E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০

স্বপ্নভঙ্গের বাংলায় আপনাকে স্বাগত

দীপ্তজিৎ দাস


দেড় মাস পর মালদহে বাড়ি ফিরছে শাহিন। ফেরার পথে সাথে রয়েছে ওর বাবাও। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পেটের টানে বাইরের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল বছর উনিশের ছেলেটা। স্বপ্ন ছিল পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করে নতুন করে সাজাবে নিজের পরিবারকে। শাহিন আসছে শুনে ওর বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তবে ঘরের ছেলে ফেরার আনন্দে নয়, ওর কফিনবন্দি দেহ শেষবার নিজেদের চোখে দেখার জন্য। মিজোরামের সাইরঙে রেল ব্রিজ নির্মাণের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে শাহিন। রেল দপ্তরের বদান্যতায় ফিরতি পথে কফিনে পচে গলে যাওয়া শাহিনের দেহই এ বাংলার তরুণ সমাজের স্বপ্নের বাস্তব পরিণতি।

গত মে মাসের এক গভীর রাত। পিঠে ব্যাগ বোঝাই বিরিয়ানি নিয়ে প্রবল গতিতে বাইক চালিয়ে মধ্যমগ্রাম উড়ালপুল পার করছে অভিজিৎ। স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরি না পেয়ে অভাবী পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গভীর রাতে ডেলিভারি বয়ের কাজ নিয়েছিল চব্বিশ বছরের ছেলেটা। রেটিং আর গতির গণ্ডিতেই যে বাঁধা ওদের জীবন। উলটো দিক থেকে প্রবল বেগে আসা গাড়ির ধাক্কায় ব্রিজের মাঝে ছিটকে পরলো ছেলেটা। লুটিয়ে পড়া ছেলেটাকে পিষে দিয়ে গেল পিছন থেকে আসা লরি। ক্ষতবিক্ষত সেই দেহই এ বাংলার আগামীর প্রত্যাশার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বুলডোজারের ধ্বংসের প্রতীক।

গড়িয়ার সদ্য ৩০ পেরোনো প্রীতম রায় ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বেঙ্গালুরুতে বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চপদস্থ কর্মী। গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্রাচুর্য্য কিছুরই অভাব নেই জীবনে। শারদোৎসবের ৫০ দিন বাকি দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় দশ বছর আগে বন্ধুদের গ্রুপের ছবি দিয়ে ছেলেটা পোস্ট করলো ‘হারানো দিনগুলো এভাবে চলে যেও না’। ওদের বন্ধুরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আনন্দের মুহূর্তগুলো একসাথে উদ্‌যাযাপনের সুযোগ পায় না ওরা। যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণাগুলোই বাংলার উঠতি প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গের সাতকাহন।

স্বপ্ন অনেক। পরিবেশ পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটের বিভিন্নতায় তার বিস্তারও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা এক। যে বাংলায় ১২বছর আগে স্লোগান উঠেছিল ‘পরিবর্তন চাই’ সেই বাংলার তরুণ সমাজ আজ এক নরক গুলজারের হাত থেকে পরিত্রাণ চাইছে। ২০১১ সালে যে দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ১০ লক্ষ চাকরির ঘোষণা, শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি তাদের আমলে গত বারো বছরে রাজ্যের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান চলে গেছে বাতিলের খাতায়। স্বাভাবিকভাবেই আগামী প্রজন্মের সামনে নেমে এসেছে নিকষ কালো আঁধার। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের ঠোঁটে বেঁধে কাটমানির পাহাড়ে চড়েছেন ভাইপো, ভোলে ব্যোমের নামে সম্পত্তির পাহাড় গড়েছেন স্কুলে না গিয়ে শিক্ষক বনে যাওয়া সুকন্যা মণ্ডলরা। আর সাধারণ ঘরের সন্তানরা প্রতিনিয়ত সাক্ষী থেকেছে বঞ্চনার। কার্যত শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানকে পঙ্গু করে রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূলের। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে যুব সমাজের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটিয়েছে তারা। স্বপ্ন মানুষকে এগোতে শেখায়,বাঁচতে শেখায়। যৌবনের স্বপ্নের উচ্ছলতায় মাতোয়ারা বাংলা হয়ে উঠতে পারত স্পন্দনের প্রতীক। সেই বাংলাই আজ রিক্ততা, নিঃস্বতার প্রতীকে পরিণত।

জীবনের প্রারম্ভ থেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে হরেক রকম রঙিন স্বপ্ন থাকে কচিকাঁচাদের। তার সাথে যুক্ত হয় নিজেদের সন্তানকে ঘিরে অভিভাবকদের প্রগাঢ় আবেগ। সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন পূরণের মাঝে প্রথম সেতুবন্ধন স্কুল। স্কুল থেকে লব্ধ শিক্ষা আত্মস্থ করে বাস্তবের মাটিতে তার প্রয়োগের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতের দিকে। সংবিধান ও আইনের বলে আমাদের দেশের প্রতিটা শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব সরকারেরই। শিক্ষাঙ্গনই সেই অদৃশ্য দড়ি যা বেয়ে ছাত্রছাত্রীরা পৌঁছে যেতে পারে স্বপ্নের শিখরে। আমাদের রাজ্যের জনগণের অর্থনৈতিক বিন্যাস অনুযায়ী অধিকাংশই নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত অংশের প্রতিনিধি। এই পরিবারগুলোর পড়ুয়ারা বিদ্যালয় শিক্ষার বিষয়ে সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল থাকে সরকারি স্কুলের প্রতি। যুগে যুগে এই স্কুলগুলোই সমাজকে উপহার দিয়েছে বিখ্যাত চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানীদের। কিন্তু অদ্ভুতভাবে গত ১২ বছরে আমাদের রাজ্যে চরম অবহেলিত বিদ্যালয় শিক্ষা। রাজ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৭হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এক বছরে মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী কমেছে চার লক্ষের বেশি। রাজ্যের ২২৬টি পড়ুয়াবিহীন স্কুল অন্যদপ্তরকে ব্যবহার করার জন্য সার্কুলার জারি করেছে রাজ্য সরকার। কার্যত এ যেন স্বপ্ন দেখার অধিকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো। রাজ্য সরকারের এহেন স্কুল শিক্ষা নিয়ে উদাসীনতার মাশুল দিয়ে আমাদের রাজ্যে ক্রমশ বেড়ে চলেছে ড্রপ আউট, শিশুশ্রম, বাল্য বিবাহের মতো অভিশাপ।

একটা গতিময় সূচনা ম্যারাথন দৌড়ে প্রতিযোগীকে কিছুটা এগিয়ে দিতে পারে।কিন্তু তার চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করে না। ঠিক তেমনভাবেই জীবনের ম্যারাথন দৌড়েও স্কুল শিক্ষার পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা। অনেক পড়ুয়ার জীবনেই স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় পদার্পণের সময়টি হয়ে দাঁড়ায় টার্নিং পয়েন্ট। এই পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন বেশি বেশি পরিকাঠামো, শিক্ষকদের সহযোগিতা। অথচ স্কুল শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাকেও ধ্বংস করতে উদ্যত তৃণমূল সরকার। রাজ্যের সম্ভ্রান্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের ৫০ শতাংশ আসন শূন্য। একই অবস্থা রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিকাঠামাগত উন্নয়নের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

রাজ্য সরকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সেন্টার অফ এক্সিলেন্স’ হওয়ার জন্য ন্যূনতম বরাদ্দ দান করতে পারে না, অথচ তারাই দুয়ারে মদ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ স্থির করে।আসলে পড়ুয়াদের স্বপ্ন ভেঙে খান খান করে তাদের বিপথে পরিচালিত করার অভিসন্ধি প্রকট হয়ে ওঠে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে। স্কুলজীবনে মেধার প্রজ্বলনের উদ্দীপ্ত অনেক আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পড়ুয়ারই ইচ্ছে থাকে পেশাগত বিষয়ে পড়াশোনার। কিন্তু সেই অনুপাতে সম্ভ্রান্ত সরকারি মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট কলেজ গড়ে ওঠেনি রাজ্যে। এই ধরনের কলেজের অধিকাংশই বেসরকারি। যার খরচ মেটানো অধিকাংশ পরিবারের সাধ্যের বাইরে।সাধ ও সাধ্যের এই বিপুল ফাঁক পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাজ্য সরকার। তবে রাজ্যে শিল্প,বাণিজ্যের ভরাডুবিতে পড়ুয়া ভরতির হার কমছে পেশাগত কোর্সেও। এবছরই রাজ্যে ৩৬০০০ ইঞ্জিনিয়ারিং আসনে ভরতি হয়েছে মাত্র ১৬০০০ এর কিছু বেশি আসন। পাশাপাশি শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের উৎপাতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিবেশ ব্যাহত হওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।পাশাপাশি ভরতি হতে গেলে দিতে হবে তাদের কাটমানি।এই কাটমানি দিতে না পেরেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করেছিল পানিহাটির যুবতী চৈতালী পাত্র। সরকার উচ্চ শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়নের বদলে ছাত্রছাত্রীদের ঋণ দিতে আগ্রহী। তাই তাদের আস্তিন থেকে বেরোয় ফাটকা চমক স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড। কিন্তু দেউলিয়া রাজ্য সরকারের আশ্বাসে এখনো পর্যন্ত অনুমোদিত হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ আবেদনকারীর আবেদন। স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের লোন না পেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে চন্দ্রকোনার ছাত্রী তিথি দলুই। এইসময় চৈতালি পাত্র, তিথি দলুইদের লাশই শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে রাজ্য সরকার দ্বারা আগামী প্রজন্মের স্বপ্নকে হত্যার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।

শিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থান নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের যুবক-যুবতীদের চাহিদাও ভিন্নধর্মী। এ রাজ্যের গ্রামীণ অঞ্চলের এক বিশাল অংশের ছাত্র-ছাত্রী পরিবারের চাপে ও আর্থিক অনটনের কারণে চায় দ্রুত উপার্জনে অংশগ্রহণ করতে। সেক্ষেত্রে নিজের গ্রামই হয়ে থাকে তাদের কর্মক্ষেত্রের অভিলাষ। নিজ অঞ্চলে পারিবারিক কাজ,ব্যবসার মাধ্যমে এক স্থিতিশীল জীবনই তাদের বাস্তবের কষাঘাতে সংকুচিত হওয়া স্বপ্ন। গ্রামীণ বাংলার অর্থনীতি আজও কৃষি নির্ভর।কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিনিয়ত কৃষিক্ষেত্র অবহেলিত। যে রাজ্য একসময় ফসল উৎপাদনে সামনের সারিতে থাকতো, সেখানেই এখন রেকর্ড সংখ্যায় কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা। কৃষিতে এই আঘাত গ্রামবাংলায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক সংকোচন ঘটিয়েছে। করোনা অতিমারীর পরবর্তী সময়ে আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি গ্রামীণ বাংলার অর্থনীতি। ফলত গ্রামে ব্যবসায় এখন ভাটার টান। গ্রামবাংলায় তরুণ সমাজের এক বৃহৎ অংশ নিজ এলাকায় ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু তৃণমূলের মাতব্বরদের চুরি, জোচ্চুরির ফলে এরাজ্যে কুড়ি মাসের বেশি সময় বন্ধ ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বন্ধ হলেও জব কার্ড ছাঁটাই চালু একই রকম। আরএসএসের বাধ্য ছাত্রীর মতোই মাননীয়ার সরকার গত চার মাসে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ জব কার্ড ছাঁটাই করেছে। পরিনামে ভিন্‌ রাজ্যে গিয়ে জীবন হারানোই হয়ে দাঁড়াচ্ছে শাহিনদের একমাত্র পথ। রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের সন্ধান মেলে পরিযায়ী রূপে করোনা অতিমারী এলে, বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনা হলে, হরিয়ানার নুহুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় 'খেলা হবে' প্রকল্প অথচ খেলা শুরুর আগেই ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য তরতাজা প্রাণ। ১০০ দিনের কাজ না পেয়ে বোমার কারখানাই তাদের গন্তব্যস্থল। পরিণতিতে এক বছরেই পাঁচটি বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় ২৫ জনের মৃত্যু। দত্তপুকুর, এগরায় বোমা কারখানায় বিস্ফোরণে ঝলসানো যৌবনের প্রতিনিধিরা যেন তীব্র আর্তনাদে বলতে চায় আমরাও স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম।

পেশাগত নিশ্চয়তা এবং সামাজিক সম্মানের জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চাকরির জন্য উদগ্রীব থাকে বহুল অংশের ছাত্রছাত্রী। সমস্ত ধরনের অর্থনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রীরাই নিজেদের যোগ্যতার মাধ্যমে রাজ্যের সরকারি দপ্তরগুলিতে চাকরি করেছে দীর্ঘদিন। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এটাই ছিল কর্মসংস্থানের সবথেকে বড় চ্যানেল। উপার্জনের স্থিতিশীলতা ও কর্মক্ষেত্রের অনুকূল পরিবেশ স্বাচ্ছন্দ্য দেয় মানব জীবনে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে স্বচ্ছভাবে সরকারি চাকরি প্রাপ্তি এক প্রকার দুর্লভ জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে গত ১২বছরে আমাদের রাজ্যে।প্রতিটি সরকারি নিয়োগকে কেন্দ্র করে উঠেছে দুর্নীতির প্রশ্ন। যে শিক্ষকরা আগামীর নাগরিক গড়ে তোলেন সেই শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সর্ববৃহৎ দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে। আমাদের রাজ্যে শাসক দলের আপাদমস্তক সমস্ত টায়ারের নেতা কর্মীরা জড়িয়ে গেছেন এই দুর্নীতি সিন্ডিকেটে। রোদ, বৃষ্টি, শৈত্য উপেক্ষা করে দু’বছরের বেশি সময় রাজপথে বসে ন্যায্য চাকরিপ্রার্থীরা। আত্মহত্যার হুশিয়ারি আসছে, নিজেদের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখছেন, প্রশাসনকে উলঙ্গ করতে নিজের গায়ে কালি মাখছেন এই রাজ্যের যৌবনের প্রতিনিধিরা। কিন্তু হুশ ফিরছে না রাজ্য সরকারের। পাশাপাশি একই সময় শাসক দল পরিচালিত বিভিন্ন পৌরসভাগুলির বিভিন্ন দপ্তরের চাকরিকে কেন্দ্র করে হয়েছে নজিরবিহীন দুর্নীতি।সেই দুর্নীতি যেন এর রাজ্যের যৌবনের প্রতি রাজ্য সরকারের প্রতারণার হলফনামা।উচ্চশিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়েও প্রবঞ্চনার শিকার এই অংশের প্রতিনিধিরাই আজ ছুটে বেড়ায নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে। অভিধানে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট নামক শব্দ। চাকরির বদলে তাদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে উড়ে আসে চপ ভাজা চায়ের দোকানের মাধ্যমে বিলিয়নিয়ার হওয়ার গল্প।এই শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিদেরই শাসকদলের মাফিয়ারা প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ব্যবহার করতে চান তাদের হয়ে তোলাবাজির কাজে।২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এমনই এক চাকরির আশায় তৃণমূলের নেতার শরণাপন্ন হওয়া ছাত্রকে তারা পাঠিয়েছিলেন ভোট লুটের কাজ। সাধারণ মানুষের গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় সেই ছাত্রের। এভাবেই আজ রাজ্যের যৌবনের স্বপ্নের কবরখানা নির্মাণে নেমেছে শাসকদল।

প্রতিটি মেধার বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাই সরকারের কর্তব্য। সেই আনুকূল্যেই মেধার বলে বলীয়ান ছাত্র-ছাত্রীরা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে অর্থবলকে সহায় সম্বলহীন ঘরের ছেলেমেয়েরাও। দেখাতে পারে গগনচুম্বী স্পর্ধা। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার ছেলে মেয়েরা মেধার ক্ষেত্রে গোটা ভারতের মধ্যে অগ্রণী স্থানে থেকেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার পূরণের মাধ্যমে তথাকথিত সামনের সারির পড়ুয়াদের অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা থাকে পেশাগত ক্ষেত্রে উৎকর্ষ ছোঁয়ার। কিন্তু বর্তমানে বাংলার মাটিতে মেধার প্রকৃত কদর নেই। যে বাংলার সেক্টর ফাইভ,রাজারহাটের আইটি হাব এক সময় ছিল দেশ-বিদেশের বহুজাতিক সংস্থাগুলির ডেস্টিনেশন,সেই বাংলায় এখন নিস্পন্দ নিস্তব্ধতা। নতুন শিল্প বিনিয়োগ হয়নি, আসেনি নামজাদা কোন সংস্থা। এযাবতকালে বরং পরিকাঠামোর অবনমন, রাজ্যের আর্থিক সংকট এবং শাসক দলের তোলাবাজদের দাপটে গুটিয়েছে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব বাংলার অর্থনীতিকে দিতে পারত নতুন প্লাবন তাদের প্রস্থান আজ এ রাজ্যের অর্থনীতিকে নিয়ে গেছে খাঁদের কিনারে। আইটি সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বড়ো কলকারখানার পরিবর্তে বাংলা জুড়ে বেড়েছে সিন্ডিকেট, মাফিয়ারাজ।তাই পেশাগত ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেধাবীরাও আজ নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কোম্পানির কাজে অথবা নিজস্ব স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠা করতে পাড়ি দিচ্ছে দেশের অন্যপ্রান্তে। রঙিন স্বপ্ন যতই বৈভব বয়ে আনুক নাড়ির টান ছাড়া তা সর্বদাই ফ্যাকাসে।

আসলে নবীন প্রজন্ম চায় একটা ছবির মতো সমাজ। সেই ছবি চিত্রকর, ক্যানভাস, রং, তুলির প্রভেদে আলাদা। কিন্তু নিজ মনে সে ছবি সর্বোত্তম।যুবশক্তি যেকোনো সমাজের ধারক এবং বাহক। তাদের প্রাণোচ্ছলতাকে নির্দেশ করেই লেনিন বলেছিলেন "Give me Just one generation of youth,I will transform the whole world." যুগে যুগে তারুণ্যের ঘোড়াদের হাত ধরেই এসেছে ঝড়ের বার্তা।কিন্তু তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সমাজের আগামীকে আলোকিত করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত শিক্ষা, তাদের কর্ম চঞ্চল রাখতে প্রয়োজন কর্মসংস্থানের হদিস। নিজ জীবন ময়দানে সমৃদ্ধ সেই নাগরিকই নতুন দিগন্তের সন্ধান দিতে পারে সমাজকে।সমস্ত জীর্ণ ব্যভিচারকে ভেঙে তারাই গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ সমাজ। মূল্যবোধ, মানবিকতাবোধ, বিবেক বোধের সঞ্চার করে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিভাজনের মাটিতে বয়ে আনে সম্প্রীতি,একতার বাতাস। তারা চায় এই পৃথিবীটাকে আরো সুন্দর করে গড়তে।সমাজের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, নৈতিকতা রক্ষা তাদের হাতেই। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের রাজ্যের শাসকদলের হাত ধরে আরএসএস’র ইন্ধনে প্রতিনিয়ত সমাজের বুকে যে অসহিষ্ণুতা-বিদ্বেষ-বিভাজন প্রশ্রয় পেয়ে চলেছে, তার প্রভাব পড়ছে যুবসমাজের মধ্যে। সমাজের প্রত্যেকটা স্তরের মানুষের কণ্ঠ রোধ বাধা দিচ্ছে ভবিষ্যতের শিরদাঁড়ার ঋজুতা প্রতিষ্ঠায়। বিপথে পরিচালিত হচ্ছে একটা গোটা প্রজন্ম। তাদের মধ্যে বাসা বাঁধছে স্বার্থপরতা, উগ্রতা, হিংস্রতা। সেই সুযোগে শাসক দল তাদের ব্যবহার করতে চাইছে মাফিয়ারাজ, বাইক বাহিনী, সিন্ডিকেটরাজের স্বার্থসিদ্ধিতে।

স্বপ্নভঙ্গেরই যন্ত্রণার মাঝেই মনে রাখতে হবে আমাদের রাজ্যের স্বপ্নোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা। বাংলাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। তরুণ প্রজন্মের দাবি আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করে জোর দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা,কর্মসংস্থান প্রকল্পে। রাজ্যজুড়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য স্কুল। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৪ বছরে আড়াই লক্ষ থেকে বের হয়েছিল সাড়ে দশ লক্ষ। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নকে সুগম করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০টির বেশি ডিগ্রি কলেজ, ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে নজর দেওয়া হয়েছিল কৃষির উন্নতিতে। পরবর্তী সময়ে ১০০ দিনের কাজ ছিল গ্রামীণ কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র। গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতাবস্থা জোয়ার আনল সারা রাজ্যের অর্থনীতিতেই। ক্ষুদ্র, কুটির শিল্পে এগিয়ে গেল বাংলা।কেবল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ক্ষুদ্র শিল্পে কর্মসংস্থান হল ৫৫ লক্ষের বেশি। পরবর্তীতে নজর দেওয়া হলো বৃহৎ শিল্প গড়ায়। গড়ে উঠেছিল বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস। সল্টলেকে গড়ে উঠল সেক্টর ফাইভ। পাশেই নিউটাউনে গড়ে উঠলো আইটি হাব। রাজ্যে এল টিসিএস, কগনিজেন্ট, উইপ্রোর মতন সংস্থা। আসার ইচ্ছা প্রকাশ করল ইনফোসিস। ড্রপআউট, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ নামক অভিশাপগুলো উপড়ে ফেলা হলো সমাজের বুক থেকে।পরিযায়ী হয়ে যাওয়া অথবা এগিয়ে থাকা সংস্থায় চাকরির জন্য দেশান্তরী হওয়া নয়, এ বাংলার ছাত্র যৌবন নিজেদের স্বপ্নে জীবন রঙিন করতে পেরেছিল এই মাটিতেই।

স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরণের মাঝের পথ তীব্র গতিতে অতিক্রম করাই জীবনের গন্তব্য।সরকারি ষড়যন্ত্রে যখন স্বপ্ন দেখতে ভুলছে একটা প্রজন্ম,তখন তাদের খোয়াবনামা লেখার কাজ বামপন্থীদেরই।স্বপ্ন দেখার অধিকারকে আমরা হারিয়ে যেতে দেব না।সকলের শিক্ষার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গিয়েই রাস্তায় প্রাণ দিয়েছে আমাদের সাথি সুদীপ্ত গুপ্ত। সকলের কাজের দাবিতে আন্দোলনে নেমে নিজের জীবন দিয়েছে মইদুল ইসলাম মিদ্যা। তবু আমরা হার মানিনি। নতুন প্রজন্মের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে দায়বদ্ধ আমরা। তাই প্রতিটা স্বপ্নের অপমৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তা জুড়ে লেখা হচ্ছে প্রতিরোধের বর্ণমালা।আন্দোলনের ব্যারিকেডে প্রতিহত হচ্ছে অত্যাচারী আঘাত। তরুণ সমাজের কাছে পৃথিবীকে সুন্দরতর করে তোলাই আমাদের অঙ্গীকার। যৌবনের জীবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশ নির্মাণই আমাদের লক্ষ্য। আগামীর লড়াইয়ে ওদের ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে করে এই বাংলার দৃপ্ত যৌবনই সোচ্চারে আওয়াজ তুলবে আমরা সবাই এই আকালেও স্বপ্ন দেখি!