৫৯ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ৮ অক্টোবর, ২০২১ / ২১ আশ্বিন, ১৪২৮
শারদীয় বোঝাপড়া ইত্যাদি...
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘাটালে বানভাসি মানুষের ত্রাণের হাহাকার।
উৎসবমুখর বাঙালির সব থেকে বড়ো উৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। অবশ্য বর্তমানের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে সর্বস্তরের বাঙালির শারদোৎসব কীভাবে যে হিন্দুদের উৎসবে বদলে গেছে তা ঠাওর করা যায়নি। কিন্তু বদলেছে। উৎসব ভালোবাসা বাঙালিকে কান ধরে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে উৎসবটা বাঙালির নয়। হিন্দুদের। উদাহরণ অনেক আছে। জলজ্যান্ত উদাহরণ বোধহয় খ্যাতনামা রেডিয়ো জকি মীর-কে দিয়েই দেওয়া যায়। সম্প্রতি ছোটোবেলায় দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণ করার পরেই যাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে তিনি মুসলমান। অতএব বাঙালির উৎসবে অংশীদার হবার যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন। মানুষের বোধ, ভাবনাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত এই মব লিঞ্চিং-এ আমাদের দ্রুত অভ্যস্ত করিয়ে তোলা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক ‘আমরা-ওরা’য় দ্বিধাবিভক্ত করে দেওয়া সমাজে এখন একমেবাদ্বিতীয়ম সমস্যার সবটাই সম্প্রদায়কেন্দ্রিক। বাকি সবকিছুই তুচ্ছ। আচ্ছে দিন থেকে উন্নয়ন - দুই শাসকের মুখেই এক সুর। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়!
কূটকচালি থাকুক। এসব চলতেই থাকবে। উৎসবের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলায় আপাতত বড়ো বিপর্যয় অবশ্যই বন্যা। যদিও দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চেয়ে রাজ্য প্রশাসন ব্যস্ত ‘ম্যানমেড বন্যা’ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ধরে এই তত্ত্ব নিয়ে একই খেলা চললেও ভবি ভুলবার নয়। বিষয়টা যেহেতু জটিল, তাই এর থেকে সহজ জট আর কিছুতেই পাকানো যায় না।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে রাজ্যের প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ জলবন্দি। পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি জেলার বিস্তীর্ণ অংশ জলের তলায়। বহু জায়গায় প্রশাসনের দেখা নেই। খাবার, পানীয় জল, কোনোরকম ত্রাণই মেলেনি তাঁদের। দেখা মেলেনি কোনও জনপ্রতিনিধির। বন্যার্তদের দেখার জন্য যেন জলবিহারে গিয়েছিলেন কয়েকজন মন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা। তাঁদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই দুর্গতরা ত্রাণের দাবি জানান। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে তাঁদের দিক এড়িয়ে গেছেন ওই নেতা-মন্ত্রীরা। জনরোষের আশঙ্কায় অনেকটা দূর দিয়েই তাঁরা চলে যান।
আর অন্যদিকে নবান্ন থেকে সমস্ত বিষয়কে লঘু করতে ম্যানমেড বন্যার পুরোনো কাসুন্দি। ডিভিসি-কে দায়ী করা। রাজ্যকে না জানিয়ে জল ছাড়ার কারণেই নাকি বন্যা। বন্যা কবলিত কিছু এলাকার মানুষের বক্তব্য, সরকার যদি আগে থেকে বাঁধ সারাই করতো তাহলে এই অবস্থা হতো না। যদিও এবার কড়া উত্তর দিয়েছে ডিভিসি-ও। রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে তারা জানিয়েছে, জলছাড়ার আগে রাজ্যের সেচ দপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জেলাশাসককে জানানো হয়েছে। এছাড়াও এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষ থেকে হাওড়া, হুগলির জেলাশাসক, এসডিও, বিডিওদের জানানোর কথা। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর বহু আওড়ানো ‘ম্যানমেড বন্যা’ তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে ডিভিসি। তাহলে দায় কার? দীর্ঘদিন ধরে পুরসভা নির্বাচন ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে কোনো এলাকাতেই কোনো কাজ হয়নি। বন্ধ হয়ে গেছে নিকাশি নালা সংস্কারের কাজ। অবৈধ বালি খাদান থেকে জলা ভরাট করে দেদার বিক্রির দায় আজ বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এ সবই কি মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসনের অগোচরে?
অজয় নদের বাঁধভাঙা জলে ভাসল কেতুগ্রাম।
গত দুই মাসে প্রায় চারবার বন্যার মুখোমুখি হয়েছেন ঘাটালের বাসিন্দারা। দ্বিতীয়বারের বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে গিয়েছিল। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর অবস্থাও সঙ্গীন। মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলেনি। সামান্য কিছু ত্রিপল ও পোশাক ছাড়া মেলেনি কিছুই। নৌকো ঘিরে অনেকেই ঝুলে পড়েছিলেন। কিন্তু তাতে বিপত্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র চন্দ্রকোনায় পরিদর্শনে যাবেন বলে ঠিক করে পরে তা বাতিল করেন। ত্রাণ না পেলে জলবন্দি মানুষেরা সরব হতে পারেন, এই রিপোর্ট পেয়ে তিনি তাঁর যাত্রা বাতিল করেন বলে অভিযোগ। চন্দ্রকোনা খামারবেড়িয়া গ্রামে দুটি বাঁধ দ্বিতীয়বারের বন্যায় ভেঙে গিয়েছিল। অবশ্য রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রীও মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে দাবি করেছেন, রাজ্যকে না জানিয়ে জল ছাড়া হয়েছে। তাতেই বন্যার ভয়াবহতা বেড়েছে। তিনি আর বলেছেন, এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে একমাত্র ভরসা মা দুর্গা। স্থায়ী মুক্তির জন্য মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানাবো। ‘মা দুর্গা’ কার পক্ষে দাঁড়াবেন? সাধারণ মানুষের পক্ষে নাকি প্রশাসনের পক্ষে? নাকি তিনি আপাতত শ্রাদ্ধ না করে উৎসবে ব্যস্ত!