৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০
এক দেশ - এক ভোট
গণতন্ত্র গুঁড়িয়ে দেবার বুলডোজার
দেবাশিস চক্রবর্তী
‘এক দেশ-এক ভোট’ বিজেপি’র অনেকদিনের স্লোগান। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের ইশ্তেহার, ২০১৯-র সংকল্প পত্রে এই প্রসঙ্গ ছিল। প্রধানমন্ত্রী হবার পরে বারংবার নরেন্দ্র মোদি এই প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন। ২০১৭-তে নীতি আয়োগ একটি খসড়াও তৈরি করেছিল। ২০১৮ সালে ল’ কমিশন রাজনৈতিক দলগুলির মতামত চেয়েছিল। বেশিরভাগ দলই এর বিরোধিতা করে। সিপিআই(এম) লিখিতভাবেই ব্যাখ্যা করে কেন তারা এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে। এই সবক’টি প্রস্তাবেই রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ ছাঁটাই করে লোকসভার সঙ্গে একসঙ্গে ভোট করার প্রস্তাব ছিল।
এবারের উদ্যোগ আরো গুরুতর। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তারা এই ব্যাপারে বিবেচনা করে সুপারিশ করবে। কমিটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বেশির ভাগ সদস্যই বিজেপি-ঘনিষ্ঠ। কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরীকে কিছু না জানিয়েই কমিটিতে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। রাত ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সচিব তাঁকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন। অধীর চৌধুরী ওই কমিটিতে থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। একসঙ্গেই লোকসভা ও সব রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন করাতে হলে সংবিধানের বহু ধারা সংশোধন করা ছাড়াও আইনি জটিলতা রয়েছে। সুতরাং এই সেপ্টেম্বরেই হঠাৎ ডাকা সংসদ অধিবেশনে তা পাস করিয়ে নেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কেন্দ্রের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
এটা ঠিক যে ১৯৬৭ পর্যন্ত লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন একই সময়ে হয়েছে। কিন্তু তারপরে আর হয়নি। হয়নি কেন? দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলে গেছে বলে। ১৯৬৭’র নির্বাচনেই ৯ রাজ্যে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের অবসান ঘটে যায়। তারপর থেকে রাজ্যগুলিতে বিধানসভার স্থায়িত্ব, সরকারের আসা-চলে যাওয়া পৃথক হয়ে যায়। একসঙ্গে একই দিনে সারা দেশে লোকসভা, বিধানসভা ভোট করার আর কোনো বাস্তবতাই থাকে না।
সংবিধান কী বলছে? লোকসভা বা বিধানসভা পাঁচ বছর চলবে ‘যদি না তার আগেই তা ভেঙে দেওয়া হয়’। অর্থাৎ কোনো আইনসভার স্থায়ী মেয়াদ নেই। এই প্রশ্নটি গণতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। কোনো রাজ্য বিধানসভায় রাজনৈতিক পালাবদল বা অনাস্থা ভোটে সরকার পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা থাকে। এমন হতে পারে যে বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হলো, নতুন করে নির্বাচন করতে হতে পারে। লোকসভাতেও অনাস্থা প্রস্তাব আনার অধিকার রয়েছে বিরোধীদের, অর্থ বিল পাস করাতে না পারলেও সরকারের পরাজয় হয়। এক ভোটের তত্ত্বে তা বাতিল হয়ে যাবে। লোকসভায় বা বিধানসভায় গরিষ্ঠতা হারানো সরকার এবং বিধানসভাকে কি পরবর্তী একসঙ্গে ভোটের জন্য টিকিয়ে রাখা হবে? তা একেবারেই গণতন্ত্র বিরোধী হবে।
ধরা যাক, এখনই এই নীতি চালু হলো। তাহলে দেশের সব বিধানসভার ভোট ২০২৪ সালে করতে হবে, লোকসভা ভোটের সঙ্গে। তা কী করে সম্ভব? ২০২১, ২০২২, ২০২৩-এ যে-সব রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়েছে তাদের পাঁচ বছর পরে ভোট হবার কথা। সব বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হবে? এই অধিকার কি কেন্দ্রকে দেওয়া রয়েছে নাকি দেওয়া যায়? অন্যদিকে, যদি ২০২৪-র পরে পরবর্তী লোকসভা অর্থাৎ নির্ধারিত ২০২৯ পর্যন্ত সব বিধানসভার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তা সংবিধান ও গণতন্ত্র বিরোধী। পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী বিধানসভার ভোট হবে ২০২৬-এ, এর পরেও আরো তিন বছর এই বিধানসভাই চলতে থাকবে তার কোনো বৈধতা থাকতে পারে না। আইনসভার কাছে সরকারের দায়বদ্ধতাও বিঘ্নিত হয়ে যায়, সংসদীয় রাজনীতির যা মূল কথা। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের ওপরে, রাজ্য বিধানসভার ওপরে নিজের অভিমত চাপিয়ে দিতে পারে না। এটি সম্পূর্ণতই সংবিধান বিরোধী।
একসঙ্গে ভোটের তত্ত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোর মূল স্তম্ভই হলো তা যুক্তরাষ্ট্র। সংবিধানের একেবারে প্রথম ধারাতেই বলা রয়েছে, ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত ইজ এ ইউনিয়ন অফ স্টেটস’। রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্র হিসাবেই ভারতের রাজনৈতিক ও শাসন কাঠামো। একেক রাজ্যে মানুষের কাছে একেক প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তামিলনাডুর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রশ্ন যা, পশ্চিমবঙ্গেও কি তা? নির্বাচনের সময়ে রাজ্যের ইস্যু সামনে আসবে না? তা নিয়ে ভোট হবে না? সারা দেশে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট হলে এই রাজ্যভিত্তিক প্রশ্ন যথেষ্ট গুরুত্ব হারাতে পারে। বস্তুত, বিজেপি তা-ই চাইছে। রাজ্যের এবং রাজ্যে বাস করা বিভিন্ন অংশের জনসমষ্টির অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রশ্নগুলিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে উত্থাপিত ইস্যুকে সামনে রেখে ভোট করানোই তাদের লক্ষ্য। ইতিমধ্যেই বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয়ভাবে তারা সামনে আনতে চায় সাময়িক আবেগ-জড়ানো কোনো বিষয়কে। তা পুলওয়ামার মতো রহস্যজনক ঘটনাও হতে পারে বা হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের কোনো প্রশ্ন। যাতে জনগণের জীবনজীবিকার প্রকৃত প্রশ্ন ধামাচাপা পড়ে।
এখানেই বিজেপি থেমে থাকবে না। নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে যে এক অবিসংবাদিত নেতার মতাদর্শ তারা চাপিয়ে দিতে চাইছে সেখানে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক বা রাষ্ট্রপতি-প্রধান শাসন ব্যবস্থার দিকে তারা যেতে চাইবে। একনায়কতন্ত্র প্রসারে তা সহায়ক হবে। ইতিমধ্যেই সংসদের অধিকার ছাঁটাই করা হয়েছে, সেখানে বিরোধীদের আলোচনা বা প্রশ্ন তোলার অধিকার ক্রমশ খর্ব করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংসদে আসেন না, প্রমাণ করতে চান তিনি সংসদের ঊর্ধ্বে। সরকারপক্ষ দিনের পর দিন সংসদ অধিবেশন ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। মণিপুরের মতো জ্বলন্ত বিষয় সংসদে আলোচনা করতে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনার পথ নিতে হলো। ভারত গণতন্ত্রের মাতা বলে প্রচার করে আসলে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকেই প্রাণহীন করে তুলতে চাইছে বিজেপি। একসঙ্গে ভোটের তত্ত্ব এরই এক নতুন সংযোজন হবে।
এমনিতেই রাজ্যগুলির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। রাজ্য বা যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বহু বিষয়ে একতরফা পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। জাতীয় শিক্ষা নীতি তার নতুন একটি উদাহরণ। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণও হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে। রাজ্যপাল পদকে রাজ্য সরকারগুলিকে হেনস্তা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। একসঙ্গে ভোটের তত্ত্বে রাজ্যপালের হাতে প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে। এর সঙ্গে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারণও কেন্দ্রের ইচ্ছায় হয়, তাহলে রাজ্যগুলির ওপরে বুলডোজার চালানো হবে।
সওয়াল করা হচ্ছে, বারবার ভোট হলে প্রচুর খরচ হয়। গভীরভাবে না ভেবে অনেকের কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মজার কথা হলো, যে বিজেপি এই যুক্তি দিচ্ছে তারাই নির্বাচনী বন্ড চালু করেছে। যেখানে করপোরেট বন্ড কিনে বিশেষ রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিচ্ছে। কোন করপোরেট বন্ড কিনলো, কারা পেল তা গোপন। নির্বাচনে অর্থব্যয়ের এমন দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তারা নিজেরা কমপক্ষে ৩২০০ কোটি টাকা এই বন্ড থেকে তুলেছে। এর পরেই আছে তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিআই(এম) প্রথম থেকেই জানিয়ে দিয়েছে, এই বন্ডে তারা কোনো টাকা নেবে না। বিজেপি সারা দেশে নির্বাচনে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রচার করে। তাদের মুখে ‘খরচ কমানোর’ যুক্তি যে ধূর্ততা, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ভূতের মুখে রাম নাম। নির্বাচনী ব্যয়ের ঊর্ধ্বসীমা স্থির করে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দাবিই হলো যুক্তিসঙ্গত।
আরেকটি যুক্তি দেখানো হচ্ছে, নির্বাচনের সময়ে বেশ কিছুদিন আচরণবিধি চালু থাকে, তাই সরকারগুলি ‘উন্নয়নের কাজ’ করতে পারে না। দেশের জনগণের অভিজ্ঞতা কী? সারা বছর সরকার উন্নয়নের কাজ করছে? উলটে নির্বাচনের প্রাক্কালেই যাবতীয় কাজের গতি বাড়ে। জনগণের জন্য দরদ উথলে উঠছে শুধু আলাদা ভোটের সময়েই!
এক দেশ-এক ভোটের বিধি চালু করতে হলে সংবিধানকে এক কথায় দুমড়ে-মুচড়ে দিতে হবে। সংশোধন করতে হবে ৮৩, ৮৫, ১৭২, ১৭৪, ৩৫৬ নম্বর ধারা। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনও বদলাতে হবে।
আরএসএস-বিজেপি এক দেশ-এক ভোটের কথাই শুধু বলছে না, তথাকথিত অভিন্নতার নামে দেশের বৈচিত্র্যের ধারণাকেই ধ্বংস করতে চাইছে। এটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গঠনের পথে এক পদক্ষেপ।