৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০
হিন্দুত্ব ও নারী
মন্দিরা ঘোষাল
হিন্দুত্ব ধারণাটা এদেশে নতুন। হিন্দু নামে ধর্মসম্প্রদায় চিরকালই এদেশে বসবাস করে আসছে। সেভাবে বর্ণনা করলে ভারতের একটা বিরাট অংশের মানুষ দেবদেবীতে বিশ্বাস করেন, তাঁদের নিজস্ব প্রথামতে দৈনন্দিন উপাসনা, ধর্মাচরণ করেন। আমাদের এই বাংলায় সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয়, ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজা হয়, এমনকী মন্দিরে মন্দিরে শিবের পুজো, কালি পুজোও হয়। তেত্রিশ কোটি দেবতা আমাদের - যে যেমন পারে, পুজো করে। এসব কিন্তু হিন্দুত্ব নয়। হিন্দুত্ব একটা ভয়ানক ‘বিশুদ্ধ’ ব্যাপার। বাংলায় আরএসএস-বিজেপি’র প্রতিষ্ঠার পর থেকে তার চেহারা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। মাছ-মাংস বয়কট করা কিছু তিলকধারী গেরুয়া উত্তরীয় গলায় অথবা মাথায় বেঁধে অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে ডিজে বাজিয়ে ‘জয় বজরংবলী’ বা ‘হরহর মহাদেও’ নামে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। আমরা বুঝছি, এটাই হিন্দুত্বের আদত চেহারা।
এতদিন ইতিহাসের প্রমাণ থেকে জানতাম সিন্ধু উপত্যকায় বসবাসকারী এক সমৃদ্ধ সভ্যতার স্রষ্টা মানুষকে হিন্দু বলা হতো। হিন্দু আদতে কোনো ধর্ম নয়, বহু দেবতার উপাসক সম্প্রদায়ের মিলনস্থল। মানুষ যখন খাদ্য আহরণ থেকে কিছুটা অবসর পেয়েছে, তখনই সে খুঁজেছে প্রকৃতির রহস্য, খুঁজেছে আমি কে। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে সে সমাজকেও বাঁধতে চেয়েছে শৃঙ্খলায়। এর থেকেই যুগে যুগে ধর্ম সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী কার্যক্রমের সূচনা। আর সভ্যতার আদিযুগ থেকেই সৃজনের সূত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত হয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতি তুল্যমূল্য গুরুত্ব পেয়েছে সমাজ-সৃজনে। সে অর্থে ধরতে গেলে মানব-সৃজন ধারণ ও লালনের বিশেষ যোগ্যতার কারণে আদিম মানব সমাজে নারীর গুরুত্ব ছিল পুরুষের চেয়ে বেশি। ধর্মীয় সাহিত্য তথা বেদ-পুরাণে তার প্রভাবেও উল্লেখ লক্ষ করা গেছে অনিবার্যভাবে। ঋগ্বেদের দেবী সূক্তে বলা হচ্ছে, শক্তি বা নারীই হচ্ছে সকল শক্তির উৎস, তাতেই সকল শক্তির উৎস এবং বিলয়, তিনি ধারণ করেন এবং লালন করেন পৃথিবীকে, তিনি সকল শক্তির আঁধার, ত্রিগুণাত্মিকা সত্ব, রজ, তমঃ সব গুণের প্রকাশ তারই মধ্যে ইত্যাদি।
কিন্তু আরএসএস-এর ধারণা একেবারে অন্যরকম। তাদের নেতা, তাদের দর্শনপ্রণেতা ডঃ হেডগেওয়ার আর গোলওয়ালকর যা বলে গেছেন, এই হিন্দুধর্মের থেকে পছন্দ টুকরো টাকরা আহরণ করে তাই তাদের কাছে প্রকৃত হিন্দুত্ব। আর সেই হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রসারে তারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে নেমে পড়েছে। এই হিন্দুত্বের প্রকৃত লক্ষ্য হলো - এই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলে হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সেইলক্ষ্যেই এক ধর্ম, এক ভাষা, এক রীতিনীতি প্রচলনের মরিয়া চেষ্টা। আর সেই হিন্দুত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা এই সমাজে নারীর অবস্থানকে নির্দিষ্ট করতে চাইছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা তাদের মতো করে হিন্দুত্বের ধারণা অনুযায়ী নারীসমাজের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, তা নিয়ে আলোচনা করছে, তা নিয়ে হঠাৎ আমাদের মাথাব্যথা কীসের? দেশটা তো গণতান্ত্রিক, ওরা ওদের মতো ভাবুক, সিপিআই(এম) তার নিজের মতো করে ভাবুক, বলুক। বিষয়টা এই অবধি থাকতেই পারত। বলা ভালো আরএসএস-এর এই ভাবনার প্রভাব সারা ভারতের নানা প্রান্তে থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গে তার প্রভাব স্পষ্টতই দৃশ্যমান ছিল না বলেই এই বিষয়গুলি নিয়ে তেমন আলোচনা বা বিরোধী ভাবনা সর্বত্র স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়নি।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদান্যতায় বিজেপি আর তার পরিচালনশক্তি আরএসএস এখানেও তাদের প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। তাই এই মুহূর্তে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ আর তাকে প্রতিরোধ করার মতো জরুরি কাজের দায়টা পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশের সাথে প্রগতিশীল অগ্রগামী নারীসমাজের ওপর এসে পড়েছে। সেটা কেবল এরাজ্যেই নয়, দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে যে পিছিয়ে-পড়া, কূপমণ্ডুক দর্শনের বোঝা চাপিয়ে দেশের মেয়েদের পঙ্গু করে করপোরেট-লালিত ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি আর রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের দেশে কায়েম করতে চাইছে, তার বিপরীতে নারীসমাজের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের অগ্রবর্তী বাহিনী হিসাবে কাজ করা আমাদের বাংলার মানুষের দেশপ্রেমিক দায়ও বটে। একটা দেশ, একটা জাতি কীভাবে অগ্রসর হতে চায়, তার অনেকটা প্রতিফলন দেখা যায় নারীর অবস্থান সম্পর্কে সে কী ভাবছে তার মধ্য দিয়ে। এটা সমাজতাত্ত্বিকদের কথা। আরএসএস মানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। অর্থাৎ তাদের সাংগঠনিক ভাবনার মূল কথা নিজেদের মতো রাষ্ট্র গঠন এবং তার স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ওঠা। শর্ত স্পষ্টত দুটো - ১৮ বৎসরের ঊর্ধ্বে পুরুষ, যিনি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সংঘের প্রতি নিঃশর্ত স্বেচ্ছাসেবায় দায়বদ্ধ থাকবেন। স্পষ্টতই উল্লেখ করা আছে, নারী নয়, কেবলমাত্র পুরুষেরাই এই স্বেচ্ছাব্রতে অংশ নিতে পারবে। কেন নারী নয়, এ প্রশ্ন হিন্দুত্ব-অনুরাগীদের পক্ষ থেকে বারবার উঠেছে। নেতারা, সরসঙ্ঘচালকরা বারবার একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, নারী ও পুরুষ কখনো সমকক্ষ হয়ে একাসনে বসতে পারেন না। এক্ষেত্রে তারা মনুস্মৃতির সেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন - নারী বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। হিন্দুত্ব বলতে আরএসএস এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে। অতএব যে নারী দ্বিতীয়শ্রেণির নাগরিক, যে কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারীই নয়, সে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার অধিকার পাবে কোথা থেকে? আর তাছাড়া সমাজে নারীর কাজ তো তাঁরা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, গার্হস্থ্যের যাবতীয় দায়িত্ব পালন, গর্ভধারণ এবং সংস্কারী সন্তান পালন। সংস্কার বলতে তারা মনুস্মৃতি, রামচরিতমানস ইত্যাদি থেকে যে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের ধারণা ঐতিহ্যের নামে চালু করতে চান তার কথাই বোঝানো হয়েছে। সেই সংস্কারে গৃহই নারীর গণ্ডি, পরিবারে ও সমাজে নিঃশর্তে পুরুষের অনুগামী হওয়াটাই নারীর কাজ। অতএব সরসংঘচালকদের মতে শিক্ষার থেকে গর্ভসংস্কার জরুরি, বৌ পেটানো অপরাধ নয়, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, ব্রাহ্মণের দলিত নারীকে ভোগ করা, সন্তান উৎপাদন সমাজের উন্নয়নের স্বার্থে। আর এত গার্হস্থ্য পালনের শেষে তাঁরা শাখার কাজে অংশগ্রহণের সময় পাবেন কোথায়? অতএব আরএসএস-এ নারী প্রবেশ নিষেধ। মন্ত্রী, নেতা সুষমা স্বরাজ, নির্মলা সীতারামন হতেই পারেন। কিন্তু আরএসএস সদস্য নৈব নৈব চ। নাজি জার্মানির হিটলারের ভাবনার সঙ্গে কী অপূর্ব মিল!
মেকি হিন্দুধর্মের নামে এই হিন্দুত্ব হলো এক বিশুদ্ধ ঘৃণার দর্শন। যে দর্শনের মূল শত্রু - কমিউনিস্ট মুসলমান আর খ্রিস্টানরা। তাই সংঘ পরিবারে নারীর অবস্থান স্বাধীন চিন্তার বিপরীতে পুরুষের, সংঘের পশ্চাৎমুখী ভাবনা অন্ধ অনুগামী হয়ে বেঁচে থাকার। পঞ্চাশ বছরের আলোচনার পর আরএসএস-এ তাদের প্রবেশাধিকার মেলে না। তাদের জন্য তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় সেবিকা সংঘ। স্বয়ং শব্দটা সেখানে স্পষ্টতই অনুপস্থিত। কারণ হিন্দুত্বের দর্শনে নারীর নিজস্ব ভাবনা বা অস্তিত্বের কথা ভাবাই অপরাধ! এই হিন্দুত্বের দর্শন মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শন। মুষ্টিমেয় মানুষের গোটা সমাজটাকে পায়ের তলায় রাখার দর্শন। এরা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার জন্য ডারউইনকে বাদ দেয় পাঠক্রম থেকে। ইতিহাস থেকে বাদ দেয় মুঘল। সাহিত্য থেকে বাদ দেয় রবীন্দ্র-নজরুলকে। আর তারই সঙ্গে সামাজিক সংস্কারের নামে মেয়েদের করতে চায় অন্ধ, বধির, তাঁর মস্তিষ্কে গন্ডি কেটে গৃহের শাসনে বেঁধে ফেলতে চায়। আসলে গোটা চাহিদাটাই অর্থনৈতিক। পৃথিবীর দেশে দেশে যখনই বুর্জোয়া অর্থনীতির সংকট তীব্র হয়েছে, বেড়েছে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদনহীনতা, যখন এইসব সংকটের থেকে উত্তরণের পথ রাষ্ট্রশাসনের শীর্ষে থাকা কতিপয় পুঁজিপতি-লালিত সরকারের অধরা, তখনই তারা ঐতিহ্যের নামে পুনরুত্থানবাদী মেকি ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। সেটা নাজি জার্মানির হিটলার হোক বা ভারতের বিকাশ পুরুষ নামধারী নরেন্দ্র মোদি। কারণ এটাই একমাত্র দর্শন, যেখানে সব অতীতের গল্পে-গাঁথা গৌরব আছে। বর্তমান কেন’র কোনো উত্তর নেই, আছে আত্মসমর্পণ আর ভবিষ্যতের জন্য অনন্ত অপেক্ষা। আছে পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়ার বাধ্যতা। আর এই ভাবনা- ঘৃণার দর্শন, ব্যক্তিত্বের অবনমন - এই দর্শনেই আছে যে, মানুষ প্রতিবাদ করতে চায়। সংঘবদ্ধ হতে পারলে, পালটে দিতে পারে দুনিয়ার দিগ্দর্শন। যে মানুষের হাতে আছে সমাজ বদলের চাবিকাঠি - সেই আন্দোলন, সংগঠন সমাজকে বিভাজিত করার কৃৎকৌশল। তাই এই ভেদবুদ্ধির অধর্মের শক্তির আর তর সইছে না। ভাবনার জগৎকে অধিকার করে ধর্মের নামে মানুষকে আলাদা রেখে দেশের জল, মাটি, আকাশ সব বিক্রি করে দেশি-বিদেশি করপোরেট লালিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে অনেকদিনের জন্য। এই হিন্দুত্ব সেই হিন্দুধর্মের ধর্মাচরণ নয়, যাতে সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয়, হোলির মিলনোৎসবে মাতে সকলে, সত্যপীরের সিন্নি চড়ে আর তুলসীতলায় সকলের মঙ্গলকামনায় জলে সন্ধ্যাবাতি, ছড়িয়ে পড়ে হরিলুটের বাতাসা সর্বজনে। এই হিন্দুত্ব ঘৃণার ধর্ম, বিচ্ছেদের ধর্ম, ধ্বংসের ধর্ম - আদতে অধর্মের চাষ। করপোরেট পুঁজি-লালিত মিডিয়া এই ‘হিন্দুত্ব’ আমাদের গিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিদিন। মিছিল-মিটিং-এর ভাষা তো রইলোই, আমাদের ভাবতে হবে আর কোন্ সংস্কৃতির ভাষার, আর কোন্ ভাবনার পরিসরে কেমন করে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব প্রতিদিন। কারণ এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই। এ আমাদের যুগসঞ্চিত ভাবনার অহঙ্কারকে বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার।