এ রাজ্যের সরকার আর আদানি আম্বানিদের দালাল কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি’র দালাল তৃণমূল একে অপরের রাজ্যে ভাড়ায় খেলছে।
এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মীনাক্ষী মুখার্জি। তিনি বলেন, একজন ফেল করে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি সেটা নিয়ে ব্যস্ত, আর একজন আধা বুদ্ধিতে দেশ চালাচ্ছেন আর আমাদের মতো বেকারদের তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
প্রকাশ্য সমাবেশের পর কর্মসংস্থানের দাবিতে কলকাতায় আন্দোলনের ময়দানে শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্দার নামাঙ্কিত রায়গঞ্জ বিধান মঞ্চে ডিওয়াইএফআই’র ১৯তম সম্মেলন শুরু হয়। রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউটের বাইরের প্রাঙ্গণে এদিন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি। শহিদ বেদিতে মালা দেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, মহম্মদ সেলিম, অভয় মুখার্জি, রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র প্রমুখ। সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করে বক্তব্য রাখেন বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র।
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে গণআন্দোলনের নেতা এবং ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, জাত-ধর্মের নামে বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করতে যুব আন্দোলনের ময়দানকে আরও প্রসারিত করতে হবে। সমাজ সভ্যতার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে দক্ষিণপন্থীরা বিকৃত ইতিহাস প্রচার করে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চাইছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের মৌলিক দাবিগুলি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চাইছে। আমাদের দেশেও আরএসএস এই কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে। যুব আন্দোলনকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ে যুবদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি করে লুটের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যুবদের ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, মতাদর্শগত চর্চা। আন্দোলনের ময়দান থেকে এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হয়।
সম্মেলনে যুব নেতৃবৃন্দ বলেন, ওরা চাইবে বিচ্ছিন্ন করতে আর আমরা আজকের প্রজন্মকে আরও ঐক্যবদ্ধ করব। গ্রামে ১০০ দিনের কাজের লড়াই থেকে শহরের বেকারদের কাজ দেওয়ার লড়াই বাড়াতে হবে। এলাকার মানুষজনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার সঙ্গেই এলাকার ছোট ছোট সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এসএসসি, টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রসঙ্গে নেতৃবৃন্দ বলেন, শাসকশক্তি নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভুল পথে চালিয়ে যুবক-যুবতীদের বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই অংশকে সংগঠনের ছাতার তলায় আনতে হবে। মানুষ যাতে সংকট, সমস্যা নিয়ে বক্তব্য প্রকাশ না করে তাই বিভেদের রাজনীতি চলছে।
রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে ৫৪ জন যুবক-যুবতী প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে কাজের দাবির পাশাপাশি আরও নানাস্তরের মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কথা। সম্মেলন মঞ্চ থেকে সর্বসম্মতিতে ৯১ জনের নতুন রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। রাজ্য কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি সাহা, সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন মীনাক্ষী মুখার্জি, 'যুবশক্তি' পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন কলতান দাশগুপ্ত এবং কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হয়েছেন অপূর্ব প্রামাণিক। ২৫ জনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে ৪৫৩ জন প্রতিনিধি ও ১০ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। রাজ্য সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছেন ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ।