৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০
‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের মুম্বাই বৈঠক
বিজেপি হঠাতে যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’ - এই স্লোগানকে সামনে রেখেই আগামী লোকসভা ভোটে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে হঠাতে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবে বিরোধীরা। ১ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বৈঠকে এই সঙ্কল্প গ্রহণের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য করার জন্য আলাদা আলাদা মোট পাঁচটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এগুলি হলো - প্রচার, সামাজিক মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম এবং গবেষণা ও চর্চা সংক্রান্ত কমিটি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আদান-প্রদানের মাধ্যমেই আসন সমঝোতার বিষয়টি চলতি মাসের শেষের দিকে চূড়ান্ত করে ফেলা হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’ স্লোগান গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রচার, নির্বাচনী কৌশল, মিডিয়া কৌশল রূপায়ণ করবে পৃথক পৃথক কমিটি। এই মঞ্চের সর্বোচ্চ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে ১৪জন সদস্য নিয়ে গঠিত কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে।
প্রসঙ্গত, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’-র প্রথম বৈঠক পাটনা, দ্বিতীয় বৈঠক বেঙ্গালুরুর পর এবারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে। মুম্বাইয়ের বৈঠকে বিজেপি-বিরোধী ২৮টি রাজনৈতিক দলের ৬৩জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের দায়িত্বে ছিল শিবসেনা (উদ্ধব)-এনসিপি-কংগ্রেসকে নিয়ে গঠিত মহাবিকাশ আগাড়ি।
১ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া মঞ্চের দু’দিনের বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সামনের লোকসভা ভোটে যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজ্যভিত্তিতে আসন সমঝোতার প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু করা হবে, সহযোগিতা ও দেওয়া-নেওয়ার মনোভাব থেকেই এই সমঝোতা হবে।
এটা স্পষ্ট যে, সব রাজ্যে পূর্ণাঙ্গ আসন সমঝোতা হবে না। হতেও পারে না। বামপন্থীরা বারবার বলছিলেন, রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনী কৌশলই বাস্তব পদক্ষেপ। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আসন সমঝোতা সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হবে বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের জ্বলন্ত সমস্যা এবং দেশের সংকট জনগণের সামনে তুলে ধরতে দেশজুড়ে এখনই সমাবেশ শুরু করবেন ‘ইন্ডিয়া’-র নেতৃবৃন্দ।
বৈঠকে সব দলের নেতৃবৃন্দই একবাক্যে বলেছেন যে, ‘ইন্ডিয়া’র ব্যাপ্তিতে টলে গিয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিরোধী ঐক্য দেখেই এনডিএ’কে নতুন করে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, সে কারণেই অনেকগুণ দাম বাড়িয়ে এখন রান্নার গ্যাসের দাম সিলিন্ডার প্রতি ২০০ টাকা কমাতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র। বিরোধীদের এককাট্টা মেজাজ দেখে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের ডাক দেওয়া হয়েছে, যে সংসদে কোনো অধিবেশনেই হাজির থাকা পছন্দ করেন না স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আবার আগাম ভোটের তাগিদে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর কথাও ঘোষণা করেছে। তাই বিরোধীরা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত এই মঞ্চে দেশের ২৮টি দল শামিল হয়েছে। বিরোধীরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে আরও অনেক দল এই মঞ্চে যোগ দেবে। এমনকী এনডিএ ছেড়ে কয়েকটি দলের ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মঞ্চের নেতৃবৃন্দ সকলেই বলেছেন, দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র রক্ষা করাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই লক্ষ্যেই আমরা শামিল হয়েছি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী স্পষ্টভাবে জানান, বিজেপি-কে পরাস্ত করতে পারবেন বলে তাঁরা চূড়ান্তভাবে আশাবাদী। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখানে যে দলগুলি মিলিত হয়েছে তারা দেশের ৬০ শতাংশ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করলে বিজেপি হারতে বাধ্য। বিরোধী দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তারা আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নমনীয়তা দেখিয়েছে। তিনি বলেন, নেতৃবৃন্দের মধ্যে সম্পর্ক এক নতুন দিশা দেখিয়েছে, দেশের উন্নয়নে গরিবদের শামিল করে এগিয়ে যাবার স্পষ্ট রাস্তা দেখাবে ‘ইন্ডিয়া’।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব দূরীকরণের অভিন্ন লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তিনি অভিযোগ করেন, দেশের মানুষদের টাকা গায়েব করে বৃহৎ শিল্পপতিদের সাহায্য করছেন মোদি। এই লুটের রাজত্ব বন্ধ করতেই ভোটে জিততে হবে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চকে।
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এক জোট হওয়ায় আগামী ভোটে সাফ হয়ে যাবে বিজেপি। বিভিন্ন বিষয় দেখে এই সঙ্কেতই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি রাজ্যস্তরে আসন সমঝোতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, সমস্ত আলোচনাই হবে রাজ্যস্তরে সেই রাজ্যের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে। তিনি জানান, বেঙ্গালুরু বৈঠকের পরেই ফের এনডিএ-কে বাঁচিয়ে তোলার কাজে নামে বিজেপি। মুম্বাইয়ের বৈঠকের আগেই গ্যাসের দাম কমাল এনডিএ সরকার। এরপরই আশঙ্কিত মোদি সরকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে দিল। আগামীদিনে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের ভয়ে আরও কত কী যে দেখতে হবে বলে কটাক্ষ করেন তিনি। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের চরিত্র, সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও দলগুলি। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠাও মঞ্চের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে সংবিধানে বর্ণিত দেশের মানুষের সমস্ত ধরনের গ্যারান্টি বজায় রাখাও আমাদের কাজ। এসব সক্রিয়ভাবে করতে পারলেই বিজেপি’কে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, এই লক্ষ্যেই আমরা মিলিত হয়েছি। মানুষের সমস্যা নিয়ে আগামীদিনে দেশের কোণে কোণে জনসভা করা হবে। আমরা জনগণের মধ্যেই আছি। বিভিন্ন ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাদের কাছে আরও যাবার উদ্যোগ চলবে। আগামীদিনে ‘ইন্ডিয়া’-কে আরও সক্রিয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যাবে। আরও অনেক দল এই মঞ্চে যোগ দেবে বলে তিনি আশাপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভারতকে বাঁচানো এবং এই ভারতের পরিবর্তনই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এটাই দেশবাসীর কাছে আমাদের আশ্বাস।
শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে মোদির ‘পরিবারতন্ত্র’কে কটাক্ষ করে বলেন, আমরা বন্ধুদের পরিবারতন্ত্রও চলতে দেব না। ভয়মুক্ত ভারত গড়ব।
তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন বলেন, আমরা ভিন্ন ভিন্ন দল হলেও দেশ বাঁচাতেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। দেশের বহুত্ববাদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করাই মূল কথা।
আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব বলেন, দেশের সংখ্যালঘু জনগণ বিপদের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফেলছেন মোদিরা। এই সরকারকে হটিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব আমরা।
এছাড়া এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, আপ নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও বক্তব্য রেখেছেন।
আপাতত দেশে দিল্লি, চেন্নাই, পাটনা, গুয়াহাটি ও নাগপুর - এই পাঁচটি স্থানে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের ডাকে বড়ো জমায়েত হবে বলে জানা গেছে।
কো-অর্ডিনেশন কমিটি সহ অন্যান্য কমিটি
মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান’ মঞ্চের বৈঠকে যে ১৪জন সদস্য নিয়ে কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হয়েছে, তাতে সিপিআই(এম)-র প্রতিনিধি কে হবেন তা পরে জানানো হবে। অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন - ডি রাজা (সিপিআই), কে সি বেণুগোপাল (কংগ্রেস), শারদ পাওয়ার (এনসিপি), টি আর বালু (ডিএমকে), হেমন্ত সোরেন (জেএমিএম), সঞ্জয় রাউত (শিবসেনা-উদ্ধব), তেজস্বী যাদব (আরজেডি), অভিষেক ব্যানার্জি (টিএমসি), রাঘব চাড্ডা (আপ), জাভেদ আলি খান (সপা), লালন সিং (জেডিইউ), ওমর আবদুল্লা (ন্যাশনাল কনফারেন্স) এবং মেহবুবা মুফতি (পিডিপি)।
এছাড়া প্রচার কমিটিতে সিপিআই(এম)’র প্রতিনিধি হিসেবে আছেন অরুণ কুমার, সিপিআই’র তরফে বিনয় বিশ্বম। ১৯ জনের এই কমিটিতে এছাড়াও রয়েছেন গুরদীপ সিং পপ্পল, সঞ্জয় সিং, রবি রাই, জি দেবরাজন, হাসনাইন মাসুদি, তিরুচি শিবা, মেহবুবা বেগ প্রমুখ। সোশ্যাল মিডিয়া কমিটিতে আছেন সিপিআই(এম)-র প্রাঞ্জল, কংগ্রেসের সুপ্রিয়া শ্রীনাতে, পিডিপি’র ইত্তিজা মুফতি, সিপিআই’র ডাঃ ভলচন্দ্রন কাঙ্গো, ডিএমকে’র দয়ানিধি মারান, আরএলডি’র রোহিত ঝঙ্করসহ অন্যান্যরা। সংবাদমাধ্যম সংক্রান্ত কমিটিতে আছেন সিপিআই(এম)-র প্রাঞ্জল, কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ ও পবন খেরা, এনসিপি’র জীতেন্দ্র আহওয়াদ, ডিএমকে’র কানামোঝি, জেডি (ইউ)-র মনীশ কুমার প্রমুখ। এই কমিটিতেও কাজ করবেন ১৯জন। এছাড়া গবেষণা সংক্রান্ত কমিটিতে আছেন ১১জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শিবসেনার প্রিয়াঙ্কা চর্তুবেদি, জেডি(ইউ)-র কে সি ত্যাগী, ডিএমকে’র এ রাজা, জেএমএস’র সুদভিয়া কুমার সোনু, আপ-এর জেসমিন শাহ প্রমুখ। এই সমস্ত কমিটিতে তাদের প্রতিনিধিদের নাম পরে জানাবে বলে জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
‘ইন্ডিয়া’র উদ্যোগে গান্ধী জয়ন্তী
আগামী ২ অক্টোবর দেশজুড়ে ‘গান্ধী জয়ন্তী’ পালন করবে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ। ২ সেপ্টেম্বর পাটনায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এই কর্মসূচির কথা জানিয়ে বলেছেন, মুম্বাইয়ে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সদ্য অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়েছে মুম্বাই বৈঠকে।