E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০

দলিতের অধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হলো হায়দরাবাদের ন্যাশনাল দলিত সামিট

অলোকেশ দাস


বিজেপি সরকারের আমলে দলিতদের উপর আক্রমণ বেড়েছে। মনুবাদী নীতিতে চলা সরকার ক্রমশ দলিত মানুষের ওপরে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অসমতার যন্ত্রণা বহন করে চলেছেন দলিতরা। জীবনযাত্রার মানের সব সূচকে তাদের পিছিয়ে রেখেছে সরকারের নীতি। সংরক্ষণের প্রয়োগ নেই, কাজ, শিক্ষা,জমি সবকিছুতেই তফশিলিরা বঞ্চিত। সেইজন্য দলিতদের একত্রিত করে মনুবাদী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ২৬-২৭ আগস্ট হায়দরাবাদের বেগমপেট-এ অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল দলিত সামিটে নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানান। এই মুহূর্তে দলিতদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু বিজেপি সরকারকে হঠানোর আহ্বানও কনভেনশনে উঠে এসেছে। ২৪টি রাজ্য থেকে ৮৭টি দলিত সংগঠনের ৩২২ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন হায়দরাবাদে। তাঁরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন - আগামী ৪ ডিসেম্বর ‘দিল্লি চলো’ অভিযান সংগঠিত হবে। গোটা দেশের দলিত মানুষ আছড়ে পড়বে সেদিন রাজধানীর উপকণ্ঠে। তার আগে দলিতদের দাবিগুলি নির্দিষ্ট করে এক কোটি মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চলবে দেশজুড়ে। দাবিগুলি জনপ্রিয় করবার জন্য রাজ্যস্তরে কনভেনশন হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই কনভেনশন হবে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর। নেতৃত্ব আহ্বান জানিয়েছেন, আরও বেশি করে দলিত পরিবারগুলোর সঙ্গে দলিত সংগঠনগুলির সংযোগ বাড়াতে হবে। এই সমস্ত কর্মসূচি সফল করবার জন্য ১০ জনের একটি দলিত সমন্বয় কমিটিও তৈরি হয়েছে। রামচন্দ্র ডোম, বি বেঙ্কট প্রমুখ এই কমিটিতে আছেন। ন্যাশনাল দলিত সামিটে বক্তব্য রাখেন ইউজিসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুখদেও থোরাট। কনভেনশনে দলিতদের ‘ভিশন ২০৫০’ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা রাখা হয়েছিল। মূল প্রস্তাবের ওপর ৭০ জন প্রতিনিধি আলোচনা করেন। ডাঃ রামচন্দ্র ডোমের নেতৃত্বে ছয়জনের সভাপতিমণ্ডলী সামিট পরিচালনা করেন।

জাতীয় দলিত সম্মেলনে যে দাবিসমূহ উত্থাপিত হয়েছে -

জীবিকাঃ

১. গ্রামীণ ও শহুরে সাধারণ সম্পত্তির সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহারে দলিতদের ন্যায়সঙ্গত অংশীদারি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে।
২. খাদ্য, নিরাপদ পানীয় জল, বস্ত্র, বাসস্থান, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক সেবা সহ সমানভাবে নারী ও পুরুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনযাপনের অধিকার রক্ষা করা, জীবিকার মজুরির অধিকার এবং ৫ একর চাষযোগ্য জমির অধিকার বা লাভজনক কর্মসংস্থানের অধিকার সরকারকে দিতে হবে।
৩. প্রতিটি দলিত পরিবারের মৌলিক চাহিদা যেমন বাড়ি, রাস্তা, বিদ্যুৎ, পয়প্রণালী, কমিউনিটি হল এবং সমস্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা উপভোগের সুযোগ।
৪. বন্ডেড লেবার সিস্টেম (বিলুপ্তি) আইন, ১৯৭৬ কার্যকর করো এবং অবিলম্বে শিশু শ্রম বিলোপ করো।

শিল্প/উদ্যোক্তাঃ

১. দলিত শিল্পপতি/উদ্যোক্তারা সমস্ত সরকারি ক্রয় এবং চুক্তিতে আনুপাতিক সংরক্ষণ পাবেন।
২.মাঝারি থেকে বৃহৎ শিল্প স্থাপনের জন্য দলিতদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিল্পপতি, দলিত সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাসহ একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করা হবে।

জমিঃ

১. নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রতিটি দলিত পরিবার আর্থ-সামাজিক কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে চাষযোগ্য জমির মালিক হবে যা ৫ একরের কম হবে না। সরকারের উচিত একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি, সরকারি রাজস্ব জমি এবং মন্দিরের জমি বণ্টনসহ সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে সরকারের উচিত চাষের জমি কিনে দলিতদের মধ্যে বণ্টন করা।
২. অ-দলিতদের দখলে থাকা দলিতদের বরাদ্দকৃত সমস্ত জমি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে চিহ্নিত করার জন্য জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে সংবিধিবদ্ধ কমিটি নিয়োগ করতে হবে, যাতে তা দলিতদের দখলে দেওয়া যায়।

দারিদ্র্যঃ

১. এসসি এবং এসটিদের জন্য আনুপাতিক ভাগ নিশ্চিত করার জন্য মূলধনের বণ্টনকে গণতান্ত্রিক করতে হবে।
২. তফশিলি এবং আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে যাতে তারা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সংস্থান সহ বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে পারে এবং এই ধরনের বাজার উদ্যোগগুলির জন্য তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার বিকাশ হয়।

শিক্ষাঃ

১. নয়া শিক্ষা নীতি প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অবিলম্বে সমস্ত দলিতের জন্য বাধ্যতামূলক, বিনামূল্যে এবং উচ্চমানের শিক্ষা কার্যকর করতে হবে, নিরক্ষরদের সংখ্যা এবং স্তরের অনুপাতে তহবিল বরাদ্দ করতে হবে। যে পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের শিশুশ্রমে যুক্ত করতে বাধ্য হয় তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে, বৃত্তির সংখ্যা এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। তফশিলি এবং আদিবাসী স্কুলগুলিতে আরও ভাল পরিকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করতে হবে। বাজার-ভিত্তিক বৃত্তিমূলক এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৩. তফশিলি জাতির জন্য আবাসিক স্কুলগুলি অবিলম্বে চালু করতে হবে। ছাত্রদের জনসংখ্যা অনুযায়ী তালিকাভুক্ত করা হবে যাতে সম্প্রদায়ের প্রত্যেকে একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা লাভের সুযোগ পেতে পারে।
৪. প্রাথমিক থেকে কারিগরি ও পেশাগত স্তর পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ কোটা প্রযোজ্য করতে হবে। স্বল্প আয়ের প্রতিটি তফশিলি, আদিবাসী শিশুকে রাজ্যের খরচে মানসম্পন্ন বিনামূল্যে-শিক্ষা দিতে হবে। এবং প্রতিটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলকে অবশ্যই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
৫. ভারতের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে, বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিক বা স্বায়ত্তশাসিত বা নিবন্ধিত সংস্থাগুলিতে বৈচিত্র্য বা তফশিলি, আদিবাসীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিবাচক কর্মের নীতি মেনে চলে না, তাদের অবশ্যই স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ প্রদান বন্ধ করতে হবে। সমস্ত বেসরকারি শিল্প/করপোরেট হাউসগুলিকে অবশ্যই কর্মশক্তিতে বৈচিত্র্য-গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

কর্মসংস্থানঃ

১. অবিলম্বে কার্যকর পুনর্বাসন, বিকল্প এবং টেকসই কর্মসংস্থান ব্যবস্থা এবং উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের অপমানজনক প্রথা দূর করতে হবে। এবং ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের নিয়োগ এবং শুষ্ক শৌচাগার নির্মাণ (নিষেধ) আইন, ১৯৯৩ প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষকরে রেল, প্রতিরক্ষা, নগর স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় এই নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
২. প্রতিরক্ষা এবং নগর স্থানীয় সংস্থায় সরকারি সেক্টর এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো একই অনুপাতে বেসরকারি এবং করপোরেট সেক্টরে সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই বিভিন্ন সেক্টরের চাহিদা মোকাবিলা করতে দলিতদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বিকাশ করতে হবে। পদোন্নতিতে সংরক্ষণ পুনরুদ্ধার করতে হবে।
৩. যুদ্ধকালীনভাবে অবিলম্বে দলিতদের জন্য সমস্ত ব্যাকলগ পোস্ট পূরণ করতে হবে এবং তাও, শুধুমাত্র দলিত প্রার্থীদের দিয়ে।
৪. এম এন রেগাকে শক্তিশালী করতে হবে। ২০০ দিনের কাজ এবং দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করে ৬০০ টাকা করতে হবে।

নৃশংসতা/অস্পৃশ্যতাঃ

১. রাজ্যকে অবশ্যই তফশিলি এবং আদিবাসীদের সুরক্ষার একমাত্র দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সেসব হিংসাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করতে হবে এবং বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
২. তফশিলি এবং আদিবাসী (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইন, ১৯৮৯ এবং বিধিমালা ১৯৯৫, বিশেষকরে দলিত মহিলাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার বিষয়ে অক্ষরিকভাবে ও চেতনাগতভাবে কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে। সেই অনুযায়ী প্রভাবশালী বর্ণবাদী নেতাদের এবং তাদের অনুসারীদের বিচার করতে হবে যারা বর্ণ সংঘর্ষের আগুন জ্বালায় এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করে। তফশিলি জাতি ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ক্ষেত্রে সম্মিলিত শাস্তির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেহেতু নিপীড়করা তাদের সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং সুরক্ষা উপভোগ করে এবং আইনের হাত এড়িয়ে যায়।
৩. POA আইনের অধীনে অপরাধীদের ক্ষেত্রে পুলিশ স্টেশন থেকেই অপরাধীদের জামিন দেওয়ার আইনের প্রয়োগ এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার থেকে বাঁচানো প্রযোজ্য হবে না।

বাজেটঃ

১. উপ-পরিকল্পনার অধীনে কেন্দ্রীয় বাজেটে তফশিলি জাতির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল রক্ষার জন্য জাতীয় স্তরের আইন প্রণয়ন করতে হবে। একই আইন পৃথক পৃথক রাজ্যেও প্রণীত হবে।