E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০

ত্রিপুরার চিঠি

ত্রিপুরায় উপনির্বাচনের নামে প্রহসন

হারাধন দেবনাথ


ভোর চারটা থেকে ভোটের লাইনে ভোটাররা। কিন্তু ভোট দিতে পারেননি। অথচ ভোট শুরুর দু’ঘণ্টা পর জানিয়ে দেওয়া ১৬১ জনের ভোট হয়ে গেছে! ধনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের একটি বুথে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন সমীর দে, রসিদ মিঞার মতো বহু ভোটার। বক্সনগর বিধানসভা কেন্দ্রের একটি বুথ কেন্দ্রে বিজেপি-র নির্বাচনী এজেন্টরাই ছাপ্পা ভোট দিয়েছে প্রকৃত ভোটারদের ইভিএম মেশিনের পাশে দাঁড় করিয়ে। গণতন্ত্র হত্যার ফ্যাসিস্টসুলভ আচরণ ৫ সেপ্টেম্বর দেখা গেছে ত্রিপুরার দু'টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচনে। বুথ দখল, ছাপ্পা ভোটের নিজেদের নজির নিজেরাই ভেঙেছে নির্বাচন কমিশন, নিরাপত্তা কর্মীদের কাকতাড়ুয়া সাজিয়ে রেখে। বামফ্রন্ট উপ নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরার দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ৮ সেপ্টেম্বরের গণনা বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য বামফ্রন্ট বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ভোটদানে বাধা, ভোটের লাইনে ভোটারদের মারধর, বহিরাগতদের দিয়ে এলাকা দখল - এমন কোনো অন্যায় কাজ বাদ রাখেনি বিজেপি’র দুর্বৃত্তরা।

শাসক বিজেপি জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে ভীতির পরিবেশ শুরু থেকেই কায়েম করে। সন্ত্রাসের কায়দা বদল করে। সম্পদ ধ্বংসের, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্টসুলভ চেহারাই মেলে ধরে বিজেপি। এটাই আজকের ত্রিপুরার ছবি।

দুই কেন্দ্রের ভোট শেষে সন্ধ্যায় যখন আগরতলায় ফিরছিলাম তখন গাড়িতে বসা এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন - বিজেপি সরকারে, তারপরও কেন ভোটারদের ভোট দিতে দিল না? জনগণকে ওদের এতো ভয়? স্থানীয় কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমও ভোট জালিয়াতি নিয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছে। কিছু সংবাদপত্র সত্য আড়ালে রেখে কল্পিত কাহিনি লিখেছে। আবার কোনো সংবাদপত্র দুই দলের বক্তব্যও ছেপেছে। যাই হোক, এই ভোটেও জনগণের প্রতিরোধও ছিল কোথাও কোথাও।

২০-বক্সনগর কেন্দ্রের ৪৬ নম্বর বুথের ভোট কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থীর দু’জন পোলিং এজেন্ট ছিল বিজেপি কর্মী। শাসক দলের নিজস্ব দু’জন পোলিং এজেন্ট তো ছিলই। পোলিং এজেন্টদের বসার জায়গার কাছেই রাখা ছিল ভোটিং কম্পার্টমেন্ট। ভোটাররা সেখানে পৌঁছুতেই শাসক দলের পোলিং এজেন্টরা ভোটিং কম্পার্টমেন্টে ঢুকে নিজেরাই ভোটিং মেশিনের বোতাম টিপে দিয়েছে। ভোট কেন্দ্রের ভেতরেই শাসক দলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্প করে দাঁড়িয়ে বা বসে ছিল। ভোটে পাহারায় থাকা বিএসএফ জওয়ানরা সেদিকে ফিরেও তাকায়নি। বরং এক জওয়ান সাংবাদিক দেখে নিজে থেকেই বলতে থাকেন ‘এমন শান্তিপূর্ণ ভোট দেখিনি’। সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে কিছুটা ইতস্তত হলেও তারা ভোট কেন্দ্রের বাইরে যায়নি। বরং একজন ‘প্যারালাইসিসের রোগী’ ভোট দিতে এলে তাকে সাহায্য করার নামে ভোট কেন্দ্রের ভেতরে নিয়ে সোজা ভোটিং কম্পার্টমেন্টে চলে যায় বিজেপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট। দরজার বাইরে থেকে একজন সাংবাদিক ঘটনার ভিডিয়ো করতে শুরু করলে অন্য পোলিং এজেন্ট তাকে সরিয়ে দেয়। সাংবাদিকরা সরে যাবার পর বেপরোয়াভাবে ছাপ্পা ভোট চলতে থাকে। নির্বাচন কমিশনের সিসি ক্যামেরায় ওয়েব কাস্টিংয়ের ক্যামেরায় সবই রেকর্ড হচ্ছিল। কিন্তু ‘অজ্ঞাত কারণে’ এনিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাদের। দিনভর এভাবে ভোট হলেও নির্বাচন কমিশনের কোনো অফিসারকেই ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাপ্পা ভোট বন্ধ করতে দেখা যায়নি।

কীভাবে শাসক দল ভোট কেন্দ্রগুলো দখল করে রিগিং চালিয়েছে তার আরেকটা উদাহরণ দিনভর দেখে গেছে মাণিক্যনগর। রাস্তার দুই পাশে দু’টি ভোট কেন্দ্র। একটি পঞ্চায়েত অফিস, অপরটি স্থানীয় স্কুল। পঞ্চায়েত অফিসের ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের লাইনের সর্বাগ্রে দাঁড়ানো শাসক দলের স্থানীয় মাতব্বর মামুন মিয়া। সকাল থেকে ওখানে দাঁড়িয়ে ‘লাইন কন্ট্রোলের’ নামে ছাপ্পা ভোটারদের ভেতরে ঢোকাতে দেখা যায় তাকে।

ধনপুর কেন্দ্রের ৫৯টি বুথের মধ্যে দুপুর ১২টার পর থেকে ছাপ্পা ভোট পড়তে থাকে ব্যাপকহারে। ১২ থেকে ১৪টি বুথ ছাড়া বাকি বুথে সিপিআই(এম)-এর পোলিং এজেন্টদের যেতে দেয়নি শাসকদলের দুর্বত্তরা। ১ নম্বর বুথে এক মহিলা পোলিং এজেন্ট ভোটিং মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে ভোটারদের শাসক দলের প্রতীকে ভোট দিতে প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ। মোদ্দা কথা উপভোটকে সম্পূর্ণভাবে প্রহসনাত্মক ভোটে পরিণত করতে কোনও কৌশলই বাকি রাখেনি শাসকদল।

১৭ আগস্ট মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত প্রশাসনকে সম্পূর্ণ বগলদাবা করে নিয়েছে বিজেপি। বক্সনগর ও ধনপুর বিধানসভা কেন্দ্রজুড়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাসের কারণে বহু সিপিআই(এম) কর্মী বাড়িঘর ছাড়া। এরমধ্যেও যে সমস্ত কর্মী এলাকায় রয়েছেন তাদের উপনির্বাচনের প্রচারে অংশ না নিতে হুমকি দেয় শাসক দল। শাসক দলের দুর্বৃত্তদের একপ্রকার ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকেই যেখানে যেখানে সম্ভব লাল ঝান্ডার প্রচার মিছিল-সভা করতে হয়েছে উপভোটে। ২ সেপ্টেম্বর মনাইপাথরে দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৈধ অনুমতি থাকা সত্ত্বেও সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকারের সভায় বাধাদানের চেষ্টা করে শাসক দল। শাসক দল বিশালগড়, বিলোনীয়া, উদয়পুর, শান্তিরবাজার, সোনামুড়া ইত্যাদি এলাকা থেকে অন্তত দুই হাজার কর্মী দুটি বিধানসভা এলাকায় জড়ো করে। একাধিক মন্ত্রী, বিধায়ক ছিলেন। সরব প্রচার শেষ হবার পর থেকে সিপিআই(এম) নেতা-কর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘরে গিয়ে ভোট দিতে না যেতে হুমকি দিয়ে আসে বিজেপি'র দুর্বৃত্তরা। সম্ভাবনাময় পোলিং এজেন্টদের বাড়ি গিয়েও হুমকি দিয়ে আসে এজেন্ট না থাকতে। ৪ সেপ্টেম্বর, সোমবার রাতে বক্সনগরের বিজেপি প্রার্থী নিজে সিপিআই(এম) অঞ্চল কমিটির সদস্য আবু জাফরের উপর ন্যক্কারজনকভাবে আক্রমণ করিয়েছেন। বক্সনগর হাসপাতালে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা হয়নি। পরে নিজেদের উদ্যোগে জিবি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন ওইদিন রাতে। সমস্ত ঘটনা সাথে সাথে সিইও, রিটার্নিং অফিসার, জেলাশাসক, পুলিশ সুপারকে জানানো হয়। তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এর থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল উপনির্বাচনের দিন কী হতে চলেছে।

৫ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সকাল ৬টার আগে থেকে জায়গায় জায়গায় বামফ্রন্টের পোলিং এজেন্টদের বুথে যেতে বাধা দেয় বিজেপি। মোহনভোগে টিওয়াইএফ নেতা জয়ন্ত দেববর্মাকে মেরে আহত করে। জিবি হাসপাতালে আনা হয় তাঁকে। পোলিং এজেন্টরা বুথে ঢোকার সময়ও অনেককে বের করে দেওয়া হয়। এর মধ্যেও ধনপুরে ১৯টি ও বক্সনগরে ১৬টি বুথে এজেন্ট দিতে সক্ষম হয় সিপিআই(এম)। এর মধ্যে বেলা বাড়ার সাথে সাথে কয়েকজনকে বের করে দেয় বিজেপি দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনাও সিইও, রিটার্নিং অফিসার, জেলাশাসক, পুলিশকে জানানো হয়। মন্ত্রী বিকাশ দেববর্মা নিজে উপস্থিত থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী এই বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনলে তাঁকে সরে যেতে অনুরোধ জানানো হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গোটা মন্ত্রীসভা মনোনয়ন জমা দেয়ার দিন থেকে দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে অবস্থান করেছে। ৬ মাস আগে বিধানসভা ভোটে ৬০ শতাংশ মানুষ বিজেপি-কে ভোট দেয়নি। বিধানসভা ভোটের পর ছয় মাসে বিজেপি জোট সরকার এমন বিরাট কিছু করেনি যাতে ভোটারদের মনোভাবে পরিবর্তন আসে। তাই দুটি কেন্দ্রে জিততে পারবে না ধরে নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। মানুষকে প্রলুব্ধ করেছেন। সরকারি কোষাগার থেকে মন্ত্রীরা লক্ষ লক্ষ টাকা বিলি করেছেন।

নির্বাচনের দিন সকাল ৭টা থেকে দুটি কেন্দ্রে দলে দলে বিজে পি’র লোকরা গিয়ে ভোটারদের ভোট দিয়েছে। বহু ভোটারকে বুথের লাইন থেকে, রাস্তা থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় জোর করে ও হুমকি দিয়ে। একটি ভিডিয়ো-তে দেখা গেছে একটি বুথে বিজেপি'র মহিলা পোলিং এজেন্ট মহিলা ভোটার বুথে ভোট দিতে ঢুকলেই তিনি নিজে উঠে এসে তাদের ভোট দিচ্ছেন। প্রশাসনের পদস্থ আধিকারিকরা পুরোপুরি শাসক দলের অঙ্গুলি হেলনে চলেছেন। তাই প্রহসনের উপনির্বাচন বাতিল করে নতুন করে জনগণের রায় নেবার দাবি উঠেছে।