E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২১ ভাদ্র, ১৪৩০

হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ

সোমনাথ ভট্টাচার্য


প্রায় চার হাজার বছরের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত ধর্ম হলো হিন্দু ধর্ম। সাধারণত এভাবেই আমরা জানি। যদিও কথাটা পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। হিন্দু ধর্মের আদি নাম ছিল বৈদিক ধর্ম। বেদ ভিত্তিক ধর্ম তাই বৈদিক ধর্ম। পরে এই ধর্মের নাম হয় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম।

তার আরও অনেক পরে এই ধর্মের নাম হয় হিন্দু ধর্ম। মাত্র কয়েকশ’ বছর আগে ধর্ম হিসেবে হিন্দু শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (ইরফান হাবিবঃ ভারত ভাবনার উৎস সন্ধানে ২০১৫)

প্রায় সমসময়ে ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয় নগরের রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণদেব রায়ের (১৪২৪-১৪৪৬) সত্যমঙ্গল তাম্রপটে ধর্ম হিসেবে হিন্দু কথাটা পাওয়া যাচ্ছে। (সুকুমারী ভট্টাচার্যঃ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা)।

বিজয়নগর ও বাহমনি এই দুই সাম্রাজ্যের কথা আমরা সকলেই ইতিহাস বইতে পড়েছি। বাহমনী ছিল মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য। তা থেকে নিজেদের পৃথক করতে এবং নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করে সেই গরিমাকে মহিমান্বিত করতেই দ্বিতীয় দেবরায় ‘হিন্দু’ শব্দটিকে ধর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন।

বৈদিক ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও হিন্দুধর্ম একই স্রোতধারায় বহতা নদীর মতো এগিয়ে গেছে বলে বৈদিক ধর্মের সময়কাল থেকে তাকে হিন্দুধর্ম বলাটা আমাদের স্বাভাবিক চল হয়ে গেছে। যদিও প্রাচীন বৈদিক ধর্ম এবং পরবর্তীকালের হিন্দু ধর্মের মধ্যে প্রভূত পার্থক্য আছে।

বৈদিক যুগে সূর্য, বরুণ, অগ্নি প্রমুখ দেবতারা পূজিত হতেন। বর্তমান সময়ে শিব, কৃষ্ণ, দুর্গা, কালী প্রমুখ দেব-দেবীরা ব্যাপকভাবে পূজিত হন।

বৈদিক ধর্মে মন্দিরের কোনো স্থান ছিল না। এখন মন্দির ছাড়া দেবতার কথা প্রায় ভাবাই যায় না। গাছ তলার দু'একটা শালগ্রাম শিলা ছাড়া প্রায় সব দেবতারই বাড়ি আছে, না হলে নিদেনপক্ষে একটা ঘর আছে। এই মন্দির বা বাড়ির ধারণাটা হিন্দু ধর্মে আসে বৌদ্ধদের হাত ধরে। বৌদ্ধধর্মে চৈত্য, স্তুপ, মঠ, বিহারকে ঘিরে জনসমাগম ঘটত। সেখান থেকেই এই ভাবনাটা হিন্দু ধর্মে প্রচলিত হয়। (ডঃ অসীম দাসঃ মার্কসবাদ ও ধর্ম)।

ধর্ম হিসেবে হিন্দু কথাটা অনেক পরে ব্যবহার হলেও হিন্দু শব্দের প্রচলন কিন্তু বহু প্রাচীন। সিন্ধু নদের থেকে হিন্দু শব্দের উৎপত্তি। ইরানিরা প্রথম ভারতবাসীদের হিন্দু বলে সম্বোধন করে। সিন্ধু নদের পূর্বদিককার অঞ্চলকে তারা সিন্ধু বলে ডাকতে চাইত। কিন্তু শব্দের প্রথমে তারা ‘স’ উচ্চারণ করতে পারত না। তাই উচ্চারণ ভ্রান্তিতে সিন্ধু হলো হিন্দু। এক্ষেত্রে হিন্দু হলো একটি স্থান বা জায়গা অর্থাৎ একটি ভৌগোলিক অঞ্চল।

প্রসঙ্গত, গ্রিকরা আবার শব্দের প্রথমে ‘হ’ উচ্চারণ করতে পারতো না। তাই তাদের উচ্চারণে হিন্দু হল ইন্দু। সেখান থেকেই ইন্দাস এবং ইন্ডিয়া। (Irfan Habib: Building the Idea of India)।

আবার হিন্দুধর্মের কথায় ফিরে আসি। খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামের নির্দিষ্ট জন্ম তারিখ আছে অর্থাৎ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই সময় সুনির্দিষ্ট। একইসঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠাতাও আছেন। আর আছে সেই ধর্মের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটাই নেই। বহু বছর ধরে সৃষ্টি হওয়া নানা ধরনের সাহিত্য, নানা ঋষি, ঋষিকা ও পণ্ডিতদের বক্তব্য এবং আদি কবিদের সৃষ্ট মহাকাব্যের শিক্ষায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে হিন্দুধর্মের ধারণা। তাই একটু গভীরভাবে অনুসন্ধান করলেই বোঝা যায় হিন্দু ধর্মের উৎপত্তির চরিত্রগত কারণেই এই ধর্ম সুস্পষ্টভাবে বহুত্ববাদী।

প্রত্যেক ধর্মেই সঙ্গত কারণেই নানান পশ্চাদমুখী চিন্তা ও সীমাবদ্ধতা আছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কোনো গভীর বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায় ধর্মগুলি যবে সৃষ্টি হয়েছে বা সমাজে ক্রিয়াশীল হয়েছে তারপর পৃথিবী আরও বহু বছর এগিয়ে গেছে। আর সেই সময়কালটা দু দশ বছর নয়, হাজার হাজার বছর। আর এই সহস্রাধিক বছরের চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান কোনো কিছুই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই এই পশ্চাৎপদতা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এতকিছুর পরেও একটা কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা দরকার - তা হলো, প্রতিটি ধর্মই মানুষকে অপরকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে। ঔদার্যের শিক্ষা দিয়েছে। হিন্দু ধর্মের নানা জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে ‘‘বসুধৈব কুটুম্বকম’’ অর্থাৎ পৃথিবীর সব মানুষকে আত্মীয়ের মতো ভালবাসো। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হলো, ‘‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়’’ অর্থাৎ অসৎ পথ ছেড়ে সৎ পথে চলো, অন্ধকারের রাস্তা ছেড়ে আলোর দিকে ফেরো। মহাভারতে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘‘গুহ্যং ব্রহ্মং যদিদং তে ব্রবীমী, ন মনুষাৎ শ্রেষ্ঠত্বরং হি কিঞ্চিত।’’ অর্থাৎ একটা গূঢ় সত্য কথা তোমাকে বলে যাই/ মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এই পৃথিবীতে কেউ নাই। আর এই কথার রেশ ধরেই কবি চণ্ডীদাস লিখলেন, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।

হিন্দু ধর্মের এই ইতিবাচক ভাবনাগুলোকে আত্মস্থ করে গান্ধীজি লিখলেন, ‘‘হিন্দু ধর্মের কোনো সুনির্দিষ্ট মতবাদ নেই। ...হিন্দু ধর্মমত ব্যাখ্যা করতে বললে আমি শুধু বলব অহিংসার পথে সত্যের সন্ধান। কোনো মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও নিজেকে হিন্দু বলতে পারেন। অক্লান্ত সত্যান্বেষণই হিন্দু ধর্ম। ...সকল ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্ম সহিষ্ণু এ তো নিশ্চিত। হিন্দু ধর্ম সকলকে আপন করে নেয়। (What is Hindu Religion, 1924)।

আমরা সকলেই জানি গান্ধীজি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। সেই বোধ থেকেই তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন। অথচ এই মানুষটিকেই খুন হতে হলো হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসের বন্দুকের গুলিতে। কেন খুন হলেন গান্ধী? তিনি কি হিন্দু ধর্মকে কখনো হেয় করেছেন? অসম্মানিত করেছেন? কক্ষনো নয়। তাহলে কেন তিনি খুন হলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আসল সত্য প্রকাশিত হয়। তা হলো হিন্দুত্ববাদ প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মের শত্রু। কারণ ধর্মীয় বোধের দ্বারা হিন্দুত্ববাদ গড়ে ওঠেনি। তাই হিন্দু ধর্মের সহিষ্ণুতা এখানে নেই। হিন্দুত্ব সম্পূর্ণতই একটি রাজনৈতিক ভাবনা এবং মতাদর্শ। সেখানে হিন্দু ধর্মের কোনো স্থান নেই। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের পবিত্র ধর্ম বিশ্বাসকে ভুল বুঝিয়ে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাস করানো বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপি’র অনুকূলে মতদান করানো। মানুষকে এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যেই তাদের নানান ধর্মীয় আয়োজন এবং উৎসবের ঘনঘটা। সেখানে গণেশ পুজো থেকে হনুমান জয়ন্তী কোনো কিছুরই কমতি নেই।

হিন্দু ধর্মের কি হিন্দুত্ববাদকে কখনো প্রয়োজন পড়ে? ধর্মীয় আচরণের জন্য বা উপাসনার জন্য হিন্দু ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই হিন্দুত্বের। কারণ দুটো ধারণা সম্পূর্ণ পৃথক। দুই ভাবনার অ্যাজেন্ডাও একদম আলাদা।

হিন্দুত্ব শব্দটিকে আমরা প্রথম পাই ১৮৯২ সালে চন্দ্রনাথ বসুর লেখা "হিন্দুত্বঃ হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস" বইয়ে। তবে সে হিন্দুত্ব আজকের আলোচ্য হিন্দুত্বের সমার্থক নয়। আজকের আলোচনার হিন্দুত্বের ধারণার উদগাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তিনি প্রথমে ‘‘Essentials of Hindutva’’ এবং পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি হিন্দু ধর্মের বদলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণার কথা তুলে ধরেন এবং একে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কথা বলেন। এখান থেকেই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার সূত্রপাত।

একটু মনোযোগ সহকারে খেয়াল করলেই আমরা দেখব যে শঙ্করাচার্য থেকে রামকৃষ্ণ, তুলসীদাস থেকে বিবেকানন্দ, কেউ কোনোদিন ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তার প্রধান কারণ হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম-পদ-বাচ্য শব্দ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি রাজনৈতিক দর্শন। ধর্মের সঙ্গে এর যে কোনো প্রত্যক্ষ যোগসূত্র নেই তার সবচেয়ে অকাট্য প্রমাণ হলো সাভারকর নিজে নাস্তিক ছিলেন। (AG Noorani: Savarkar and Hindutva)। সাভারকরের একনিষ্ঠ গুণমুগ্ধ হিন্দুত্ববাদের অন্যতম ধারক-বাহক মনুজচন্দ্র সর্বাধিকারী সাভারকরের এই বইটির মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে বইটি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়ে কংসের কারাগারে বাসুদেবের আবির্ভাবের সঙ্গে এর তুলনা করেছেন। তিনি লিখলেন, ‘‘বস্তুত যে ঐতিহাসিক কারণে কারাগারে বাসুদেবের আবির্ভাব, প্রায় সেরকমই এক ঐতিহাসিক কারণে বর্তমান যুগে রত্নগিরি কারাগারে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে একটি গ্রন্থের জন্ম হয়। গ্রন্থটির নাম ‘হিন্দুত্ব’। রচয়িতার নাম বিপ্লবী শ্রেষ্ঠ বীর বিনায়ক রাও দামোদর সাভারকর।

এই মনুজচন্দ্র ওই একই লেখায় লিখছেন, ‘‘হিন্দুয়ানী (হিন্দু ধর্মাচরণ) ও ‘হিন্দুত্ব’ যে এক বস্তু নয়, ‘হিন্দুত্ব’ যে ধর্ম বাচক বিশেষণ নয়, গুণবাচক বিশেষ্য... একথা সাভারকরজিরর মতো আর কে বোঝাতে পেরেছেন?

মনুজচন্দ্র জানাচ্ছেন সাভারকরের বক্তব্যের মর্মবাণী, ‘‘Hinduise Politics and Militarize Hindudom’’ অর্থাৎ রাজনীতির হিন্দুকরণ ও হিন্দু সমাজের সামরিকীকরণ। পূর্বোক্ত কথাগুলো থেকে আমাদের নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হয় না হিন্দুত্বের ধারণা হিন্দুধর্ম থেকে কত যোজন দূরে। পরিশেষে এই বিতর্কে দাঁড়ি টানতে একবার স্বয়ং সাভারকরের ভাষাতেই দেখে নেওয়া যাক এ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য কী।

সাভারকর ‘হিন্দুত্ব’ বইয়ের ‘‘হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুধর্ম’’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘‘হিন্দুত্ব নিছক একটি শব্দ নয়, একে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলা যায়। কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ইতিহাস নয়। যদিও মাঝেমধ্যেই এই শব্দেরই অনুরূপ ‘হিন্দুধর্ম’ কথাটার সঙ্গে একে ভুল করে মিলিয়ে ফেলা হয়।’’

আশা করি হিন্দুত্বের ধারণার উদগাতার এই বক্তব্যের পরে আর আমরা অন্তত হিন্দুত্বের সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে গুলিয়ে ফেলব না। সেই সঙ্গে মানুষের কাছেও তুলে ধরতে হবে হিন্দুত্ব ও হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ।

হিন্দু ধর্ম মানুষের বিশ্বাস, হিন্দুত্ব রাজনীতির হাতিয়ার।

তাই আসুন, শপথ নিই, মানুষের পবিত্র ধর্ম বিশ্বাস যেন করপোরেট হিন্দুত্বের অশুভ আঁতাতের নীতিতে চলা আরএসএস বিজেপি’র নির্বাচনী বৈতরণী পেরনোর ময়ূরপঙ্খী তরী না হতে পারে তার জন্য সর্ব শক্তি নিয়োগ করে লড়াই জারি রাখব।